কলকাতার ৭ নম্বর যতীন বাগচী রোড। সপরিবারে নিচের তলায় ভাড়াটে সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউএসআইএস (৭ নম্বর জওহরলাল নেহরু রোড। এখন নাম ও স্থানের বদল।)-এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে, প্রায়-প্রতিবার বিকেল সন্ধ্যায় জমজমাট আড্ডা। বহু রথী-মহারথীর উপস্থিতি। শিল্পীসাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকা, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক মায় ভবঘুরেও।
এক আড্ডায় কথা উঠলো সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবি নিয়ে। নানা মুনির হরেক মতামত। অর্থনীতিবিদ-অধ্যাপক সত্যেশ চক্রবর্তী (কবি বিষ্ণু দে’র বড়ো জামাই) খাঁটি ঢাকাইয়া বাঙাল। বললেন, ‘এইটা (অশনি সংকেত) হইলো দুর্ভিক্ষের রোমান্টিক সিম্বলিক ফিলোম।’- শুনে, সশব্দে হেসে বলি, ‘সিম্বল?’
- এই কথায়, কেউ-কেউ চোখ খাটো করে, রাগমাখা কণ্ঠে জানতে চান, ‘হাসার কী আছে? কারণ কী?’
- বলতেই হয়। বলায় যে কী বিপদ, চারদিন পরে হাড়েমজ্জায় টের পাই। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় টেলিফোন করে বললেন, ‘কাল বিকেল পাঁচটায় আমার অফিসে আসবি। মানিকদার ওখানে যাবো। মানিকদা তোকে দেখতে চান, তোর সঙ্গে কথা বলতে চান।’ স্থির বিশ্বাস হয়, সত্যজিৎ রায় আগামী ছবির জন্যে নতুন নায়ক খুঁজছেন, চেহারা দেখে, কথাবার্তা শুনে নিশ্চয় নির্বাচন করবেন। অভিনয় না-জানলেও শিখিয়ে দেবেন।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেই বললেন, ‘কী রে, এত মাঞ্জা মেরে এসেছিস কেন? ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছিস মনে হচ্ছে। শুরুতেই টাস্কি খেলুম।
ট্যাক্সিতে যেতে-যেতেও সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাসা করেননি রহস্য। উত্তেজনায় কাঁপছি।
পৌঁছে গেলুম সত্যজিতের ১ নম্বর বিশপ লেফরয়েড-এর বাড়িতে। দরোজা খুললেন সত্যজিৎ রায়। দেখে বুক, হাত-পা কাঁপে (পরে অবশ্য বহুবারই গেছি, নানা অছিলায়। নিজেও ফোন করে ডেকেছেন বিভিন্ন কারণে। থাক সে সব।) চা এলো।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘ওর নামই...। ওর কাছেই বিস্তারিত শুনুন।’
সত্যজিতের প্রশ্ন: ‘তুমি নাকি আমাকে নিয়ে কী সব বলেছো সুপ্রিয়’র বাড়িতে? সুপ্রিয় বলেনি, বলেছে তোমার মুখেই শুনতে।’
-আকাশ থেকে পড়ি না, গা গতরও জখম হয় না, প্রায়-আধমরা। মৌনী। তা হলে নায়ক-টায়ক নয়, উবে গেলো আশা। স্বপ্ন কুহকিনী।
সত্যজিৎ।। বলছো না কেন?
- না, কিছু বলিনি তো।
সত্যজিত।। বলোনি? কী সুপ্রিয়...?
সুপ্রিয়।। মানিকদাকে নিয়ে ঢাকাইয়া কুট্টির সিম্বলের গল্পটা বল।
- বলা যাবে না।
সত্যজিৎ।। কেন?
- আপনাকে ‘হালা’, মানে শালা বলতে হবে।
সত্যজিৎ।। আমাকে শালা বলবে?
- কথক, ঢাকাইয়া কুট্টি বলছে, তাঁর বয়ানে ‘হালা’। জানেন ঢাকাইয়া কুট্টির বুলি ‘হালা’। ছোটবড়ো সবাইকে। অসম্মান নয়। বাপও ছেলেকে বলে ‘হালার পোলা’। ছেলেও বাপকে বলে ‘হালার বাপ’। যদি অভয় দেন, বলতে পারি। কুট্টির সম্বোধনে ‘হালা’। নিজেকেও ‘হালা’ বলে। বাংলা-হিন্দি-উর্দু-ফার্সি-ইংরেজি মিশিয়ে বলে।
সত্যজিৎ।। বলো।
- ঢাকাইয়া ভাষায় বলতে হবে। কিছু ‘ডায়লগ’ না বুঝলে জিজ্ঞেস করবেন।
সত্যজিৎ।। আচ্ছা।
সংক্ষেপে বলি। ‘পুরানা ঢাকার বক্সিবাজারের (আদি ঢাকাইয়াদের বাস) বক্সার মিয়ার বহুত ঝনঝনানি (টাকাপয়সা)। দুই ফিলোম ডাইরেকটররে তলব মারে। আইলো। বক্সার মিয়া জিগায়, ওই হালার পো’রা, ফিলোম খ্যালাছ্ (ছবি পরিচালনা), তা খ্যালা। আমারও খায়েস জাগছে, তোগো দিয়া খ্যালামু। কলকাত্তায় এক হালা, বনছলমিয়া (আর. ডি. বনসল) আছে, ওই মিয়া ছোত্যজিৎ হালারে দিয়া ছিম্বলের ফিলোম খ্যালায়। বনছল হালায় পোরডিউছার। বহুত টঙ্কা ঝাড়ে। বনছল হালায় ছোত্যজিত হালারে দিয়া ফিলোম খ্যালায়, দুনিয়ায় নাম কামাইছে। আমিও হালায় কামামু। ছোত্যজিত হালার ল্যাহান খ্যালাইতে পারোস্? দুই ডাইরেকটর।। পারুম না মানে? এমন ছিম্বল মারুম ছোত্যজিতের বাপ হালায় শ্মশান ত্যান জিন্দা হইয়া লাফাইয়া আইবো।
বক্সার মিয়া।। হালার পো হালারা হোন (শোন), স্টৌরি কমু, ফিলোমে ছিম্বল মারবি। টাল্টিবাল্টি দ্যাখাইবি না। স্টোরির কাহানি (কাহিনি) হইত্যাছে, নব্য লাবার (লাভার) রমনা পার্কে বটগাছের তলায় বইয়া (বসে) লব (প্রেম) করতাছে। এই দেইখ্যা ওল্ড লাবার নব্যর লগে ফাইট করত্যাছে। নব্য নওজোয়ান। নব্য বোলো (ব্লো) মারছে, বোলো যাইত্যাছে চক্ষে। কাট। কী ছিম্বল হইবো, কও।
দুই ডাইডেকটর এ-ছিম্বল ও-ছিম্বলের দৃশ্যে কী হইতে পারে, কয়। হুইন্যা (শুনে) বক্সার মিয়া, ‘তুমরা হালায় ছোত্যজিত হইবার পারবা না। ওল্ডের চক্ষের দিকে ওই যে বোলো যাইতাছে, দ্যাখাইবা সর্ষে খ্যাত।’
আচ্ছা সেকেন্ডটা (দ্বিতীয়) কই। নব্য-ওল্ডের আবার ফাইট। হিরোইন বুকের আঁচল খুইল্যা তিড়িংবিড়িং ড্যান্স মারতাছে,গান গাইতাছে,আমেরিকান রক মিউজিক বাজতাছে। ফাইট চলতাছে, চলতাছে। নব্যর বোলো ছুটতাছে ওল্ডের খোমার (চোয়াল) দিকে। কাট। কও কী ছিম্বল হইবো। ঠিকঠাক কইবা।
দুই ডাইরেকটরের ধানাইপানাই হুইন্যা বক্সার মিয়া, ‘ধুর হালারা, তুমরা হালারা ছোত্যজিত হালা হইবার পারবা না, আমিও হালায় বনছল হালা।
ওই যে নব্য হালার বোলো ওল্ড হালার খোমার দিকে যাইত্যাছে, দ্যাখাইবা, ওল্ড হালায় পটল তুলতাছে।’
সত্যজিৎ রায় গলা-চড়িয়ে হেসেই বিষম খান। কয়েক সেকেন্ড ঘরময় আর কোনও শব্দ নেই। সত্যজিৎ স্থিতু হন।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়।। পটল তুলল, মানে?
সত্যজিৎ রায়।। ওল্ড প্রেমিক মারা গেছে।
আচ্ছা, গল্পটি ঢাকাইয়া কুট্টির না তোমার?
বলিনি, চাঁদভাই (অভিনেতা গোলাম মুস্তফা)-য়ের গল্প।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক