বিমান ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাহন হিসেবে বিমান সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হয় যদি সেই বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত হয়। অনেকে মনে করেন পুরনো বিমানের চেয়ে নতুন বিমান ভালো। কথাটা ঠিক নয়। কারণ, পুরনো বিমানের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হলে সে সব সময় নতুনই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছরের পুরনো বিমান এখনও চলে। বিমানের নিরাপত্তার জন্য দুটি জিনিস বড়ই প্রয়োজন। আর তা হলো দক্ষ চালক আর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিমান সংস্থার পাইলট ও কেবিন ক্রুর মান বেশ উন্নত। যেকোনও বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হতে হয় উন্নতমানের। বিমান যাত্রার সার্বিক ব্যবস্থা এমন হতে হয় যেন যিনি বা যারা যাত্রী হিসেবে বিমানে চড়বেন তাদের কেউ যেন অন্য যাত্রীদের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ান। একজন যাত্রী বিমানের ভেতর মদ্যপ হয়ে গেলে অন্য যাত্রীদের বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে। বিমানের ভেতর মদ্যপ হওয়া খুব সহজ। কারণ, বিমানের অভ্যন্তরে মদ বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। বিজনেস ক্লাস বা প্রথম শ্রেণির যাত্রী হলে হুইসকি, ভোদকা, কনিয়েক ইত্যাদি চড়া অ্যালকোহল সমৃদ্ধ পানীয় বেশুমার পাওয়া যায়, যাকে বলে হার্ড ড্রিংকস। ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের বিয়ার আর ওয়াইনে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর কোনও যাত্রীর যদি কুমতলব থাকে তাহলে সে চেষ্টা করে কোনও মতে একটি অস্ত্রজাতীয় কিছু বিমানের অভ্যন্তরে চোরাইপথে নিয়ে গিয়ে উড়ন্ত বিমানে তা বের করে সব যাত্রীকে জিম্মি করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করা। এর নাম বিমান হাইজ্যাক, উড়ন্ত বিমানে দুরন্ত ডাকাত আর কী।
সম্প্রতি বাংলাদেশে তেমন একটি ঘটনাই দেশে তো বটেই, বিদেশে তোলপাড় চলছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ান ইলেভেনের পর সারা বিশ্বে সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করার নামে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে, যা আগে কোনও নিয়মিত যাত্রী কল্পনাও করতে পারতো না। দীর্ঘ চার যুগেরও বেশি সময় ধরে বিমানযাত্রার দু-একটি উদাহরণ দেই।
১৯৭৮ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্র হতে হংকং হয়ে দেশে ফিরছি। হংকংয়ে একরাতের যাত্রাবিরতি। সকালে বিমান ছাড়বে। বিমানের খরচে পাঁচতারা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা। হাতে একটি ছোট ব্যাগ ও একটি পোর্টেবল টাইপরাইটার। নিরাপত্তা কাউন্টারে আসতেই একজন নিরাপত্তা কর্মী টাইপরাইটারটাকে একটি কাঠের বাক্সে রাখতে বললে দেখা গেলো সেটি তাতে ঢুকছে না। না হাতে করে নেওয়া যাবে না। চেক ইন করে দিতে হবে। তার জন্য আর একটি ব্যাগ কিনতে হলো, তারপর চেক ইন। হংকং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বর্তমানে আরও কঠোর করা হয়েছে। বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরে নিজের ব্যবহার্য ওষুধ ছাড়া আর কিছু হাত ব্যাগে নিতে দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দেশের যাত্রীদের ল্যাপটপ ও আইপ্যাডও নিতে দেওয়া হয় না। কিছু দিন আগের কথা। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমার হাতব্যাগ স্ক্যানারে দিয়ে বললেন, তোমার ব্যাগে সুচালো কিছু আছে। মনে করতে পারি না কী হতে পারে। ব্যাগ খোলো। দেখা গেলো ইন্সুলিনের সিরিঞ্জের চিকন ছোট সুঁই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কোমরের বেল্ট, জুতা, টুপি, হাতঘড়ি, পয়সা, সবকিছুই স্ক্যানারে দিয়ে দিতে হয় বিশ্বের যেকোনও বিমানবন্দরে নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিমানবন্দরে তারপর ঢুকতে হয় একটি গ্লাসের খাঁচায়। এটি একটি এক্সরে যন্ত্র। যাত্রীর শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্ক্রিনের পেছনে বসে দেখছেন নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা। মহিলাদের জন্য একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। প্রথমদিকে কিছু মহিলা সংগঠন আপত্তি তুলেছিল। টেকেনি। কোনও ধরনের তরল সুগন্ধি একশত গ্রাম পর্যন্ত নেওয়া যেতে পারে। স্প্রে জাতীয় জিনিস একেবারেই ‘নো নো’। একবার যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিমানবন্দরে দেখি একজন যাত্রীকে পর্দাঘেরা ঘরে নিয়ে তার প্যান্ট পর্যন্ত খুলে চেক করা হলো। পর্দার বাইরে থেকে তা দেখা যাচ্ছিল। গত বছর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ আব্বাসিকে তার পরনের জামা খুলতে হয়েছিল নিউ ইয়র্কে জেএফকেতে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে জুতা বেল্ট খুলতে হয়েছিল। অভিনেতা শাহরুখ খানের তল্লাশি পর্ব নিয়ে তিনি তো একটি ছবিই বানিয়ে ফেলেছিলেন। এতসবের পরও নিরাপত্তা কর্মকর্তা সন্তুষ্ট না হলে ডাক পড়বে পেছনের ঘরে। অদ্ভুত সব প্রশ্ন। তোমার নামের আগে পিছে আর কোনও নাম নেই? তোমার বউকে কোথায় রেখে এসেছো? পাসপোর্টে তোমার চুলের রং সাদা কালো লেখা আছে। তা কি সত্যি? একবার নিউ ইয়র্ক জেএফকে বিমানবন্দরে যখন আমার সওয়াল জবাব চলছিল তখন বাংলাদেশ হতে যাওয়া আমার পাশেরজন বেশ জোরে জোরে দোয়া পড়ছিলেন। একবার ফ্র্যাংকফ্রুর্ট বিমানবন্দরে দেখি আমাদের নিরাপত্তা লাইন সরছে না। সামনে বেশ উত্তেজনা মনে হলো। দেখি একজন জার্মান পুলিশ বিরাট এক কালো কুকুর নিয়ে আমার পাশে হাজির। একটু ঘাবড়ে তো গিয়েছিলাম। বিকৃত ইংরেজিতে জার্মান পুলিশ জানতে চাইলো আমি ইন্ডিয়ান কিনা। বলি ‘না’। তারপরের প্রশ্ন ইন্ডিয়ান ভাষা বুঝি কিনা। বলি ইন্ডিয়ান ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই। আর কোনও প্রশ্ন না করে বললো তার সঙ্গে আসতে। আমার পেছনে ভয়ঙ্কর এক কালো কুকুর। তার পেছনে সেই পুলিশ। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখি এক ভারতীয় বয়স্ক মহিলার সঙ্গে নিরাপত্তা অফিসারের তুমুল কথাকাটাকাটি হচ্ছে। পেছনের পুলিশ বলে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি জার্মানি কেন এসেছেন। আমি আমার ভেজাল হিন্দিতে মহিলার কাছে জানতে চাই সমস্যা কী? মহিলা এতক্ষণে বলেন, তিনি অনেকক্ষণ ধরে ওই অফিসারকে বলার চেষ্টা করছেন তিনি তার ছেলের কাছে কয়েক মাস কাটিয়ে দিল্লি ফেরত যাচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে জার্মান অফিসার তো পাঞ্জাবি বোঝেন না। মহিলার সোজা প্রশ্ন, সে যদি পাঞ্জাবি না বুঝে তাহলে তিনি কেন তার ভাষা বুঝবেন? যুক্তিসঙ্গত কথা বটে। কিন্তু বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছে মাঝে মাঝে যুক্তি অর্থহীন। সেই যাত্রায় কিঞ্চিত লাভ আমারও হয়েছিল। মহিলার পরপরই আমাকে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হতে দিয়েছিল।
এবার একটু বাংলাদেশের কথায় ফিরে আসি। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকার শাহ্জালাল বিমানবন্দর। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বলা হলেও সেখানে সীমিত আকারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করে, তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমানের। শাহজালাল বিমানবন্দর বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রাফিক হ্যান্ডেল করে। মনে হয় কলকাতার চেয়েও বেশি। শাহজালালের পূর্বসূরী ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সামনে তেজগাঁও বিমানবন্দর, যা বর্তমানে ভিআইপি হেলিকপ্টার ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ওঠানামা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক হোক বা অভ্যন্তরীণ, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হতে হয় নিশ্ছিদ্র। শাহজালালের নিরাপত্তা আগের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা উন্নত হয়েছে বলে মনে হয়। তারপরও বলতে হয় তা যথেষ্ট নয়। কারণ, তা যদি হতো গত ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় দুবাইগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে পলাশ আহমেদ নামের এক উন্মাদ পিস্তল নিয়ে ছিনতাই করার চেষ্টা করতো না। প্রথম কথা হচ্ছে, পিস্তল খেলনা হোক বা আসল, কোনোটাই বিমানবন্দরে নিয়ে ঢুকার কথা নয়। তার জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তার অথবা বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা কারো না কারো সহায়তা। বাংলাদেশের বিমানবন্দরসমূহের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে তথাকথিত ভিআইপিদের সঙ্গে বড়ভাইদের জোরপূর্বক বিমানবন্দরে প্রবেশ। গত ২৩ তারিখ সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি। তখন বেলা বারোটা হবে। সঙ্গে একজন বিদেশি কূটনীতিক। হঠাৎ ভিআইপি লাউঞ্জের প্রবেশপথে শোরগোল। উঠে গিয়ে দেখি একজন লাল টি-শার্ট পরা বড় ভাই জোরপূর্বক ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকার চেষ্টা করছে। নিরাপত্তাকর্মী তাকে ঢুকতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার পরিচয় জানতে চাইলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে সেই নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করলো এবং একপর্যায়ে চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকিও দিলো। কিছুক্ষণ পর একজন সিনিয়র কমকর্তা এলে তার সঙ্গে সেই বড় ভাই একই ব্যবহার করা শুরু করলো। এরমধ্যে ভিআইপি লাউঞ্জে আরও কয়েকজন বড় ভাই ঢুকে পড়েছে। নিরাপত্তা কর্মকর্তা অসহায়ভাবে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কিছুই করতে পারলো না। অন্য আর একটি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি ঢাকার ফ্লাইটের জন্য। এরমধ্যে একজন উঠতি রাজনৈতিক নেতা ঢুকলেন, সঙ্গে ডজনখানেক বড় ভাই। এমনটি চললে কীভাবে বিমানবন্দর বা বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? শাহজালাল বিমানবন্দরে কিছু আন্তর্জাতিক যাত্রী নামিয়ে দিয়ে স্থানীয় কিছু যাত্রী নিয়ে সিলেট বা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বিমান ছাড়ার মতো কর্মকাণ্ড কখনও উন্নত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। শুরু করতে হবে যাত্রী নয় এমন সব বড় ভাইদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন মনে হয় তারা দীর্ঘ সময় ধরে একই স্থানে কাজ করেন। এটাও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। বিশেষ করে যারা স্ক্যানার মেশিনের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাদের দৃষ্টি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যাকে বলে ফ্যাটিগ। এদের নিয়মিত বিরতি দিয়ে স্থান পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অনেকে নির্বোধের মতো প্রশ্ন করেন পলাশকে কেন হত্যা করা হলো। এটি মনে রাখতে হবে, ওই দিনের উদ্ধার পর্বে ছিল নৌ আর সেনা বাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা, পুলিশ নয়, সেই প্রশিক্ষণও পুলিশের নেই। কমান্ডোরা উদ্ধার অভিযানে সাধারণত কাউকে বন্দি করে না। তাদের কাজ হচ্ছে জিম্মিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রথমেই জিম্মিকারীকে (হাইজ্যাকার) হত্যা করা। বিশ্বে বিমান ছিনতাইয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, অনেক বড় বড় অভিযানে কমান্ডোরা দশ হতে বারজন পর্যন্ত জিম্মিকারীকে হত্যা করেছে। এই ব্যাপারে এযাবৎ সর্বাধিক পারদর্শিতা দেখিয়েছে জার্মানি ও ইসরায়েলের কমান্ডোরা।
২৪ তারিখের ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে সকল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শুরুটা হতে পারে বিমানবন্দরে যাত্রী নয়, এমন সব বড় ভাইদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। পিস্তলটা খেলনা ছিল নাকি আসল তা বড় প্রশ্ন নয়। বাস্তব হচ্ছে সেদিন যেভাবেই হোক শাহজালাল বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। পিস্তল-সদৃশ কোনও কিছুরই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা উচিত নয়।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক