X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে শহরকে কেউ নিজের মনে করে না

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২০ মার্চ ২০১৯, ১৫:৩৪আপডেট : ২০ মার্চ ২০১৯, ১৫:৩৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়ছে ঘোষণা দিয়েই। তাদের বিরক্তি এই রাজধানী ঢাকা। এই শহরের অচলাবস্থা, এর কদর্য রূপ আর সহ্য হচ্ছে না। এমনটা বলে অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। যে শহরে ভালো পরিবহন ব্যবস্থা নেই, যে শহরে ঘর থেকে কোনও কাজে বের হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ না করতে না পেরে ঘরে ফিরতে হয়, যেখানে শিশুরা বড় হচ্ছে খেলার মাঠের অভাবে, যে শহরে চিকিৎসা ও শিক্ষার পর্যাপ্ততা নেই সেই শহর ছেড়ে যেতে চাইবে মানুষ এটাই স্বাভাবিক। নীতি, নৈতিকতার নানাদিক আলোচনায় নাইবা আনলাম। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা দেশের বাইরে গিয়ে যারা থাকবে তাদের করুণা করবে। কিন্তু যাদের উপায় নেই, তাদের তো এই জঞ্জালকে সঙ্গী করেই জীবন পাড়ি দিতে হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহর ঢাকা। নিজেও শহরের মতো বেড়ে উঠলো না, তার ছায়ায় অন্য শহরও বেড়ে উঠতে পারেনি। রাজধানী ঢাকার নগরায়ণ হয়েছে অতি দ্রুততার সঙ্গে, পরিকল্পনাহীনভাবে। যখন যা ইচ্ছে তা-ই করা হয়েছে এখানে। একটি দেশ বা অঞ্চলে শহরের কাঠামো হওয়া উচিত পিরামিডের মতো— বড় শহরের সংখ্যা কম হবে, ছোট শহর থাকবে সংখ্যায় অনেক বেশি। আর সেই ছোট শহরগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যাও বড় শহরের তুলনায় বেশি হবে। এ দেশে হয়েছে ঠিক তার বিপরীত।

ঢাকা শহরে কত লোক থাকে, কত লোক এখানে প্রতিদিন প্রবেশ করে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আন্দাজ করে সবাই বলে এটি একটি দুই কোটি মানুষের শহর। বাংলাদেশের সমান বা তার চেয়ে বড় দেশ আছে, যাদের পুরো জনসংখ্যাও এতো না।

শিল্প সাহিত্যচর্চা যারা করেন তাদের লেখায়, সৃষ্টিতে যে শহরে তারা থাকেন, তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশিত হতে দেখা যায় নানাভাবে। আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের রাজধানী ঢাকা নিয়ে এমন কথা আজকাল চোখে পড়ে না। হয়তো একসময় ছিল, কিন্তু এখন খুব কমই কেউ বলবে, ঢাকার কোনও কোনও স্থানের কথা উল্লেখ করে লিখবে, এই শহরকে ভালোবেসে, এই শহরের সুর, ধ্বনি নিয়ে কত পথ হেঁটে বেড়ানো যায়।

এই শহরও একসময় সুন্দর আর গোছানো ছিল। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে সে। নব্বইয়ের দশকে হুড়মুড়িয়ে বদলে যেতে থাকলো ঢাকা। একে একে একতলা দোতলা বাড়িগুলো ভেঙে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকল বহুতল, যার নাম হলো অ্যাপার্টমেন্ট সংস্কৃতি। ভূমিদস্যুরা পানি প্রবাহের সব জায়গা দখল করে, ভরাট করে আমাদের জন্য বানাতে লাগলো ফ্ল্যাট। বড় ক্ষমতাধররা নিতে শুরু করলো পানির দরে প্লট নামের সোনার খনি। বাস্তুহারা হতে থাকলো বহু যুগ ধরে বাস করা মানুষগুলো। তারা কোথায় যায় কেউ জানে না। শহর ছড়িয়ে গেছে একদিকে গাজীপুর, অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু এটিকে আর শহর বলা যায় না।

ঢাকা এখন মশার শহর, এমনকি বিমানবন্দরের মশার কারণে মাঝে মাঝে প্লেন উড়াল দিতে বিলম্ব করতে হয়। ঢাকা যানজটের শহর, ঢাকা জলজটের শহর, রোগের শহর, বাস নামের দানবের শহর, দূষণের শহর। এই লেখা যখন লিখছি তখনই খবর এলো বারিধারার কাছে নর্দ্দায় বাসচাপায় বাংলাদেশ প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জীবন দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে যেখানে শহরের পরিসরের অন্তত ৩০ শতাংশ রাস্তা হওয়া প্রয়োজন, ঢাকায় সেখানে মাত্র আট শতাংশ। শহরের প্রায় সব ফুটপাতই দখল হয়ে আছে, ফলে মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য। কাজেই, রাস্তার মাপ আরও কমেছে। অর্থাৎ, নামমাত্র রাস্তায় বহু গাড়ি একটু জায়গার জন্য আক্ষরিক অর্থেই মারামারি করছে। শহরের ট্রাফিক তাই আর গতি পায় না।

এই শহরে গণপরিবহন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। যা আছে পুরোটাই বিশৃঙ্খলা আর পরিবহন শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচার। সবাই যদি নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে যান, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান, তাহলে গণপরিবহন গুরুত্ব পাবে কী করে? এখানে একটা রাজনীতির প্রশ্ন আছে, যারা নীতিনির্ধারক, তারা কাদের বেশি গুরুত্ব দেবেন, যারা নিজেদের গাড়িতে চড়েন, নাকি পাবলিক বাসে চড়বেন? সন্দেহ নেই গাড়িওয়ালাদের প্রতি রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের বিশেষ ভালোবাসা আছে। বাসগুলো যদি চড়ার মতো হতো, যদি রেল ব্যবস্থা থাকতো, হয়তো অনেকেই নিজের গাড়ির বদলে বাসে-রেলে যাতায়াত করতেন। একজন মানুষের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি যতখানি রাস্তা দখল করে, বাস সে তুলনায় কিছুই করে না। গাড়ির বদলে অনেকে যদি বাসে চড়তেন, তাহলেই এত জট লেগে থাকতো না। দুনিয়ার বহু সভ্য শহরে তা-ই হয়। কিন্তু, ঢাকা তো অসভ্য।

এই যে একটা নগরী সভ্য হলো না, এর কারণ কী? আমি কোনও সমাধান দেওয়ার জন্য লিখছি না। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ হলো, এই শহরকে কেউ নিজের মনে করে না, own করে না। এখানে যারা রাজনৈতিক নেতা, আমলা, সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী, বড় বুদ্ধিজীবী, যাদের কথায় সব চলে, তাদের অনেকেরই উন্নত দেশের পাসপোর্ট আছে। এবং সমস্যা লুকিয়ে আছে এখানেই। এই শহরে থাকে, কিন্তু এটি তার শহর নয়। তার শহর কানাডার বেগমপাড়া, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা নিদেনপক্ষে মালয়েশিয়ার কোনও শহর। এরা এই শহরটিকে বেছে নিয়েছে আপাতত অর্থ বানানোর স্থল হিসেবে। স্বভাবটা হলো বছরে কয়েকবার বিদেশে বানানো বাড়িতে থেকে এসে, আবার এই শহরকে খুবলে খাওয়া।

যে শহরের ownership সমস্যা আছে, তার আসলে কিছু হয় না। অনেক প্রকল্প হবে শহরকে তিলোত্তমা করার জন্য, কিন্তু তা কোনোদিনই হবে না। অর্থ চলে যাবে পকেটে পকেটে, সেখান থেকে বিদেশে বিদেশে। ফলে যারা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তারা আসলে জেনে বুঝেই নিচ্ছে। তারা বুঝতে পারছেন এ শহর আর তাদের জন্য নয়। অনেক অনেক সমস্যা। তবুও যদি গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা যায়, ফুটপাত দখলমুক্ত করা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িতে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, কিছু মানুষ হয়তো  ভালোবাসার কথা ভাববে শহরটিকে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ