জন্ম কখনও কখনও ঠেকানো যায়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু ঠেকানোর কোনও উপায় কারও জানা নেই। সব মৃত্যুই শোকের, সব মৃত্যুই বেদনার। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর শোক তবুও সওয়া যায়। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুর শোক স্বজনদের আজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার বিবেচনায় সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু। গুলি, বোমা, পানিতে ডুবে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ মারা গেলে তার কষ্ট কম হয়। কিন্তু আগুন মানুষকে মারে আস্তে আস্তে। অসহায় মানুষ চোখের সামনে এগিয়ে আসতে দেখেন নিশ্চিত মৃত্যু। আগুনে মানুষ মারা যায় পুড়ে বা শ্বাস বন্ধ হয়ে। কিন্তু একেবারে বা তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান না। ধীরে ধীরে কষ্টকর মৃত্যু মেনে নিতে হয় তাদের। পুরান ঢাকার চকবাজারের আগুনে অনেকে গাড়িতে বা রিকশায় বসেও পুড়ে গেছেন। দৌড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সুযোগও পাননি। আগুন দেখে অনেকে আশপাশের দোকানে শাটার নামিয়ে নিজেদের নিরাপদ ভেবেছেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা কাউকে ছাড়েনি। ডাক্তার যেমন পুড়ে মরেছেন, রোগীও রেহাই পাননি। ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিক নিচতলা ও দোতলায় প্লাস্টিক পণ্য আর পারফিউমের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়ে পুরো বাড়িটিকে বোমা বানিয়ে তার ওপর বাস করছিলেন। আহারে, নিজের বাড়িতে বসে এমন নির্মম মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের দায় আছে। কিন্তু পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের দায়ও কিন্তু কোনও অংশেই কম নয়।
শুধু ওয়াহিদ ম্যানশন বা রাজ্জাক ম্যানশন নয়, পুরান ঢাকার অধিকাংশ বাড়িই যেন একেকটি বোমা। পুরো পুরান ঢাকা যেন একটা মাইনফিল্ড। গত সপ্তাহে ফায়ার সার্ভিসের এক পরিচালক তার মোবাইলে থাকা কয়েকটি ছবি দেখালেন। যেখানে পাখির বাসার মতো পেঁচিয়ে থাকা বৈদ্যুতিক তার আর যেখানে সেখানে ট্রান্সফরমার। তিনি বলছিলেন, পুরান ঢাকায় যে প্রতিদিন আগুন লাগে না, এটা তো আমাদের ভাগ্য। সামান্য একটা স্পার্ক থেকে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। তার আশঙ্কা সত্যি হতে সময় লাগেনি।
গত সপ্তাহে এ মৌসুমের প্রথম আগুন লেগেছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেদিন ১২০০ রোগীকে দ্রুততম সময়ে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া গেছে। এত বড় আগুনেও কোনও হতাহত না ঘটায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলাম। মাত্র ৭ দিনেই সেই ঢেঁকুর গিলে ফেলতে হলো। গত সপ্তাহে টকশোতে এই আশঙ্কার কথাটিও আলোচিত হয়েছে। চারপাশে প্রশস্ত রাস্তা থাকায় এবং হাসপাতাল চত্বর প্রশস্ত হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দুর্যোগ মোকাবিলায় যে সাফল্য এসেছে, পুরান ঢাকার কোনও হাসপাতাল বা বাসায় আগুন লাগলে তা হবে না; হয়ওনি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আগুনকে সবাই এ মৌসুমের 'ওয়েকআপ কল' বলছিলেন। কিন্তু সে কলে আমাদের ঘুম ভাঙেনি। তবে চকবাজারের আগুনের আসল 'ওয়েকআপ কল' ছিল নয় বছর আগে, ২০১০ সালে নিমতলীতে। সেবার নিছক 'কল' নয়, ধাক্কা দিয়ে আমাদের জাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আমরা বোধহয় জাতি হিসেবেই কুম্ভকর্ণ। আমাদের ঘুম ভাঙানোর সাধ্য কার?
চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে বুধবার রাতে ছিল অনড় যানজট। সেখানেই একটি পিকআপভ্যানের ধাক্কায় একটি থ্রি হুইলারের সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। সেখান থেকে আগুনের ফুলকি লেগে বিস্ফোরিত হয় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার। সেখানে পাশের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডার, সেখান থেকে প্লাস্টিক দানার কারখানা, পারফিউমের গুদাম- সব মিলিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যে চেইন রিয়েকশনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ, যেন যুদ্ধক্ষেত্র। ফায়ার ব্রিগেডের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও আগুন জ্বলেছে রাতভর। সেই আগুন কারবালা বানিয়ে ফেলে গোটা চকবাজার এলাকাকে। পুড়ে যায় ৭০টি মানুষের জীবন, ৭০টি পরিবারের স্বপ্ন। ঢাকা মেডিক্যালের মর্গের সামনে স্বজনহারা মানুষের আহাজারি।
বড় কোনও ঘটনা ঘটলেই আমরা লিখি ‘স্মরণকালের ভয়াবহ'। কিন্তু চকবাজারে এত বড় আগুন, এত মানুষের প্রাণহানির পরও কিন্তু আমরা এটা লিখছি না। আসলে লেখার মুখ নেই। কারণ, মাত্র ৯ বছর আগে নিমতলীতে প্রায় একই ধরনের আগুনে ১১৯ জন মারা গিয়েছিল। এখনও আমাদের স্মৃতিতে সে আগুনের দগদগে ঘা। নিমতলীর পর চকবাজার পর্যন্ত আসতে যে আমাদের নয় বছর লেগেছে, সেটা সৃষ্টিকর্তার পরম আশীর্বাদ। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালকের আশঙ্কাটাই যেকোনও দিন সত্যি হতে পারতো। হতে যে নয় বছর লেগেছে, সে আমাদের কপাল। একে তো আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য সব উপাদানে ঠাসা পুরান ঢাকা, তার ওপর নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার পর্যাপ্ত রাস্তা নেই, নেই প্রয়োজনীয় পানি।
নিমতলীর আগুনের পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের কারখানা, প্লাস্টিকের গুদাম, পারফিউমের কারখানা সরানো নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক হুমকি-ধমকি শুনেছি। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। হাল ছেড়ে দিয়ে আমরা বসেছিলাম আরেকটি আগুনের জন্য। নিমতলীর আগুনকে আমরা দুর্ঘটনা বললেও চকবাজারের আগুনকে দুর্ঘটনা বলবো কোন মুখে? আমরা যদি নিজেদের বাড়িকে, এলাকাকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে; আগুন ছড়ানোর সব উপাদানে সাজিয়ে বসে থাকি; তাহলে আর তাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে কি? এটা তো আমাদের সম্মিলিত আত্মহত্যা। এখন আমরা কান্নাকাটি করবো, আহাজারি করবো, অনেক টকশো হবে, অনেক আশ্বাস শুনবো, অনেক সাবধানতা শুনবো, হুমকি-ধমকি আসবে অনেক; কিন্তু যারা গেছে তারা তো ফিরবেন না। তাদের স্বজনদের শোক কি কোনও টাকার অংকে কমবে? মানুষের জীবনের কোনও বিনিময় হয় না, জীবন অমূল্য।
৭০টি মানুষ আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে কি আমাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য, উদাসীনতার জন্য, খামখেয়ালির জন্য আমাদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন? সেই অভিশাপে কি আমরা সত্যি সত্যি সতর্ক হবো? নাকি আরেকটি আগুনের জন্য অপেক্ষা করবো?
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ