X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের সিনেমার জটিল অংক

রেজানুর রহমান
০৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২৭আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২৮

রেজানুর রহমান অনেকের কাছে অংকটা জটিল মনে হতে পারে। আবার কারও কারও কাছে সহজও মনে হতে পারে। তাহলে অংকটা বলেই ফেলি। এক সময় আমাদের দেশে প্রায় ১৩শ’ সিনেমা হল ছিল। পত্র-পত্রিকার বিনোদনপাতা জুড়ে থাকত সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের খবর। পরিবারের মানুষেরা দল বেঁধে যেত সিনেমা হলে। সিনেমা দেখা একটা উৎসবের মতোই ছিল। মর্নিং শো, ম্যাটিনি শো, ইভিনিং শো, নাইট শো’র পাশাপাশি স্পেশাল শো নামে শব্দগুলো অনেক পরিচিত ছিল। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দেখার জন্য অগ্রিম টিকেট কিনতে হতো। সিনেমা হলের মালিক, বিশেষ করে হলের ম্যানেজার ছিলেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কারণ তার সঙ্গে সখ্য থাকলেই ভিড় এড়িয়ে সিনেমার টিকেট কেনা সম্ভব হতো। দেশের সেই ১৩শ’ সিনেমা হলের অস্তিত্ব এখন আর নেই। টিম টিম বাতি জ্বালিয়ে সারাদেশে কোনও মতে টিকে আছে ১শ’রও কম সিনেমা হল। এবার অংকটার দিকে একটু নজর দিই। যখন দেশে ১৩শ’ সিনেমা হল ছিল তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটির মতো। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। কাজেই সিনেমা হলের সংখ্যাও তো বাড়ার কথা। কিন্তু হলসংখ্যা বাড়েনি। বরং আশঙ্কাজনক হারে সারাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমে গেছে। সিনেমা হল ভেঙে আধুনিক মার্কেট হয়েছে। কোথাও কোথাও ফ্ল্যাটবাড়িও নির্মাণ হয়েছে। এ ধরনের একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমাদের সিনেমা কি আদৌ টিকে থাকার কথা?

অনেক বছর আগের কথা। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটি ফিল্ম অ্যাপ্রেসিয়েশন কোর্সে ভর্তি হব বলে আবেদন করলাম। মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হলো। প্রথম প্রশ্ন– ধরো, তোমাকে একটা ফিল্ম বানাতে দেওয়া হলো। তুমি ফিল্মটা নির্মাণ করে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করবে... তোমার কী কী প্রয়োজন হবে? ইন্টারভিউ বোর্ডে বসেছিলেন আমাদের চলচ্চিত্র আন্দোলনের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের সামনে বসে আছি, এটাই ছিল আমার কাছে বিস্ময়। প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে নিতে পারছিলাম না। ইন্টারভিউ বোর্ডে বসা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সহজ-সরল ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দিলেন। তুমি একটি সিনেমা বানাতে চাও। তার মানে তুমি পরিচালক। সিনেমা বানানোর জন্য তোমার প্রথম দরকার একটি পাণ্ডুলিপি, অর্থাৎ একটি সুন্দর গল্প। ধরা যাক তুমি একটি সুন্দর গল্প পেয়ে গেছ। এখন প্রয়োজন হবে একটি প্রতিষ্ঠানের। অর্থাৎ ছবিটা বানানোর জন্য একজন প্রযোজক দরকার। ধরা যাক তুমি প্রযোজকও পেয়ে গেলে। এবার প্রয়োজন হবে অভিনেতা, অভিনেত্রী ও টেকনিশিয়ানদের। তাদেরকেও তুমি পেয়ে গেলে এবং এক দিন তোমার সিনেমা নির্মাণকাজও সম্পন্ন হলো। এবার তুমি সিনেমাটি রিলিজ দিতে চাও। কীভাবে সম্ভব? আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইন্টারভিউ বোর্ডের সম্মানিত সদস্যের কথা শুনছিলাম। তিনি প্রশ্ন করতেই আবার যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। উত্তরটা ঠোঁটের মধ্যে নড়াচড়া করছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার সাহস হচ্ছিল না। তিনিই আবার উত্তরটা বলে দিলেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, সিনেমা মুক্তি দেওয়ার ধাপটিই হলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এজন্য তোমার প্রয়োজন হবে সিনেমা হলের এবং অবশ্যই দর্শকের। নাটক সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শককে বলা হয় লক্ষ্মী। কারণ দর্শক টাকা দিয়ে টিকেট কিনে সিনেমাটি দেখলেই তবে প্রযোজক ভরসা পাবেন। হয়তো আরও একটি নতুন সিনেমা নির্মাণের ব্যাপারে তিনি উৎসাহী হবেন!

সেদিন এই কথাগুলোর মর্মার্থ ততটা বুঝিনি। কিন্তু আজ কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে পারছি। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই ধাপগুলো সঠিকভাবে কি পরিচর্যা পাচ্ছে? প্রথম ধাপে পরিচালক ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জরুরি। ধরা যাক এক্ষেত্রে আমাদের কোনও দৈন্যতা নেই। এর পরের ধাপে প্রয়োজন অভিনেতা, অভিনেত্রী ও টেকনিশিয়ান। তাও আমাদের আছে। ছবি বানানো হলো। কিন্তু শেষ ধাপের অবস্থা কী? সিনেমা হল কোথায়? প্রচার মাধ্যমেই দেখলাম কয়েকটি সিনেমা হল এখনও টিম টিম করে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে, সেগুলোও বন্ধ হবার পথে। হল মালিকরা হল বন্ধ করার একটি তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। পরে তথ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে এই আশ্বাসের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছি না। দেশের একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেছেন, প্রযোজক, পরিচালকদের ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে এই দেশে কোনোভাবেই চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। বদিউল আলম খোকন হল মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন, আমি আপনাকে একটা সিনেমা দেব, আপনি যদি নামমাত্র টাকা ফেরত দেন তাহলে আমি ভবিষ্যতে ভালো সিনেমা বানাব কী করে? আমার ছবি বিক্রির ন্যায্য হিস্যা তো আমাকে দিতে হবে। আপনি ১৫০ টাকার টিকেট বিক্রি করে প্রযোজককে মাত্র ৩০ টাকা ধরিয়ে দেবেন। তার মধ্যেই প্রজেক্টর ভাড়া, ব্যানার, পোস্টারের খরচ দিতে হবে। আমার পকেট থেকেই টাকা খরচ করে ছবি নির্মাণ করব, আবার আমিই ছবি চালানোর সব ব্যবস্থা করব... এভাবে তো ভালো ছবি হবে না।

জানি না বদিউল আলম খোকনের কথায় কতটা যুক্তি আছে। কিন্তু সহজ-সরলভাবে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই। কোটি টাকা খরচ করে ছবি বানাবেন প্রযোজক। অথচ হলের টিকেট বিক্রির টাকায় একটা সমতা না থাকলে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। নাম প্রকাশ করতে চাই না। আমার এক বন্ধু দীর্ঘ পাঁচ বছরের পরিশ্রম শেষে একটি ছবি বানিয়ে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন। ঢাকায় বেশ কয়েকটি হলে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু টিকেট বিক্রির ন্যায্য হিস্যা নাকি তিনি পাননি।

একটা সময় দেখতাম নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগে হল মালিকরা ছবিটি নিজ নিজ হলে মুক্তি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। ফলে হলের বুকিং মানির টাকা দিয়েই অনেক ছবির নির্মাণ ব্যয় উঠে আসত। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। আগে হলে নতুন ছবি মুক্তি দেওয়ার জন্য হল মালিকরা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পেছনে ঘুরতেন। আর এখন কষ্ট করে ছবি বানিয়ে প্রযোজক, পরিচালকরাই সিনেমা হল মালিকের পেছনে ঘোরেন। ফলে সিনেমা জগতের ‘সভ্যতা ভব্যতাও’ পাল্টে গেছে। চেইন অব কমান্ড বলে একটা কথা আছে, আমাদের সিনেমা জগতে এখন সেটা নেই বললেই চলে। সিনেমার ব্যাকরণে ডিরেক্টরকে বলা হয় ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ। অথচ আমাদের এফডিসি কেন্দ্রিক সিনেমায় তা অনেকাংশে মানা হয় না। অতীতকালে প্রযোজক এবং শিল্পীরা ছবির পরিচালকের নির্দেশনাকেই গুরুত্ব দিতেন। আর এখন প্রযোজকের পাশাপাশি জনপ্রিয় শিল্পীরাও পরিচালককে ডিকটেট করেন। আগের দিনে শিল্পীরা পরিচালকের বাসায় নিজে গিয়ে অথবা তার লোক পাঠিয়ে ছবির শিডিউল মেলাতেন। আর এখন ছবির শুটিং শিডিউল মেলানোর জন্য পরিচালককেই জনপ্রিয় শিল্পীর বাসায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। অভিজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, যেদিন থেকে পরিচালকরা শিল্পীর বাসায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে শুটিং শিডিউল মেলানো শুরু করেছেন সেদিন থেকেই মূলত আমাদের চলচ্চিত্রে ধস নামতে শুরু করে। নাটক সিনেমায় ‘কলটাইম’ বলে একটা কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতকালে বড় বড় শিল্পী আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত শুটিং করেও পরের দিন শিডিউল টাইমেই সেটে হাজির হতেন। বর্তমানকালে ‘কলটাইম’ না মানাই যেন নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। তথাকথিত নায়ক-নায়িকা কখনই কল টাইমে শুটিং এ আসেন না। পরিচালক ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার ছবির নায়ক-নায়িকার জন্য সেটে গিয়ে বসে থাকেন। ফলে ছবি নির্মাণে অনেক পরিচালক তার সবটুকু মনোযোগ দিতে পারেন না।

সবচেয়ে বড় কথা অতীতকালে আমাদের চলচ্চিত্র ছিল একটি বৃহৎ পরিবারের মতো। ভালো সিনেমার প্রযোজনে একে অপরকে সহায়তা করতেন। একজনের বিপদে অন্যজন এসে দাঁড়াতেন। বর্তমান সময়ে কেন যেন এই চিত্র পাল্টে গেছে। এবারের চলচ্চিত্র দিবসে এফডিসির অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় তারকা শাকিব খানসহ অনেকেই আসেননি। চলচ্চিত্র অঙ্গনে নীরবে বেগবান হচ্ছে বয়কট সংস্কৃতি। একপক্ষ অন্যপক্ষকে গুরুত্বই দিতে চায় না। ফলে সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও আমাদের চলচ্চিত্র মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না।

এই অস্থির সময়েও এক ঝাঁক তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন। তারা চলচ্চিত্রের মানুষের মাঝে বিভাজন দেখতে চায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ তরুণ নির্মাতাদের প্রত্যাশা, সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশের চলচ্চিত্র আবার জেগে উঠবে। এজন্য সিনেমা হলের আধুনিকায়নসহ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

এ কথা সত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দোর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের চলচ্চিত্র কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাই বলে আমাদের বসে থাকলে তো চলবে না। সিনেমা একটি দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যোগ্যতর একটি গণমাধ্যম। সময়ের বিবেচনায় এই মাধ্যমটির প্রতি আমাদের আন্তরিক মনোনিবেশ খুবই জরুরি। জয় হোক বাংলাদেশের বাংলা সিনেমার।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ