X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: প্রতিপাদ্যে আটকে থাকা একটি দিন

লীনা পারভীন
০৮ মার্চ ২০১৯, ১৬:৩৪আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৯, ১৭:১২





লীনা পারভীন
ঘুরেফিরে বারে বারে ঈদ আসে ঈদ চলে যায়– এটি একটি আনন্দের গান। প্রতিবছর ঘুরে ফিরে ঈদ আসে এবং টেলিভিশনে আমরা এই গানটি শুনতে পাই। তবে ঈদ আসে ঈদের মতো। আমরাও একটা দিন উৎসবের আমেজ আনার চেষ্টা করি আবার পরের দিনই ঈদের যে বার্তা সেটাকে ভুলে গিয়ে প্রতিদিনের জীবনে ঢুকে যাই। পাঠক হয়তো ভাবছেন নারী দিবসের লেখায় ঈদের আলাপ কেন। আসলে লেখাটি শুরু করেই মনে হলো গত বছরেও এই দিনটিকে স্মরণ করে আমি লিখেছিলাম। তারপর আবারও এ বছর আট মার্চ এলো এবং আমার আরেকটি লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো।

ঘুরেফিরে আবারও আট মার্চ এসেছে। আমরা সবাই জানি এ দিনটি সারা বিশ্বেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রতিবার নারী দিবসকে সামনে রেখে জাতিসংঘ একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং সবাই সে শপথকে সামনে রেখে নিজেদের কর্মসূচি সাজায়। এবারও একটি প্রতিপাদ্য আছে আর সেটি হচ্ছে ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো নারী-পুরুষ সমতার, নতুন বিশ্ব গড়ো।’
কথা হচ্ছে এই যে নারী পুরুষ সমতার বিশ্ব গড়ার আহ্বান করা হলো এই চাওয়া কি এবারই প্রথম? প্রতিবারের যে প্রতিপাদ্য থাকে সেখানে তাহলে কোন বিশ্বের কথা বলা হতো?
আমি আন্তরিকভাবে দ্বিমত করতে চাই এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে। নারী-পুরুষ সমতার বিশ্বের লড়াই চলছে যুগ যুগ ধরেই। আর এই সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ফসলই হচ্ছে আজকের নারী দিবস। নারী দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় জৈবিক পার্থক্য থাকলেও ক্ষমতার লড়াইয়ে নারী আর পুরুষের মধ্যে বাস্তবে কোনও পার্থক্যই নেই। যতটুকু পার্থক্য করা হয়েছে সে কেবল সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট।
এই যে প্রতিবছর একটি করে প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয় এর গুরুত্ব আসলে কতটা? প্রতিপাদ্য দেওয়ারইবা দরকারটা কী? নিশ্চয়ই এর পেছনে একটি উদ্দেশ্য রয়েছে আর সেটি হচ্ছে প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে একটি সামগ্রিক কর্মসূচিকে সাজানো, যার ভিত্তিতে নারীর উন্নয়ন কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আর সেজন্যই প্রতিপাদ্যকে অবহেলা করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু এই যে আমি শুরু করেছিলাম প্রতিবছর উৎসবের মতোই নারী দিবস আসে এবং একদিন ঢাকঢোল বাজিয়ে পালনের পর সেদিনটি আবার চলেও যায়। কখনোই আর ফলোআপ করা হয় না যা যা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেগুলো বাস্তবায়নে কতটা অগ্রগতি এসেছে বা আসেনি। যদি না আসে তবে কেন আসেনি।
আর সেজন্যই কেবল একটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দিবসটিকে পালনেই নারী-পুরুষের সমতা বিশ্বে কায়েম হয়ে যাবে এমনটা বিশ্বাস করার মতো বাস্তবতা অন্তত এই বাংলাদেশে এখনও হয়নি। আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, এখনও নারীর পোশাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে নারীর সুরক্ষার জন্য নারীকে সক্ষমতা অর্জনে নয় বরং নিজেকে গুটিয়ে রাখাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, ৮ মাসের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কেবল নারী পরিচয়ের কারণে। পরিসংখ্যানে না গিয়েও বলা যায়, এখনও গণপরিবহনে নারীকে নিগৃহীত হতে হচ্ছে নানাভাবে।
নারীরা অর্থনৈতিক কর্মে অংশ নিলেও অর্জিত অর্থে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেসব নারী বাইরে বেরিয়ে আসছে বা কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে, তাদের স্বাধীন মনে করার কোনও কারণ কী আছে? না, নেই। কারণ, এখনও নারী নিজের ইচ্ছায় কাজে আসতে পারছেন না। কোন ধরনের কাজ করবে সেখানেও তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে সংসারের অন্যদের মতামতের ওপর।
কয়জন নারী আছেন যারা নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারে স্বাধীনভাবে, আর সেই মতকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করছে এই সমাজ? একজন নারী যখন তার কর্মক্ষেত্রে সফলতার প্রমাণ দিয়ে উচ্চপদে আসীন হচ্ছেন সেখানেও আসে বাঁকা চোখের মত। ধরেই নেওয়া হয় এটা তার ‘নারী’ পরিচয়ের কারণেই পেয়েছে অর্থাৎ, বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেই সে এগিয়ে এসেছে। অথচ আমরা সবাই জানি এ সমাজে একজন নারীকে কতটা কষ্ট আর লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে। হ্যাঁ, আপাত অর্থে বাংলাদেশে নারীরা অনেক এগিয়েছে। প্রশাসনিক অনেক পদেই এখন নারীরা আছেন কিন্তু সেটা মোট নারীর তুলনায় কত অংশ?
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বর্তমানে ৫০, কিন্তু সেখানে কারা আসছে? কতজনকে যোগ্যতার প্রমাণ রাখার মতো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে? তারা কি তাদের এলাকার নির্বাচিত মন্ত্রী বা সাংসদের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ সহায়তা পাচ্ছেন? অভিযোগ আছে, তারা সেটা পান না। কেবল নারী বলেই অবহেলায় রাখা হয় তাদের।
এই যে এবারের প্রতিপাদ্যে সবাইকে নতুন করে নতুন বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে ভাবতে বলা হয়েছে, এই ভাবনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে বিষয়গুলো কিন্তু অন্তরালেই থেকে যাবে।
গত বছরের প্রতিপাদ্য ছিলো, ‘সময় এখন নারীর: উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম শহরে কর্ম জীবন ধারা’। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সময়টা কী আসলেই নারীর হয়েছে? নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের পরিসংখ্যান আর এর বিপরীতে অপরাধীর বিচারের সংখ্যাটিকে বিবেচনা করলেই বোঝা যায় সময়টা আসলে কতটা নারীর হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কয়টা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটাকেও ফেলে দেওয়া যাবে কেমন করে? নানা প্রতিকূলতায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা আবারও উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও নারীর জন্য তেমন কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আজও।
এমন বাস্তবতায় পুরনো প্রতিপাদ্যের কথা ভুলে আবারও নতুন করে নতুন বিশ্বের কথা ভাবতে বলা হচ্ছে। এভাবেই হয়তো বছর বছর নারী দিবস আসবে, প্রতিপাদ্য নির্ধারণ হবে, দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হবে, কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব আর আসবে না। তাই কেবল প্রতিপাদ্যেই যেন নারী দিবসকে আমরা আটকে না রাখি সেদিকটা মাথায় রেখেই পালন করা দরকার। নারীর জন্য বিশ্ব গড়তে হলে দরকার নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠা আর সমাজকে নারীবান্ধব করতে সবাইকে যুক্ত করা।

লেখক: কলামিস্ট

 

/আইএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ