X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চারণগুলো শোকের, বিক্ষোভের

জোবাইদা নাসরীন
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩২আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:২৭

জোবাইদা নাসরীন ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬৭ (এই লেখা পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী)। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন নিহতদের স্বজন, আছেন নিখোঁজদের স্বজনও। পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর অপেক্ষা। আরও কষ্টের, সম্ভবত এক জীবনে সবচেয়ে বেদনার, হৃদয় ছিঁড়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা; পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া শরীর থেকে একটুখানি নখ, পুড়ে যাওয়া চোখের একটু খানি বেঁচে যাওয়া চামড়া কিংবা পায়ে শক্ত করে বাঁধা জুতা, কিংবা পোড়া পায়ের সাথে লেগে থাকা জুতার লেইসটি, সবকিছুই খুঁটে খুঁটে প্রিয়জনের লাশটি চিনতে হচ্ছে। একত্রিত করতে হচ্ছে চেনা পরিচয়ের সকল চিহ্নকে। প্রিয়জনের মৃতদেহটি যদি একটু কম পোড়া থাকে? শেষবারের মতো মুখটাও যদি একটু দেখা যায়? জেনে গেছে প্রিয়জন নেই, তবুও লাশটিকে আঁকড়ে ধরা… জীবনের কী নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতা! হাত থেকে জীবন ফসকে যাওয়ার এক চরম দুঃসময়।

২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে দেশ যখন স্মরণ করছে ভাষা আন্দোলনের বীর সন্তানদের, সে সময়ই, ঠিক সেই সময়ই পুরান ঢাকার চকবাজারে লাগা আগুনের ঝলসে যাচ্ছিলো মানুষেরা। এই আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। কেউ জানান, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগেছে। সেখান থেকে ওয়াহিদ ম্যানশন নামের সাততলা ভবনে প্রথম আগুন লাগে। ওই ভবন থেকে আগুন পাশের তিনটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলেন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আবার কেউ বলেন ভবনটির পাশের খাবার হোটেল থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে পুরো এলাকায় ছোটাছুটি শুরু হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য আশপাশের ভবন থেকে লোকজন দ্রুত নেমে যেতে থাকেন।

আগুনের উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেন, সেই আগুন নিয়ে নিয়েছে ৬৭ প্রাণ (এখন পর্যন্ত)। দিনশেষে এ সংখ্যা আরও বাড়বে হয়তো। অনেক চেষ্টা করে ১১ ঘণ্টা পর ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা সে আগুন নিভিয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টারও। কারণ, আগুন লাগার স্থানে যাওয়ার গলি এত সরু যে সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারছিলো না। কিন্তু কী আশ্চর্য, যেখানে একটি গাড়িও ঢুকতে পারে না, সেই গলির সাততলা ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলায় ছিল পারফিউম, বডি স্প্রে, প্লাস্টিক পলিথিনের কাঁচামালের গুদাম, কারখানা, সেখানে ছিল নানা ধরনের দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য। সেখানে আগুন লাগার সম্ভাবনা তো বেশি থাকারই কথা। এক্ষেত্রে হয়েছে তা-ই, সেই গুদামের কারণে আগুনের শক্তি বেড়ে গিয়েছিলে এবং দ্রুত ছড়াতে সহায়তা করেছিল।

অনেক বছর থেকেই বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন আবাসিক বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ রয়েছে, যা আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এই বিষয়ে যাদের মনোযোগী হওয়ার কথা তারা কেউই দায়িত্ব পালন করছেন না তা-তো বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের জীবনের বিনিময়ে।

আজকের এই দুর্ঘটনার সঙ্গে অনেকটাই মিল পাওয়া যায় আট বছর আগে ঘটা নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১ নবাবকাটরায় পাঁচতলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় বাংলাদেশ একই দিনে হারিয়েছিল ১২৩ জনকে। আহত হয়েছিল কয়েকশ মানুষ। কেমিক্যাল গোডাউন থেকে সেদিন আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এবং সেটি ছড়িয়ে পড়েছিল। গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এবারের ঘটনাটিও কিছুটা তা-ই। সূত্রপাত ভিন্নভাবে হলেও আগুনে দ্রুত ছড়িয়েছে পারফিউম, বডি স্প্রে, প্লাস্টিক পলিথিনের কাঁচামালের গুদাম ও কারখানার কারণে।

সে সময় ১২৩ জনের লাশ বুকে নেওয়া নিমতলী ট্র্যাজেডি আসলে আমাদের কি কোনও শিক্ষা দিয়েছিল? আমরা কী সেই অভিজ্ঞতায় ভর দিয়ে শোকের বাইরে আর কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলাম? যতদূর মনে পড়ে সেই ঘটনার কারণ এবং পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। রিপোর্টও জমা হয়েছিল, তবে পদক্ষেপ দেখা যায়নি। জানা যায়, তদন্ত কমিটির অন্যতম সুপারিশ ছিল কেমিক্যালের অনিরাপদ গুদামগুলো দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গত আট বছরে কেউ নেয়নি। যাদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা অর্থাৎ সেখানকার সাংসদ, মেয়র, সিটি কাউন্সিলর, সরকারি প্রশাসনের লোকজন, কারোরই এ বিষয়ে মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয়নি। কারণ, উদ্যোগ নিলে এ ধরনের অনিরাপদ গুদামঘর সেই ভবনে থাকতো না।
শুধু পালিত হয়েছিল একদিনের শোক। দৃশ্যমান পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিলাম সেখানের তিনজন নারীর বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরে আর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়নি।
না, আমরা কোনও কিছু শিখিনি। আমরা শুধু একদিনের রাষ্ট্রীয় শোকের মধ্য দিয়ে লাশকে বরণ করে নিতেই শিখে গেছি। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি, বড় বড় ভাষণ- সবকিছুতেই আমরা ভীষণ পারদর্শী। কিন্তু কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ, মানুষের জীবন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিক্ষুব্ধ এবং শোকাহত মন ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের কাছে জানতে চায় নিমতলী ট্র্যাজেডির পর বিশেষ করে বাসাবাড়ির এলাকায় বিভিন্ন দাহ্য পণ্যের গোডাউন রাখার বিষয়ে অনুমতি কীভাবে চলমান থাকে? এবং যেগুলো আগে থেকে ছিল সেগুলো সরানোর বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সেগুলো সরানো হলো না কেন? আর না নিলে কেন নেননি?
এগুলো দুর্ঘটনা নয়। এ ধরনের অব্যবস্থাপনাজনিত অগ্নিকাণ্ডকে আমরা হত্যাকাণ্ডই বলবো। এতবড় ঘটনার পর এবারো যথারীতি কেউ দায়িত্ব নেবেন না, পদত্যাগ করবেন না কেউই। বাংলাদেশে কোন দুর্ঘটনায় কেউ দায়িত্ব নেয় না, পদত্যাগ করে না। আর শুধু শোক পালনের দিন নয়, আমরা জবাবদিহি চাই।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের দাবি ‘অযৌক্তিক’: ভারত
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের দাবি ‘অযৌক্তিক’: ভারত
‘বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, আ.লীগ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে’
‘বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, আ.লীগ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে’
রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা
রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা
‘এখন দেখছি মরে গেলে লাশেরও নিরাপত্তা নেই’
কঙ্কাল চুরির পর বিক্ষুব্ধ স্বজন বললেন‘এখন দেখছি মরে গেলে লাশেরও নিরাপত্তা নেই’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ