যশোর আমার শহর। যার বসবাস সমগ্র অস্তিত্বের সঙ্গে। সুমনের গানের মতো ‘...এই শহর জানে আমার সবকিছু, পালাতে চাই যত, সে আসে আমার পিছু পিছু।’
এই শহরের ভালো কিছু শুনলে এখনও আনন্দে আত্মহারা লাগে, দিনযাপনের মানেই পাল্টে যায় ওইদিন। বেশ কিছু দিন আগে যশোরকে নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকার পাতাজুড়ে ‘তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে টেকনোলজি পার্ক’ নামের সম্ভাবনাময় প্রতিবেদনটি দেখলাম, যেখানে ধারণা করা হয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই আইটি পার্ক প্রায় ১২ হাজার মানুষের আয়ের উৎস হবে। ভীষণ ভালো লাগলো পড়ে। বিষয়টি আরও একবার সবাইকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আজকাল জানানোর মানুষের বড় অভাব চারদিকে।
বিভিন্ন উৎসবে-পর্বে ঢাকার অলিতে গলিতে যখন ফুল বিক্রি হয় আর মানুষ ভিড় করে সেইসব ফুল কিনে ঘরে ফেরে- দেখে খুব গর্ব হয়। কারণ, কার না জানা, এই ফুলের মোট উৎপাদনের ৭০ ভাগই আসে ঝিকরগাছার গদখালি থেকে। বাহারি নকশিকাঁথা আর যশোর স্টিচের গল্প শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পেরিয়েছে আন্তর্জাতিকতাবাদের সীমানা। বাণিজ্যিকতা আর নান্দনিকতাকে কীভাবে এক করে দেখাতে হয়, তা যশোরবাসী খুব ভালো করেই জানেন। যশোর ছেড়েছি প্রায় বছর ১৫ আগে। অথচ এখনও এই শহরের খুঁটিনাটি বিষয়ও প্রবল আগ্রহ নিয়ে জানতে ইচ্ছা হয়। ঠিক একইভাবে এই শহরের যেকোনও দুঃসংবাদ অন্যদের মতো আমাকেও ভারাক্রান্ত করে। যেমন স্তব্ধ হয়েছিলাম ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায়। এই ঘটনা পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শহরের সমস্ত ফুল বিক্রেতা তাদের ফুলের দোকান বন্ধ রেখে পোস্টার টানিয়েছিল, “এ শহরে ফুল বিক্রি করতে আমাদের ঘৃণা হয়।” তখন শুধু মন খারাপই হয়নি, মনে হয়েছিল মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ না করলেই ভালো হতো। এই কাঁটা আমরা এখনও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। বিচার হয়নি কোনও কিছুরই।
কিছুদিন আগে আবার হঠাৎ শোনা গেলো যশোর-বেনাপোল সড়ক সম্প্রসারণ করতে কালের সাক্ষী মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শতবর্ষী রেইনট্রিগুলো কেটে ফেলা হবে। কাটাকাটিতে আমরা তুলনাহীন! ২৩শ’ গাছ মোটামুটি মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর আন্দোলন-সংগ্রামে যদিও গাছগুলোর সাময়িক জীবনপ্রাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে আমরা জানি না! এই নির্মম খবরটি প্রথম যখন শুনি, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু জনতার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী এসে যায়!
‘ঝাউগাছের স্বপ্নকথা’ নামে এক কবিতায় ঝাউগাছ কবিকে বলছে,‘‘কবি শুনছো, আজ সকালে কাঠুরিয়া এসেছিল আমার দরদাম ঠিক করতে। হয়তো রাতের গভীরে ঘুম ভাঙলে ওরা আমার বুকে করাত চালাবে। গতকাল তুমি আমার ছায়ায় কবিতা লিখেছিলে জাতির বুকে চেতনা জাগাবার জন্য।” আমাদের চেতনা কি কোনোদিন জাগবে না আর? মানুষের ভালো থাকার উপাদান দিনে দিনে কমে আসছে। এই ফেসবুকীয় আর ইনস্টাগ্রাম যুগের মানুষও যন্ত্রের সাময়িক আসক্তি শেষে এক টুকরো আকাশই দেখতে চায় হয়তো। কিংবা হয়তো বৃষ্টির দিনে হেঁটে যেতে যেতে গুন গুন করে গান গায়- “এসো নীপবনে, ছায়াবীথি তলে”! সেই ছায়াবীথি আর সবুজ টিকিয়ে রাখতে হলে তো বৃক্ষকে বাঁচাতে হবে দু’হাত দিয়ে। আর আমরা কেবলই ধ্বংসের উল্লাসে মাতি।
অ্যালেন গিন্সবার্গ বেঁচে থাকলে অবশ্যই কষ্ট পেতেন আজ। তিনি নিশ্চয়ই বৃক্ষবিহীন September on Jessore Road -এর কথা ভেবে লেখেননি:
Millions of babies watching the skies
Bellies swollen, with big round eyes
On Jessore Road–long bamboo huts
No place to shit but sand channel ruts
যশোর রোড ধরে যে বা যারা হাঁটেননি কখনও, এই পথের কথা শুধু গান অথবা কবিতায় শুনেছে বা ছবি দেখেছেন, তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি, শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা স্মরণ করে হলেও গাছগুলোকে বাঁচতে দিতে হবে। রাষ্ট্র চাইলে কতকিছুই তো পারে। সামান্য গাছ এরা। মুখের ভাষা নেই বলেই কি প্রতিবাদ হবে না? আমার মনে হয়, অবশ্যই প্রতিবাদ হতে হবে। বৃক্ষেরা যাতে বলতে না পারে, ‘আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বলো কাকে?’
প্রতিবাদ হবে মিছিলে মিছিলে, প্রতিবাদ হবে নীরবতায়। আর সেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল বলেই অন্তত আরও কিছুদিনের প্রাণ পেয়েছে প্রিয় বৃক্ষরাজি। আমরা চেয়েছিলাম, এই কিছুদিন হোক হাজার কোটি বছর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সারথীরা হাত ধরে হেঁটে যাক নতজানু বৃক্ষের ছায়ায়, যশোর রোডের এপার-ওপার।
লেখক : উন্নয়নকর্মী, কলাম লেখক