X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবারই হোক ৮ মার্চের চেতনা ধারণের প্রথম জায়গা

জোবাইদা নাসরীন
০৮ মার্চ ২০১৯, ১৫:১৮আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৯, ১৩:৫৫


জোবাইদা নাসরীন ‘সমান ভাবো, পরিপাটি করে নিজেকে গড়ো, বদলে দেওয়ার উপায় উদ্ভাবন করো’–এই  স্লোগান সামনে রেখে পালিত হচ্ছে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস। একটা সময় ছিল যখন পরিবারে জন্মের পর থেকেই লৈঙ্গিক রাজনীতির মধ্যে সন্তানকে বড় করা হতো। অর্থাৎ পরিবারেই একটি শিশুকে শেখানো হয় সে ছেলে না মেয়ে। জন্মগ্রহণ করার পর থেকে  গোলাপি হয়ে পড়ে নারীর রঙ, বিপরীতে ছেলেদের হয় নীল। শিশুরা কোনও ক্ষেত্রেই এ ধরনের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না।  আমরা এও জানি যে গোলাপি রঙ ছিল ছেলেদের এবং নীল ছিল মেয়েদের রঙ। কীভাবে বছর পঞ্চাশের মধ্যে এর প্রতীকী উপস্থাপন পুরোপুরি ভিন্ন হয়ে গেলো সেই বিষয় আমরা বিশ্লেষণ করি না। মেয়ে শিশুকে বার্বি পুতুল আর ছেলে শিশুকে গাড়ি দিয়ে লিঙ্গীয় জগতে প্রবেশ করানোই ছিল একভাবে প্রবল। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় জানা যায় ছেলে এবং মেয়েরা ছোট বয়সে একইভাবে কান্না করে। পাঁচ বছর বয়সে ছেলে সন্তানরা এই তথ্য পায় যে তাদের রাগ আদৃত হবে কিন্তু তারা তাদের নাজুকতাজনিত অনুভূতি প্রকাশ একেবারেই করতে পারবে না। এবং এটি মেয়েলি বিষয়।

আমাদের মেয়েদের সংবেদনশীল হতে ইঙ্গিত দিই কিন্তু বিপরীতে ছেলেকে রোবোটিক আশা করি। আমরা কথায় কথায় বলি ছেলেটি মেয়েদের থেকেও মনের দিক থেকে নরম কিংবা মেয়েদের মতো কথায় কথায় কাঁদে। নরমের উপমা হয়ে ওঠে নারীর মন। বর্তমানে এই ধারণায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে।

সনাতনের বাইরে পরিবর্তিত মূল্যবোধ থেকেই আমরা মেয়েদের চিরায়ত বিষয়ের বিরুদ্ধে তাদের সফল করতে শেখাই। এখন সচেতন অভিভাবকেরা বাচ্চাকাল থেকেই একজন মেয়েশিশুকে ‘খারাপ স্পর্শ’, ‘ভালো স্পর্শ’ এগুলো সম্পর্কে ধারাণা দেন এবং যৌন হয়রানি এবং  অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণের বিষয়ে সচেতন করেন। এর পাশাপাশি ক্যারিয়ার নির্বাচনে কিংবা লিঙ্গের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনে আমরা বর্তমানে নারীদের পছন্দের প্রথাগত বাইরের অনেক ধরনকেও জায়গা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা করা হচ্ছে পুরুষের পৃথিবী সীমিত রেখেই। অন্যদিকে নারী সুলভতার প্রতি পুরুষের আগ্রহকে অনুৎসাহিত করা হয় এবং তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় পুরুষের নারী সুলভতা কাঙ্ক্ষিত নয়। যে কারণে নারীর শার্ট প্যান্ট পরাটাকে অনেক জায়গাতেই ইতিবাচকে হিসেবে গ্রহণ করা হলেও পুরুষের নারীর পোশাকে পরাটাকে কেউ হাল ফ্যাশন হিসেবে নেওয়ার চিন্তা করে না। যার কারণে নারীরা গোলাপি রঙ শুধু নয়, সব রঙের পোশাক গ্রহণ করলেও খুব কম ছেলে ‘গোলাপি পোশাক পরেন। কারণ, গোলাপি এখনও সমাজের কাছে ‘মেয়েলি’ রঙ।  নারী শুধু সন্তান ধারণ করবে আর পুরুষ অন্য সকল সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে- প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতির এই প্রথাবদ্ধ চর্চাকে বর্তমানের নারীরা চ্যালেঞ্জ করছে নিশ্চিতভাবেই। সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে অভিভাবকরা একজন মেয়েকে নিয়ে ফুটবল খেলোয়াড় কিংবা ভালো সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন, কিন্তু কোনোভাবেই  একজন পুরুষকে নার্স হিসেবে দেখতে চায় না। কারণ, এটি মেয়েসুলভ চাকরি বলে। যার কারণে নারী নার্সের তুলনায় বাংলাদেশে এখন পুরুষ নার্সের সংখ্যা খুব কম।

একজন নারীর পাইলট হিসেবে ক্যারিয়ার তৈরিকে আমরা যেভাবে চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে উপস্থাপন করি সেই হিসেবে একজন পুরুষের কাঁথা সেলাই করাকে চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে দেখতে চায় না সমাজ। চ্যালেঞ্জ কিন্তু উভয়ের জন্য সমান। সমাজ একটি মেয়েকে এবং ছেলেকে যে যে পেশায় দেখতে চায় তার বিপরীতে কেউ যদি পেশা গ্রহণ করে তার জন্য সেটাই চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পুরুষের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কখনও পত্রিকায় কিংবা অন্যান্য মিডিয়ায় আসে না। যে কারণে একটি মেয়ের এবং তার সমপর্যায়ে কিংবা প্রথাগত ‘নারীত্ব’ থেকে বের হয়ে আসা (যেমন- মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরা, ছোট চুল রাখা) কিংবা  এবং সেটিকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমরা যেভাবে লিঙ্গীয় সমতাকে মাপি, আসলে ঘটনা ঘটে একেবারেই বিপরীত। তবে এ কথা আরও দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে যদি আমরা সত্যিকারভাবেই সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে চাই, তাহলে ছেলেদের আরও অনেক পছন্দের তালিকা দেওয়া দরকার। একথা মনে রাখা দরকার, পুরুষের পৃথিবী পরিবর্তন না করে নারীর ভূমিকা কখনও বাড়ানো যাবে না।

নিজে এবং অন্যের যত্ন নেওয়ার কাজে পুরুষদের যুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘নারীরা সুপার ওমেন’ এই জাতীয় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নারীর প্রশংসা হয়, নারীর ক্ষমতার স্তুতি হয় মাত্র কিন্তু এটি একভাবে নতুন ঢংকে উসকে দেওয়া লিঙ্গীয় অসমতাকেই জিইয়ে রাখে। পুরুষের মধ্যে সহমর্মিতা এবং সযত্ন কাজের আগ্রহ তাকে নারী করে তোলার চেয়ে মানুষ হিসেবে তৈরি করবে। ছেলেদের এই বিষয় এরকম বলা মানে এই নয় যে এটি শুধু ছেলেদের বলা। এটি লৈঙ্গিক পার্থক্য ঘোচাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছেলেদের শেখাতে হবে তাদের আবেগ লুকানো নয়, তাদের কীভাবে পরিবারের যত্ন নিতে হবে, তাদের কীভাবে এগুলোকে অমান্য করতে কঠোর হতে হয় সেটিও জানাতে হবে। তাদেরকে তাদের আগ্রহ এবং উৎসাহের প্রতি ধৈর্যশীল হওয়া শেখাতে হবে।

বর্তমান অর্থনীতিকে বলা হয় গোলাপি অর্থনীতি। এই গোলাপি অর্থনীতির মূল জায়গা হলো সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং যত্ন, যা হয়তো সনাতনভাবেই নারীর কাছ থেকেই আশা করা হয়। আর এই তিন গুণ ছাড়া এখন আর শিল্প কারখানায় দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। যার ফলে এই গোলাপি অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা। আমরা স্কুল পরীক্ষায় ছেলেদের অকৃতকার্যতা কিংবা পিছিয়ে পড়া নিয়ে চিন্তিত হই এবং প্রতিবছর নারীরা যে শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে সেটি নিয়ে গর্ববোধ করি। কিন্তু এই রেজাল্টের কোন লিঙ্গীয় বিশ্লেষণ দাঁড় করাই না।

‘মেয়েরা স্বভাবতই শান্ত হয়’ এবং ‘ছেলেরা একটু দুষ্টু প্রকৃতির হয়’- এই মতাদর্শীয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পক্ষান্তরে ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির পৌরুষদীপ্ততাকে সমর্থন জোগায়।  ছোটবেলার দুষ্টুমির বাহবা বা মারধরের পারদর্শিতাকে আমরা সাহস হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা তাকে নিয়ে কোনও টেনশন করি না। পরিবারেই একসঙ্গে বড় হওয়া আমাদের আদরের ভাইটি ঘরের বাইরে অন্য নারীর প্রতি কী আচরণ করছে আমরা তা জানি না কিংবা জানলেও ‘আমার ভাই এটা করতে পারে না’- জাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করি। কিন্তু আমরা কখনও মনে করতে পারি না যে সে ভাইয়ের সঙ্গে তার আচরণ সংক্রান্ত বিষয়ে ছোটবেলা থেকে কোনও কথা বলেছি কিনা। পরিবারে ছেলেটিকে মতাদর্শিক আচরণ শেখানোর আমাদের এই অনভ্যস্ততাই নারীর প্রতি অসম্মান এবং ধর্ষণের ঝোঁক তৈরি করে।

পরিবারই হলো সমতার মতাদর্শ চর্চার প্রথম প্রতিষ্ঠান। সকল সন্তানকে নারীর পৃথিবী কিংবা পুরুষের পৃথিবী নয়- মানুষের পৃথিবীর সাথে কীভাবে পরিচয় করানো যায় সেটিই হওয়া দরকার প্রথম দায়িত্বের জায়গা। সেই সঙ্গে পরিবারের সাহায্যকারী নারীর শ্রমঘণ্টা, ন্যায্য মজুরিসহ সকল অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই আমরা সবচেয়ে বেশি স্মরণ করতে পারি ৮ মার্চের শিক্ষাকে, এই শ্রমজীবী নারীরাই আমাদের বাতলে দিয়েছিল সমতার পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার পথকে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 

 

/আইএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ