X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্যে ভেজাল: উৎপাদক থেকে পরীক্ষক সবাইকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি

লীনা পারভীন
১৮ মে ২০১৯, ১৫:০৫আপডেট : ১৮ মে ২০১৯, ১৭:১৫

লীনা পারভীন প্রতিদিনের সংবাদ পড়ি আর অসুস্থতার দিকে যাই। শারীরিক না হলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমরা সবাই। রাস্তায় বের হলে গাড়িচাপা পড়ার ভয়, নারী হলে ধর্ষণ, নির্যাতনের ভয়। উপযুক্ত কাজ না পেয়ে বেকারত্বের ভয়। কোনোরকম তিন বেলা খাবারের জোগাড় করতে পারলেও সে খাবারে বিষ আছে কিনা, সেই ভয়। প্রতি মুহূর্তে ভয়েই কাটছে এই নাগরিক জীবন। এমন কোনও সেক্টর পাচ্ছি না, যেখানে একটু স্বস্তির খবর পাবো আমরা, আর আশা নিয়ে আরও কিছুদিন বাঁচার উৎসাহ পাবো।
সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় ৫২টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল বা নিম্নমানের বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সেই তালিকায় আছে দেশের অত্যন্ত নামকরা কিছু প্রতিষ্ঠানের পণ্য, যেগুলোকে আমরা সাধারণ নাগরিকরা চোখ বন্ধ করে কিনি কেবল ব্র্যান্ড বিশ্বাস থেকে। অথচ এরাই এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে আর মানুষের জীবন নিয়ে খেলায় মেতে উঠছে। আজকাল আমরা সবাই বাজার থেকে প্যাকেটজাত দুধ কিনে খাই। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্যই এসব দুধ কেনেন বাবা-মায়েরা। অথচ দেখা গেলো, সেইসব দুধে আছে বিষাক্ত সিসাসহ অনেক ধরনের কেমিক্যাল, যেগুলোর প্রতিটিই আমাদের জীবননাশক বলে প্রমাণিত।
ফল খাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক বছর আগেই, কারণ ফলে ফরমালিন মেশানো থাকে। বাজারে মাছ কিনতে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিনি। কোন মাছে মাছি বসেছে বা কোন মাছে রক্ত তাজা আছে কত রকম পরীক্ষা করে থাকি কেবল একটু ভেজালমুক্ত খাবারের আশায়। বড় মাছ তো কেনাই হয় না। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম দুধ নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। পুষ্টির মধ্যে সাধারণ মানুষ সামর্থ্যের মধ্যে কেবল দুধ আর ডিম কিনে খায়। ঘি, মাখন, মেয়নেজ বা অন্যান্য  দামি দামি জুসের মতো খাবার কিনে খাবার সামর্থ্য নেই বেশিরভাগেরই। তাহলে এসব মানুষ কোথায় যাবে? চারদিকে আসলে কেবল অন্ধকার দেখি। শখ করে পরিবার, পরিজন-বন্ধু নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও আছে বিপত্তি। পচা-বাসি খাবার বিক্রির ধুম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না।

চলছে রোজার মাস। বাজারজুড়ে ইফতারের সমাহার। ইফতারের একটি অন্যতম অংশ হচ্ছে জিলাপি, আর দেখলাম কোনও এক হোটেলে জিলাপির খামিরের ভেতরে বিড়ালের বাচ্চা পড়ে গেছে। বিড়ালটিকে ওঠালেও রয়ে গেছে তার লোম আর সেই লোমসহ বানানো হয়েছে জিলাপি। সাজানো হয়েছে রঙিন জিলাপির পসরা। খোঁজ নিয়ে বের হয়ে এলো কত নোংরা জায়গায় বানানো হচ্ছে সেইসব লোভনীয় জিলাপি আর আমরা কষ্টের টাকা দিয়ে কিনে সেই বিষ খাচ্ছি।

ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নিয়মিতই চলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। জরিমানা করা হয়। কিন্তু তারপরও নেই সুরাহা। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর দায়ে এখনপর্যন্ত কারও ফাঁসি হয়েছে বলে জানা যায়নি। অভিযানে গিয়ে যে ব্যক্তিটি চাকরি করে তাকে ধরে এনে কোনও সমাধান আসবে না। ধরতে হবে রাঘব বোয়ালদের। হাত দিতে হবে বিএসটিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকেও। নিয়ম অনুযায়ী যেকোনও পণ্য বাজারে ছাড়ার আগেই তার মান নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অর্থাৎ বিএসটিআইয়ের অনুমোদনের পরই কেবল সেটি বাজারজাতকরণ করতে পারার কথা। অথচ হচ্ছে উলটো। বিএসটিআই যে ৫২টি পণ্যকে চিহ্নিত করে তাদের উৎপাদন বন্ধের জন্য হাইকোর্টের কাছে আবেদন করেছে, প্রশ্ন হচ্ছে বাজারে এই পণ্যগুলো নতুন নয়। চলছে অনেক বছর ধরেই। এতদিন বিএসটিআই কোথায় ছিল? কেমন করে পণ্যগুলো বাজারে ছাড় পেলো, আর যদি কোনোভাবে পেয়েও থাকে, তাহলে মোল্লা সল্ট বা তীর তেল তো নতুন নয়। বছরের পর বছর আমরা এগুলো খেয়ে যাচ্ছি। এতদিন কর্তারা কেন ধরতে পারেননি? শুধু পণ্য নিষিদ্ধ করলেই সমধান আসবে? নাকি হাত দিতে হবে শাস্তি-প্রক্রিয়ায়ও? কেন ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? কেন উৎপাদনকারীরা শাস্তির আওতায় আসবেন না?

কিছুদিন আগে র‍্যাব ডিজি বেনজীর সরকারের কাছে খাদ্যে ভেজাল ঠেকাতে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন প্রণয়নের অনুরোধ করেছেন। শতভাগ সমর্থন রইলো তার এই দাবির প্রতি। যারা খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মিশিয়ে জীবন নিয়ে নিচ্ছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর কাজে জড়িতেদের আমার বা আমার সন্তানের জীবনের দামের বিনিময়ে তারা ব্যবসা করে পয়সাওয়ালা হয়ে আরাম আয়েশে দিন কাটাবে, বিদেশি খাবার খেয়ে সুস্থ থাকবে আর আমরা সাধারণ মানুষ ধুঁকে-ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবো, সেটি হতে পারে না।

মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন খাদ্যে ভেজাল মেশানো বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালু থাকবে। অপরাধীদের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। কিন্তু এই কারাদণ্ডের মেয়াদ আমরা কেউ জানি না। আইনের ফাঁক বলে একটা কথা আছে। তাছাড়া প্রতারিত হতে হতে এখন আমাদের আর কারও ওপর বিশ্বাস নেই। আমরা চাই, যারাই খাদ্যে বিষ মেশাবে তাদের সরাসরি ফাঁসির কাষ্ঠে তুলে দেওয়া হবে। এর কোনও ব্যতিক্রম হতে পারে না। হত্যার শাস্তি জেল জরিমানায় ফয়সালা হয় না। অনেক তো অভিযান হলো, জরিমানাও করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা, কিন্তু সমাধান আসছে না। বছরের পর বছর একই কেচ্ছা শুনতে শুনতে আমরা এখন নিরুপায়। যে দেশের মানুষের মধ্যে বিবেকের ছিটেফোঁটাও নেই সেই দেশে আইনের শাসন কায়েমের জন্যই কঠিন আইন চাই, আর চাই তার কঠোর বাস্তবায়ন। এখানে মানবতা বা মানবাধিকার কোনও বিষয় হতেই পারে না। মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অমানবিক উপাদানকে আগে সরিয়ে ফেলতে হয়।

শাস্তি কেবল ছোট ছোট বিক্রেতা বা ব্যবসায়ীকে দিলেই হবে না। হাত দিতে হবে গোড়ায়। উৎপাদক থেকে পরীক্ষক সবাইকে বিচারের আওতায় আনাটা জরুরি। কোনও বাসায় যখন তেলাপোকার বিস্তার হয় তখন বিশাল সাইজের তেলাপোকাকেই আগে মারাটা টার্গেট থাকে, কারণ তারাই বংশ-বিস্তার করে আর জন্ম দেয় গুঁড়া-গুঁড়া তেলাপোকাকে। পাশাপাশি গুঁড়াদেরও সরিয়ে দিতে হয়, যেন বড় হয়ে তাদের রাজত্ব কায়েম না হয়।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
আজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছরআজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ