X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অ্যাটম বোমার শহর!

আমীন আল রশীদ
০২ মার্চ ২০১৯, ১৪:৩৪আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৯, ১৪:৩৯

আমীন আল রশীদ পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ আগুনে হতাহতের পরে দুটি শব্দ নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। একটি ‘কেমিক্যালের গোডাউন’ এবং অন্যটি ‘গ্যাস সিলিন্ডার’।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে বলছেন যে, তার কাছেও মনে হয়েছে চকবাজারের চুরিহাট্টায় পিকআপের ওপরে যে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ছিল, বিস্ফোরণটা প্রথমে ওখানেই হয়েছে। সেখান থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। তারপর সরাসরি ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলার বডি স্প্রের গোডাউনে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দাহ্য পদার্থ ছিল। এর কারণে আগুনের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়। বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম অবশ্য বলছেন, তিনটি কারণে আগুন লাগতে পারে বলে তাদের ধারণা ৷ এগুলো হচ্ছে- ট্রান্সফরমার, গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা কেমিক্যাল বিস্ফোরণ।
এই ঘটনার পরে যানবাহন ও বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের ঝুঁকিও সামনে আসছে। এরকমটিও বলা হচ্ছে যে, ঢাকা শহরে যে বিপুল পরিমাণ যানবাহনে সিএনজিতে চলে, তার অধিকাংশই রিটেস্ট বা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। অনেকগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে ট্রাফিক জ্যামের ভেতরে যখন শত শত যানবাহন অপেক্ষা করে তখন এর কোনও সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ হলে সেটি মুহূর্তে অসংখ্য গাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে এবং একসাথে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটবে। কিন্তু রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনও ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি। বরং যেটা হয় তা হলো সিলিন্ডারের মাথায় একটা রেগুলেটর থাকে। ওটা নিম্নমানের হলে নানা সমস্যা হয়।’ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন প্রাইভেট কারসহ কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) চালিত যানবাহনের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি।

কিন্তু গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের খবর আসে। এর পেছনে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো নিয়মিত পরীক্ষা না করানোকেই দায়ী করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যে, বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে ‘শক্তিশালী বোমা’র সঙ্গেও তুলনা করেন। আর এ কারণে যানবাহনে সিএনজি বা কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস ব্যবহারের বিপক্ষে খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও। তিনি মনে করেন, এখন থেকেই সিএনজির বিকল্প ভাবতে হবে।

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দাবি, কেমিক্যাল মানেই সেটি দাহ্য বা অতি দাহ্য নয়। কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন মাসুদ আমাকে বলেছেন, পুরান ঢাকায় এখন কোনও দাহ্য কেমিক্যালের গোডাউন নেই এবং সরকারের তরফে এর কোনও লাইসেন্স দেওয়া হয় না। তারপরও তারা নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে গোডাউন তৈরি করেছেন। ২০১০ সালের জুনে নিমতলী ট্র্যাজেডির পরে পুরান ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ৯ বছরেও সেই সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। এর জন্য অবশ্য পরস্পরকে দায়ী করছেন সাবেক দুই শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও দিলীপ বড়ুয়া। তবে দায় যারই হোক, বাস্তবতা হলো, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরানো বেশ কঠিন। কারণ এখান থেকে সব গোডাউন সরিয়ে ফেলা হলে ব্যবসায়ী বা দোকানদারদেরও সরাতে হবে। রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে কাঁচাবাজার সরানোর কথা শোনা যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু সরানো যাচ্ছে না। কারণ এখান থেকে পাইকারি বাজার সরানো হলে খুচরা বাজারও সরাতে হবে। কারণ পরস্পর নির্ভরশীল। ধরা যাক, একজন মাংস বিক্রেতা তার গরুটি রাখলেন মোহাম্মদপুরে। কিন্তু তাকে বলা হলো মিরপুরে গিয়ে দোকানদারি করতে। তিনি প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে গরু জবাই করে মিরপুরে গিয়ে মাংস বিক্রি করবেন, এটা খুব কঠিন। একইভাবে পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যালের গোডাউন সরানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে যারা কেমিক্যালের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা করেন, তাদের কথাও ভাবতে হবে। সেটি খুব সহজ নয়।

তবে এও ঠিক যে, কেমিক্যাল কতটা দাহ্য কিংবা দাহ্য নয়, তার চেয়ে বড় তর্ক আবাসিক এলাকায়, এবং পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউন থাকা মানে সেখানে প্রতিদিনিই মৃত্যুর ঝুঁকি। 

বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদে বলা হচ্ছে, ঢাকায় দুই হাজার ব্যবসায়ী কেমিক্যাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, যারা আট শতাধিক ধরনের কেমিক্যাল বিক্রি করেন। ক্যামিক্যাল গোডাউনের পাশাপাশি অন্তত ৪০০ প্লাস্টিক কারখানা এবং হাজারেরও বেশি প্লাস্টিক দ্রব্যের গোডাউন রয়েছে এখানে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, গ্যাস লাইন, ওয়াসার লাইনগুলোও বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে অনেকে এই পুরো এলাকাকে ‘মৃত্যুকূপ’ বলে অভিহিত করেন। তবে শুধু এই পুরান ঢাকাই নয়, পুরো রাজধানীই একটি অ্যাটম বোমার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়।

ঢাকায় যারা থাকেন, একটা বড় অংশই ভাড়াটিয়া। অনেকে রসিকতা নিজেদের শরণার্থীও বলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সাত লাখের মতো মানুষের বাস, যা ঢাকার যেকোনও একটি বড় এলাকা যেমন মিরপুর, মোহাম্মদপুর বা তেজগাঁওয়ে যে পরিমাণ মানুষ থাকেন, তার চেয়েও অনেক কম। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের পেটের ভেতরে বাংলাদেশের মতো প্রায় একশো দেশ ঢুকিয়ে রাখা যাবে। অর্থাৎ একদিকে ঘনবসতির দেশ এবং অন্যদিকে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে পুরো বাংলাদেশ ঢুকে গেছে ঢাকার পেটে। এখন ঢাকাই বাংলাদেশ। একটি শহর কত চাপ নেবে? চারশো বছর পরেও একটি শহর নির্মাণাধীন। সারা বছরই এই মহানগরীজুড়ে দালান উঠতে থাকে। সরকারের উন্নয়ন কাজ শেষই হয় না। একটা শহর কত বছর ধরে গড়ে উঠবে। একটা সময় পরে তো তাকে থামতে হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই শহরের গড়ে ওঠা বোধ হয় কোনোদিনই থামবে না।

আমাদের প্রতিবেশী কলকাতা শহরের পুরনো অংশের রাস্তাঘাটও সরু, অসংখ্য পুরনো জরাজীর্ণ ভবন, কিন্তু তারপরও সেখানের মানুষ পুরান ঢাকার মানুষের মতো এতটা ঝুঁকিতে নেই। কারণ সেখানে আবাসিক ভবনে তো বটেই, আবাসিক এলাকার ধারেকাছেও কোনও কেমিক্যালের গোডাউন নেই। দ্বিতীয়ত কলকাতা শহরের রাস্তায় অলি-গলিতে একটু পরপরই হাইড্র্যান্ড (পানির কল) চোখে পড়ে। ফলে কোথাও কোনও কারণে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগে স্থানীয়রাই আগুনের ব্যাপকতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম। কিন্তু পুরানা ঢাকায় হাইড্র্যান্ট বলে কিছু নেই। পানির উৎস হাতের নাগালে না থাকলে ফায়ার সার্ভিস তার গাড়িতে মজুদ পানি দিয়ে কতক্ষণ আগুন নেভাবে?

প্রাকৃতিক গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ঢাকার নাগরিকরা। তারা যে দামে মাসব্যাপী অফুরন্ত গ্যাস পান এবং এই প্রাকৃতিক সম্পদের যেভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করেন, সেটি অবিশ্বাস্য।  যদিও ইদানীং মেট্রোরেলের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যেই গ্যাস সংকট তীব্র হয়। কিন্তু তারপরও আবাসিক এলাকায় পাইপ লাইনে এত কম দামে গ্যাস পৃথিবীর খুব দেশের মানুষই পায় বলে মনে হয়। সমস্যা হলো, বাসাবাড়ি ও কলকারাখায় এই গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন নেওয়া হয়েছে মাটির তলদেশ থেকে। এবং সেই একই জায়গায় ওয়াসার পানির লাইন, একই জায়গায় টিএন্ডটির টেলিফোন লাইন। ফলে কিছুদিন পরপরই এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থা তাদের বিবিধ উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে থাকে। ফলে কখন কোথাও গ্যাস লাইনে লিকে হচ্ছে তা বোঝাও মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই এরকম আশঙ্কা করছেন যে, ঢাকার মধুপুর ফল্টে যদি ৫ বা ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকা শহরে ‘গজব’ নেমে আসবে। ভবন ধসে যত না মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে আগুনে পুড়ে। কারণ ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইনের কোথাও একটু আগুনের স্পর্শ পেলে পুরো শহরে দোজখ নেমে আসবে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সামর্থ্য ফায়ার সার্ভিসেরও নেই। 

অপরিকল্পিত, অবিবেচনাপ্রসূত এবং সমন্বয়হীন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নিয়ম মেনে ভবন তৈরি না করাও ঢাকা শহরকে অ্যাটম বোমায় পরিণত করেছে। কিন্তু এই অনিয়মের জঞ্জাল একদিনে তৈরি হয়নি। ফলে মাঝেমধ্যে নিমতলী আর চকবাজার আমাদের কানে কষে চড় দিয়ে গেলেও, কিছুদিন পরে সেই চড়ের কথা আমরা ভুলে যাই এবং যথারীতি আরেকটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা করি।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ