X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণতন্ত্রের স্পেস সংকট!

প্রভাষ আমিন
১০ মার্চ ২০১৯, ১৩:৪৮আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৯, ১৪:১৭

প্রভাষ আমিন বাংলাদেশের ইতিহাসে, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রাশেদ খান মেনন ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ছাত্র রাজনীতি শেষেও তিনি একনিষ্ঠতায় সমাজতন্ত্রের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যেমন ডিগবাজি বিশারদ, তেমনটি তিনি নন। প্রায় তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলেও রাশেদ খান মেনন সমাজতন্ত্রের হাল ছাড়েননি। অবশ্য তার দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি মস্কোপন্থী নয়, পিকিংপন্থী। আমি কখনও তার দলের সমর্থক ছিলাম না। তবে জীবনজুড়ে একজন রাজনীতিবিদ একটি আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, এটাই তাকে শ্রদ্ধা করার জন্য যথেষ্ট। ভোট যতই থাক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাশেদ খান মেননের নামটি সবসময়ই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। নব্বই দশকের শুরুতে তোপখানার অফিসের সামনে একবার ভয়ঙ্কর হামলার শিকার হয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি।

রাশেদ খান মেনন এখনও ওয়ার্কার্স পার্টিতেই আছেন। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলে থাকার সুবাদে মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছেন। গত দুই মেয়াদে ১৪ দলের রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, দিলীপ বড়ুয়া, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রিসভায় থাকলেও এবার ১৪ দলের কেউ নেই। বরং নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের শরিকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছেন। এখানেই আফসোস মেনন ভাইদের।

গত সপ্তাহে তিনি সংসদে বেশ কিছু কথা বলেছেন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বৈষম্য, আর্থিক খাতে লুটপাট, দুর্নীতি– সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। মেনন ভাই যা বলেছেন, সব আমার মনের কথা। অনেক দিন পর দেশের কোনও রাজনীতিকের মুখে এ ধরনের চাঁছাছোলা কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেছে। সম্ভব হলে তার পুরো বক্তৃতাটাই আমি এখানে তুলে দিতাম। সেটা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে তার বক্তৃতার অংশ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। সাবেক এই মন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের শরিকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছেন। কিন্তু যদি গণতান্ত্রিক স্পেস না থাকে তাহলে কেউ সংগঠন নিয়ে, আন্দোলন নিয়ে, ভোট নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন না। সেই স্পেস তৈরি করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের আন্দোলন করে সফলতা অর্জন করেছিল, তা যেন হারিয়ে না যায়। এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণারোপ করে, তাহলে রাজনৈতিক দল কেবল নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এটা যেমন আমাদের জন্য প্রযোজ্য, তেমনই সরকারি দলের জন্যও। তাই নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’

দেখুন, তিনি নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাচনটা তার মর্যাদা হারালো কবে? সে প্রশ্নের উত্তর পরে খুঁজবো। তার আগে তার বক্তৃতাটা নিয়ে কিছু কথা বলি।
রাশেদ খান মেনন অভিযোগ করেছেন, উন্নয়ন হচ্ছে, তবে অসম বণ্টনের কারণে তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ছে, বেকারত্বও বাড়ছে, বাড়ছে অতি ধনীর সংখ্যা। অর্থনীতির ওপর লুটেরাদের আধিপত্যের অভিযোগ এনে তিনি ঋণখেলাপি, অর্থপাচার, ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, অপ্রয়োজনে ব্যাংক দেওয়ার কথা বলেছেন। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন এখন প্রাইমারি স্কুলের টিচারের দুর্নীতিকে আমলে নেয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। বেসিক ব্যাংকের সেই সাবেক চেয়ারম্যান দুদকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিষবৃক্ষ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের আপসেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন উপজেলা নির্বাচনের চলমান প্রক্রিয়া নিয়েও।
বাংলাদেশের এখনকার কোনও রাজনীতিকের এমন জাতির বিবেক হয়ে ওঠা দেখে আমি বিস্ময়ে, আনন্দে ব্যাকুল হয়ে যাই। তার বক্তৃতার প্রতিটি অভিযোগ সত্য, প্রতিটি পয়েন্ট ধরে আলাদা কলাম লেখা যায়। কিন্তু আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন জাগে মনে, এই অভিযোগগুলো তো আজ হঠাৎ করে আসমান থেকে নাজিল হয়নি। এই অভিযোগগুলো তো গত ১০ বছর না হলেও ৬/৭ বছর ধরে সত্যি। রাশেদ খান মেনন এতদিন বলেননি কেন? নাকি এতদিন চোখে মন্ত্রিত্বের ‘ঠুলি’ পরা ছিল বলে দেখতে পাননি। এখন সেই ‘ঠুলি’ সরিয়ে নেওয়াতেই তিনি সব ফকফকা দেখতে পাচ্ছেন। এখন বেরিয়ে আসছে সত্য। মন্ত্রিত্ব তাহলে মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মন্ত্রিত্ব হারালেই জাগ্রত হয় বিবেক?
অসম উন্নয়ন, ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা, অর্থপাচার, শেয়ার মার্কেট, রাঘব বোয়াল রেখে চুনোপুঁটির পেছনে দুদকের ধাওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ আজ থাক। আমরা তো অনেক দিন ধরেই এসব কথা বলছি; ক্ষমতাসীন ১৪ দলের একজন শীর্ষ নেতার নজর যে এদিকে পড়েছে, তাতেই স্বস্তি।
আজ না হয় নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা এবং গণতন্ত্রের স্পেস সঙ্কট নিয়ে কথা বলি। আগে যে প্রশ্নটা করেছিলাম, নির্বাচন যথাযথ মর্যাদা হারালো কবে? রাশেদ খান মেনন যদি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হয় নির্বাচনের মর্যাদাহানির দায় কিন্তু তাকেও নিতে হবে। এই নির্বাচনে জিতেই কিন্তু তিনি মন্ত্রী হওয়ার আশায় এমপি হয়েছিলেন। এখন নির্বাচনের মর্যাদাহানির কথা বললে তো হবে না। তখন প্রতিবাদ করেননি কেন? কেন নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়াননি? আর নির্বাচনের মর্যাদাহানি কি ৩০ ডিসেম্বরেই হয়েছে, নাকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা এবং ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের কথা তিনি ভুলে গেছেন। ২০১৪ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তিনি মন্ত্রিসভায় থেকে দেখেছেন। তখন প্রতিবাদ করেননি কেন? মন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়ে?
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন তিনি গণতান্ত্রিক স্পেস প্রসঙ্গে। আজ যখন মন্ত্রিসভায় না রেখে প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের শরিকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলছেন, তখন রাশেদ খান মেননের গণতান্ত্রিক স্পেসের কথা মনে পড়লো। কিন্তু গণতান্ত্রিক স্পেস কি শুধু ওয়ার্কার্স পার্টি বা ১৪ দলের শরিকদের লাগে, বিএনপির লাগে না? কিন্তু বছরের পর বছর যে বিরোধী দলকে কোনও স্পেস দেওয়া হচ্ছে না, বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না, কথা বলতে দেওয়া হয় না, হাজার হাজার গায়েবী মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হয়, গুম-ক্রসফায়ারের আতঙ্ক আর হাহাকার বিরোধী নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে; তখন রাশেদ খান মেননের গণতান্ত্রিক স্পেসের আকাঙ্ক্ষা কোথায় ছিল? এবার ঠাঁই না পেলেও আগের দুই সরকারেরই অংশ ছিলেন। আর গণতান্ত্রিক স্পেস নষ্ট করা এবং নির্বাচনের মর্যাদাহানিও আজ ঘটেনি। এই ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় রাশেদ খান মেননও একজন অংশীদার। তবুও দেরিতে হলেও তার বোধোদয় ঘটেছে বলে তাকে ধন্যবাদ। আশা করি তিনি এখন ১৪ দলের সভায়, সংসদে, রাজপথে নির্বাচনের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক স্পেস সৃষ্টির লড়াইটা চালিয়ে যাবেন। তবে চালিয়ে যাবেন কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি নিশ্চিত মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলে তিনি সংসদে এ কথাগুলো বলতেন না। এমনকি আজ ডাক পেলেই গণতান্ত্রিক স্পেস না দেওয়া ও নির্বাচনের মর্যাদাহানির জন্য দায়ী সরকারের মন্ত্রী হতেও তার আটকাবে না। আর মন্ত্রিসভায় ঢুকতে পারলেই আবার তার বিবেক শীতনিদ্রায় চলে যাবে। তাই কথা যতই কড়া এবং সত্য হোক, ভরসা পাই না। মনে হয় এসব বিবেক তাড়িত কথা নয়; নিছক মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বেদনা এবং পাওয়ার দরকষাকষি।
রাশেদ খান মেনন মতিঝিল এলাকার এমপি হওয়ার পর ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলে ভর্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। জানি, এগুলো বঞ্চিতদের ক্ষোভের কথা। সব শ্রদ্ধার জায়গাগুলো যদি আমরা এভাবে নষ্ট করে ফেলি, তবে দাঁড়াবো কোথায়? ভিকারুন্নিসার অভিযোগ থেকে বরং কমরেড রাশেদ খান মেনন আর কমরেড হাসানুল হক ইনুর হজ করতে যাওয়াটা অনেক বেখাপ্পা লেগেছে।
তবে রাশেদ খান মেনন যখন গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন আমার দুইটা কথা মনে হয়। রাশেদ খান মেনন কতদিন ধরে ওয়ার্কার্স পার্টির সর্বেসর্বা এটা উইকিপিডিয়ায় খুঁজেও পাইনি। আমার যতটুকু স্মৃতি, তাতে ওয়ার্কার্স পার্টি আর রাশেদ খান মেনন সমার্থক। কিন্তু এটা কি গণতন্ত্রেরও সমার্থক? একাদশ সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের একটি ভাগে পেয়েছিল ওয়ার্কার্স পার্টি। সেই আসনে এমপি হয়েছেন রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বিউটি। রাশেদ খান মেননের স্ত্রী বলে নয়, আমি জানি লুৎফুন্নেসা বিউটি যোগ্য, ধরে নিলাম সবচেয়ে যোগ্য। কিন্তু এত বড় ওয়ার্কার্স পার্টিতে কি আর কোনও যোগ্য নারী নেই?
রাশেদ খান মেনন আসলে গণতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সদর দফতর চীনে। সেখানকার একদলীয় শাসন তো আমরা দেখছি, আবার তাদের উন্নতির শিখরে ওঠাটাও দেখছি। চীনা সমাজতন্ত্রী রাশেদ খান মেননের মুখে গণতান্ত্রিক স্পেসের আবদার তাই হাস্যকর লাগে। তবে একটা বলে শেষ করি, সরকারের কাছে চেয়ে গণতান্ত্রিক স্পেস পাওয়া যায় না। স্পেস কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। বিএনপি সেটা পারেনি, ওয়ার্কার্স পার্টি নিশ্চয়ই পারবে। আগাম শুভকামনা আলহাজ কমরেড রাশেদ খান মেনন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ