X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘চার খলিফা’র ছাত্রলীগ

প্রভাষ আমিন
০৯ মে ২০১৯, ১৬:০৫আপডেট : ০৯ মে ২০১৯, ১৬:০৬

প্রভাষ আমিন কয়েক বছর আগেও পত্রিকার পাতা খুললেই ছাত্রলীগের নানা অপকর্মের বিবরণ থাকতো। হত্যা, ধর্ষণ, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল- হেন কোনও অপকর্ম নেই; ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল না। কোনও অভিযোগ উঠলেই ছাত্রলীগ প্রথমে সেটা অস্বীকার করার চেষ্টা করতো। সেটা করে সামাল দিতে না পারলে অভিযুক্ত নেতাকে বহিষ্কার করে দায়িত্ব সারতো। কিন্তু কাগজে-কলমে বহিষ্কার করলেও তারা ছাত্রলীগের সঙ্গেই থাকতো। পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা আর সিলেটের বদরুল ছাড়া আর কারও বিচারের কথাও শুনিনি। এমনকি অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত চট্টগ্রামের এক ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যারও বিচার হয়নি। কিন্তু ইদানীং পত্রিকায় ছাত্রলীগের অপকর্মের ফিরিস্তি খুব একটা থাকে না। এটা অবশ্যই ভালো খবর। ছাত্রলীগ যদি সত্যি ভালো হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো খুবই ভালো। কিন্তু আমার ধারণা এর পেছনে দারুণ একটা কৌশল কাজ করছে। কারণ দেশে এখন ছাত্রলীগই নেই। একেবারে নেই সেটা বলা ঠিক হবে না। চারজন নেতা আছেন সারাদেশে। কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এর মধ্যে গোলাম রাব্বানী ডাকসুর জিএস এবং সাদ্দাম হোসেন এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন। শোভন ভিপি পদে নির্বাচন করেও হেরে গেছেন।

গত বছরের ১১ ও ১২ মে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলন। সম্মেলনের ২ মাস ২০ দিন পর ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। তখন বলা হয়েছিল শিগগিরই ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সেই ‘শিগগিরই’ আর আসেনি। ছাত্রলীগের সম্মেলন হয় দ্বিবার্ষিক। তার মানে দুই বছর মেয়াদি কমিটির এক বছর পেরিয়ে গেছে চার সদস্যের কমিটি দিয়েই। বিএনপি যেমন ‘ঈদের পরে আন্দোলন’ করে। ছাত্রলীগও তেমনি ‘ঈদের পরে’ কমিটি ঘোষণার ফাঁদে পড়েছে।

নির্বাচনের আগে কমিটি, নির্বাচনের পরে কমিটি, ঈদের আগে কমিটি, ঈদের পরে কমিটি, ডাকসু নির্বাচনের আগে কমিটি, ডাকসু নির্বাচনের পরে কমিটি এমন নানা ধরনের অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে। কিন্তু কমিটি আসেনি। পত্রিকায় এক সপ্তাহের মধ্যে কমিটি, দুয়েক দিনের মধ্যে কমিটি- এমন অনেক খবর এসেছে। কোনোটাই সত্য হয়নি। ছাত্রলীগ চলছে চার নেতার নেতৃত্বেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রয়োজনে কমিটি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন, তারপরও কমিটি হয়নি।

গত বছরের আগস্টে চার নেতার কমিটি ঘোষণার পর দারুণ আশাবাদী হয়েছিল সবাই। কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে চার নেতার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল তারা সবাই মেধাবী, নিয়মিত ছাত্র। নিয়মিত রাজনীতির বাইরেও তারা নানা সামাজিক কাজকর্মে সক্রিয়। দায়িত্ব নিয়েই তারা ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানো, হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছিলেন। তাদের কথা শুনে বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছিল। এই সময়ে তারা নিজেদের যোগ্যতারও প্রমাণ রেখেছেন। ডাকসু নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আমার কথা হয়েছে। সব আলাপই ছিল পেশাগত। তবু তাদের কথা শুনে, ছাত্রদের প্রতি তাদের ভালোবাসা, ভালো রাজনীতি করার আকাঙ্ক্ষা দেখে ভালো লেগেছে। ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে হেরে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ কর্মীরা ফল বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরকে লাঞ্ছিত করেন। কিন্তু শোভন দারুণ নেতৃত্ব গুণের পরিচয় দিয়ে তাদের সরিয়ে নেন। নুরুল হক নুরকে জড়িয়ে ধরে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তার এই সৌহার্দ্যের আহবান দেশজুড়ে দারুণ প্রশংসিত হয়। হেরেও সাধারণ ছাত্রদের হৃদয় জিতে নেন শোভন।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত ডাকসুতে মনোনয়ন না পেলেও দারুণ দক্ষতায় নির্বাচন পরিচালনা করেন। মনোনয়ন না পাওয়ার দুঃখ বুকে চেপে তিনি জিতিয়ে আনেন সংগঠনের নেতাদের। গোলাম রাব্বানী আর সাদ্দাম হোসেন তো বিপুল ভোটে জিতে এসেছেন যথাক্রমে জিএস ও এজিএস পদে। তার মানে এই চারজনই নেতৃত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। মনে হয়েছে, এরাই পারবে ছাত্রলীগের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে। ডাকসু নেতৃত্বও নানান পদক্ষেপ নিয়ে ছাত্রদের নানা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখছে। আগের যে গেস্টরুম কালচার, সেটাও এখন নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে আসলেই ছাত্রলীগ ইতিবাচক ধারায় চলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মূল যে কাজ একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, সেটাই পারেনি বর্তমান কমিটি। এটা ঠিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পুরো ক্ষমতা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নেই। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের কারো কারো হস্তক্ষেপের কথা শুনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুমোদন ছাড়া কমিটি ঘোষণার সুযোগ নেই। ঘোষণার আগে সেটা দেখে দেবেন শেখ হাসিনাও। কোথায় আটকে আছে, কার ব্যর্থতা সেটা জানি না। যেটা দৃশ্যমান, সেটা হলো, সম্মেলনের এক বছর পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি।

কমিটি ঘোষণা করতে না পারলেও অন্তর্দ্বন্দ্বে কিন্তু পিছিয়ে নেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ঠিক শুনেছেন, চার নেতার ছাত্রলীগেও অন্তর্দ্বন্দ্ব। গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কনসার্ট আয়োজন করা হয়। আয়োজনের নেতৃত্বে ছিল সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ। কিন্তু সভাপতি গ্রুপ এসে সব তছনছ করে দেয়, কনসার্টের সাউন্ড সিস্টেমে আগুন লাগিয়ে দেয়। পণ্ড হয়ে যায় কনসার্ট। ছাত্রলীগের এই অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন এবং সাংগঠনিক বিষয় নজরদারির জন্য আওয়ামী লীগের চার নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগের দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, দুই সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তারা বর্তমান ও সাবেক নেতাদের নিয়ে বসেছেন, শেখ হাসিনার সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু তাও মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। কমিটি আর হয়নি। ফলে নেতৃত্বপ্রত্যাশীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা। মূল দল ক্ষমতায় থাকলেও গতিশীল হয়নি এর ছাত্র সংগঠন। এক সময় যে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, এখন সেটাই সবচেয়ে বড় দায়।

একাত্তরে ছাত্রলীগের চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে দারুণ ভূমিকা রাখেন। এই চার নেতা হলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কদ্দুস মাখন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চার নেতাকে বলা হতো 'চার খলিফা'। ৪৮ বছর পর ছাত্রলীগ আবার যেন সেই ‘চার খলিফা’ যুগে ফিরে গেলো।

কমিটি কবে হবে কেউ জানে না। রোজার মধ্যে নিশ্চয়ই হবে না। বিএনপির ঈদের পরে আন্দোলনের মতো ছাত্রলীগের কমিটিও নিশ্চয়ই ঈদের পরেই হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ