X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া প্রসঙ্গ

রেজানুর রহমান
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:২১আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:৩৪

রেজানুর রহমান তার মানে ঘটনা পরিষ্কার। ৭১ সালে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করবে জামায়াতে ইসলামী। এ ব্যাপারে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের সাংগঠনিক টালমাটাল অবস্থা দেখে তাই তো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে দলের অন্যতম শীর্ষনেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ এবং শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দল থেকে বহিষ্কারের পর থেকে জামায়াতের ভেতরে ও বাইরে একটা অস্থির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। কিন্তু কার্যত জামায়াত কি অস্থির? দল হিসেবে হয়তো একটা সংকটের মুখোমুখি পড়েছে। কিন্তু দলের মানুষগুলো, যারা এই দল চালায় তারা কি আদৌ অস্থির? নাকি বিপদে পড়ে কোনোমতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আশায় কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। ধরা যাক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন যদি ক্ষমতায় না থাকতো তাহলে জামায়াতে ইসলামী নামের এই দলটি কি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কথা স্বীকার করতো? অথবা স্বীকার করতে চাইতো? দলটির নেতারাই একসময় আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে অনেক কটুকথা বলেছেন। কতই না আস্ফালন করেছেন। বীরদর্পে বলেছেন, একাত্তরে ভুল করিনি। কাজেই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। একটি পত্রিকায় সদ্য জামায়াত থেকে পদত্যাগী শীর্ষ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পড়ে কিছুটা অবাক হয়েছি। ‘স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনও দল টেকেনি। ৭১-এর জামায়াত দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল...’ সাক্ষাৎকারে এমনই কিছু সত্য কথা বলেছেন আব্দুর রাজ্জাক। এটা কি তার মনের কথা? তাই যদি হয় এতদিন বলেননি কেন?

ধরা যাক, এই সময়টায় যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকতো তাহলে আব্দুর রাজ্জাক সাহেবেরা এভাবে সত্য কথাটা বলতেন? নাকি বীরদর্পে আবারও সেই হুঙ্কারই তুলতেন’ একাত্তরে ভুল করিনি। কাজেই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না!

এখনও ভাবতে অবাক লাগে। স্বাধীনতার জন্য একটা দেশের মানুষ যখন মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত তখনই দেশের কিছু মানুষ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতাকামী নিরীহ অসহায় মানুষকে তারা নির্মম, নির্দয় কায়দায় হত্যা করেছে। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশটি স্বাধীনতা পেলো। তখনই তো স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানকারী মানুষগুলোর উচিত ছিল প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। অথচ ক্ষমা তো তারা চায়নি বরং দেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার না করেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে নেয়।

কী নির্মম ইতিহাস! যে লোকটি মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতাকারীর ভূমিকায় প্রকাশ্যে নানা কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল জামায়াতের সেই লোকটিই স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছে। গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাঁকিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে। কোথাও কোথাও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে তাকে সালামও দিয়েছেন। জামায়াতের এই নেতাকে কে এই সুযোগটা করে দিয়েছিল? সহজ উত্তর বিএনপি। বিএনপির মদতেই মূলত জামায়াত দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বীরদর্পে এতদিন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। কথাটা হয়তো কৌতুকের মতোই শোনাবে। তবুও উল্লেখ না করে পারছি না। ঠেলার নাম বাবাজি বলে একটা কথা আছে। বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেই বলে কি জামায়াতকে পরামর্শ দিচ্ছে যাও ভুল স্বীকার করো। আরে এটা তো কথার কথা। প্রকাশ্যে বললেই কি আর ভুল স্বীকার করা হলো নাকি? রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার জন্য কত কথাই না বলতে হয়। ক্ষমা চাই বললেই যদি সবকিছু মিটে যায় তাহলে দুই অক্ষরের শব্দটা বলতে সংকোচ কেন? ক্ষমা চাও, তারপর আমরা তো আছি তোমার সঙ্গে। মুখে যা বলেছি তা তো মনের কথা নয়। মনে আছে অন্য কথা! আর একবার যদি সুযোগ পাই… তাহলে চেহারাটা আবার পাল্টে ফেলবো।

জামায়াতকে নিয়ে ভয়টা কিন্তু এখানেই। জামায়াতের ভেতর এখন যা চলছে তা কি বাস্তব, নাকি সাজানো নাটক? কারণ, এই দলটিকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ৪৮ বছর ধরে যে ভুলটা তারা স্বীকার করেনি, আজ কেন সেটা স্বীকার করতে যাচ্ছে? এটা কি রাজনীতির কৌশলগত কোনও অবস্থান, নাকি মন থেকে ভুল স্বীকার করার কথা ভাবছে? যদি কৌশলগত অবস্থান হয় তাহলে তো স্বস্তিদায়ক কোনও সংবাদ নয়। বিষধর সাপকে যতই পোষ মানানো হোক না কেন, সময় সুযোগ পেলে সে ছোবল দেবেই। জামায়াত কি কোনোভাবে কৌশলগত সেই অবস্থান নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে? ভাবটা এমন, এখন আপাতত ভুল স্বীকার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখি। পরে সময় সুযোগ মতো আবার খোলস পাল্টাবো।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম ৭ম শ্রেণির ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কিছু মানুষের মুখ এখনও মনে পড়ে। ভেবেছিলাম স্বাধীনতার পর তাদের অস্তিত্বই বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু একটা পর্যায়ে বিশেষ করে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতার বিপক্ষের এই মানুষগুলোই রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। কতবার ভেবেছি পরিস্থিতি কি পাল্টাবে না? স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি কি একবারও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবে না জাতির কাছে?

আমাদের মহান রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দেশ ভাবনার আন্তরিক স্পর্শ পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এখন প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। কাজেই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে এবার জাতির কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। এটাই সময়ের দাবি। কিন্তু জামায়াতকে কি বিশ্বাস করা যায়? ধরা যাক ‘৭১ সালে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চাইলো। তারপর কী হবে? নতুন নামে আবারও কি আগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে?

কথায় আছে যার যায় সেই বুঝে তার কতটা ক্ষতি হয়েছে। ৭১ সালে জামায়াত দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে ভূমিকা নিয়েছিল তাতে দেশ বুঝেছে তার কতটা ক্ষতি হয়েছে। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ, অসহায় মানুষ জীবন দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এ জন্য জামায়াত ভুল স্বীকার করলেইবা না করলেইবা কী? যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের তো ফিরে পাওয়া যাবে না? কথা সেটা নয়। কথা হলো শত্রুকে পাশে রেখে পথ হাঁটা মোটেই উচিত নয়। পথে বিপদ এলে শত্রু তার আসল চেহারায় ফিরে আসবেই। হয় বিপদে ফেলে রেখে পালাবে, না হয় সুযোগ বুঝে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চলে যাবে, অথবা সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নেবে। যে মুহূর্তে জামায়াত তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারে বলে খবর ছড়িয়েছে সেই মুহূর্তে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতাদের পরিবারের সদস্যদের বর্তমান ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা নানাভাবে দেশের বিরুদ্ধে বিশেষ করে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কও কিন্তু নিগূঢ়। অভিযোগ রয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলও ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া না চাওয়ার বিষয়টি কি দলটির কৌশলগত অবস্থানে পরিণত হবে? এটাই এখন দেখার বিষয়।

একটা সত্য ঘটনা বলে লেখাটি শেষ করি। ৭১ সালের ঘটনা। কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে পাঁচপীর (দুর্গাপুর) রেলস্টেশন হয়ে রেললাইন চলে গেছে চিলমারী বন্দরের দিকে। পাঁচপীর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে একটি কাঁঠাল গাছ ছিল। ৭১ সালের ৯ মাসে প্রায় প্রতিদিনই রাজাকাররা নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিতো। তাদের মুক্তিবাহিনীর সদস্য ভেবে নানাভাবে নির্যাতন করতো স্টেশনে তাঁবু গেড়ে থাকা পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা। কাউকে কাউকে কাঁঠাল গাছটির ডালে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করা হতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্টেশনের ওই কাঁঠাল গাছটি দেশ স্বাধীনের পরই মারা যায়। কিন্তু যারা ওই গাছে অসহায় মানুষকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করতে পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল, তাদের অনেকেই জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে এখনও বীরদর্পে এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। বাহ! কী চমৎকার!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

 

এমএফও

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ