X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাকসু যে বার্তা দিলো

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৩ মার্চ ২০১৯, ১৫:৪৯আপডেট : ১৩ মার্চ ২০১৯, ১৫:৪৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার একটি লাইন হলো ‘আমার সবটাই আলো আমার সবটাই অন্ধকার’। প্রায় তিন দশক পর গত ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও হল সংসদ নির্বাচন দেখে মনে হচ্ছে সবটাই আলো হতে পারতো, কিন্তু অনেকটাই অন্ধকার। দিন শেষে কিছুটা আলো ছড়িয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন। তিনি নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরকে জড়িয়ে ধরেছেন, তাকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ঘটনাবহুল এই নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে ছাত্রলীগ ছাড়া সব প্যানেল মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু এরপরও দেখা গেল, ডাকসুর প্রধান যে পদ, অর্থাৎ সহ-সভাপতি বা ভিপি, সেই পদে জিতে গেছে কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। নুর সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছেন।

যে ছাত্রলীগ নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিটি প্যানেলের সাথে দ্বিমত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছে, সেই ছাত্রলীগ এখন এই ফল মানতে চায়নি। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে তারা বলছে, এটা ছিল ‘সিন্ডিকেটের নির্বাচন’। নির্বাচন বর্জনের কারণে বাম সংগঠনসহ সব নেতাদের দিনভর সমালোচনা করে ছাত্রলীগ নেতারা বলছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তারাই আবার ভোর রাতে ফলাফল দেখে উল্টে গেলেন। ফলে বলা চলে কোনও প্যানেলই এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলেনি।

যেভাবে নির্বাচনটি হয়েছে তাতে নানা হতাশার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। ছাত্রলীগ ছাড়া সব প্যানেলের আপত্তি উপেক্ষা করে ব্যালট বাক্স স্বচ্ছ রাখা হয়নি, ব্যাল্ট বাক্স রাতে হলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ভোট গ্রহণের সময় সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত সীমিত রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভোটের দিন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে, রোকেয়া হলে ব্যালটে সিল মারা বস্তা উদ্ধার বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুচির সাথে যায় না। শিক্ষকরা ছাত্রলীগ ছাড়া আর কারও কোনও কথাই শোনেননি, তারা সব করেছেন একগুঁয়েমি বজায় রেখে। সময় শেষে ফলাফল দাঁড়ালো– প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা বলছেন তিনি বিব্রত, আর নিজেদের দলীয় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছে ছাত্রলীগ।

বলতেই হচ্ছে, এখন হয়তো আবার সেই বিতর্কটি সামনে চলে আসবে- ‘ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত কিনা’ বা ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন চিরকালের জন্য বন্ধ করা যায় কিনা’। এই অকিঞ্চিৎকর প্রশ্নাবলির আবর্তে মগ্ন থাকবো আমরা, ছাত্র মানসিকতা, ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন নিয়ে ভ্রান্তিতেও কমবেশি আচ্ছন্ন থাকবো আমরা। ছাত্র আন্দোলন ছাত্রদেরই আন্দোলন– সেটা আর নেই। এখন ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা প্রান্তিক, দেশব্যাপী দখলের রাজনীতির দাপটে সামগ্রিক ছাত্র রাজনীতির অবস্থা নিতান্ত করুণ। আর এতে করে শিক্ষায়তনে হিংসা আর জিঘাংসার বিস্তার।

ছাত্রদের রয়েছে তীব্র আবেগ, তীব্র ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আদর্শনিষ্ঠ চারিত্রিক সততা। আমাদের কাঠামোবদ্ধ ছাত্র রাজনীতি ও এর মুরুব্বিরা এটি বুঝতে ভুল করেন। ভুল করেন বলেই ছাত্রদের হলে ছলে বা বলে ফলাফল বাগানো গেলেও ছাত্রী হলে পারা যায় না। মাঝপথে ভোট বর্জনের পরও অরাজনৈতিক স্বতন্ত্র জোটের ফলাফল আমাদের বিস্মিত করে। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এই ছাত্র রাজনীতি আর মানছে না সাবধানী, অতি সতর্ক ও পরিণামদর্শী সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা প্রতিক্রিয়াশীল নয়, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নয়। প্রগতির স্বার্থেই তারা ভোটাধিকার হরণ করার বিরুদ্ধ সজাগ থেকেছে। তারা ছাত্র রাজনীতি চায়, কিন্তু দলীয় রাজনীতির ক্রীড়নক হতে চায় না। আমাদের বড়রা, অর্থাৎ জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ছাত্রদের ওপরে আস্থা রাখতে পারেননি। আরেকবার প্রমাণিত হলো ছাত্ররা স্বভাবতই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, কর্তৃত্ববিরোধী, স্তাবকতাবিরোধী।

সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ প্যানেল থেকে নির্বাচিত সহ-সভাপতি নুরুল হক নুর শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত, এমন একটি প্রচারণা আছে। নুর নিজে দাবি করেন তিনি ২০১৩ পর্যন্ত ছাত্রলীগের মহসিন হল শাখার নেতা ছিলেন। এরপরও যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে শিবিরের রাজনীতিই করে, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বড় ব্যর্থতা আছে। ছাত্রলীগ নেতাদের ভাবনায় আসা উচিত, দশ বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে তারা আসলে কি রাজনীতি করেছে যে, একজন শিবিরের নেতাকে শিক্ষার্থীরা জিতিয়ে দেয়? তারা আসলে এই দশটি বছর ক্ষমতার চর্চা করেছে, রাজনীতি করেনি। ক্যাম্পাসে, রাজপথে ছাত্রছাত্রীরা যে মিছিল করেছে, মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগ তাকিয়ে দেখেছে আর তিরস্কার করেছে, ওদের বুঝতে চেষ্টা করেনি। দশ বছর ধরে ছাত্রলীগ এক ধরনের ‘এলিটিজম’ চর্চা করেছে যে তারা ক্ষমতাসীন। এই আভিজাত্যকে ভেঙে ক্যাম্পাস ডেমোক্র্যাসির লড়াইয়ে সাধারণ ছাত্ররা জানান দিলো তারা ঐক্যবদ্ধ।

ছাত্রলীগের নিজস্ব সাংগঠনিক একটা সক্ষমতা আছে। সেটা প্রমাণিত। কিন্তু এই ডাকসু নির্বাচন বড় বার্তা দিয়ে গেলো বামপন্থীদের। ভালো বক্তা, ভালো ভালো কথা– কোনও কিছুই কোনও প্রভাব রাখলো না। তারা জ্ঞানীদের মতো কথা বলেছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছতে পারেনি। ছাত্রলীগ এবং বামেরা যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস, ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করতো ঠিকমত, তাহলে ক্যাম্পাসে মৌলবাদী শিবির নেতা এতো ভোট পেতো না। শিবিরের এই বিজয়ের দায় ছাত্রলীগের এবং বামদের।

ছাত্রলীগ এবং বাম সংগঠনের নেতারা নির্বাচনের দোষত্রুটি অনেক বের করতে পারবেন। কিন্তু এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘এসেন্স’ বা মূল বিষয়টা দেখার চেষ্টা তারা করবেন কিনা জানি না। একটা সময় মতাদর্শই ছিল ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতির জিয়নকাঠি। যখনই মতাদর্শ নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, ছাত্রসমাজ উদ্বেল হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, কৃষি বিপ্লবের স্বপ্ন, দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার স্বপ্ন তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এখন ছাত্র সমাজের সামনে স্বপ্নটা কী? শাসক দলের নেতারা বুঝতে চেষ্টা করুন- ট্রেড ইউনিয়ন লজিকে ছাত্র রাজনীতি চলে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক অধিকার প্রকৃত অধিকার, বাকি সব এলেবেলে– এই ভাবনা থেকে ছাত্রলীগ বের হয়ে আসুক। শুধু উন্নত দেশের স্বপ্ন নয়, আদর্শগত ভাবনা এবং একটা উন্নত সমাজের স্বপ্ন ছড়াতে না পারলে আরও বড় আকারে মৌলবাদের আগমন ঘটবে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/আইএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ