X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

উন্নয়নের আনন্দ আর ক্ষেতে ধান পোড়াবার দুঃখ

আনিস আলমগীর
২৮ মে ২০১৯, ১৪:৩৮আপডেট : ২৮ মে ২০১৯, ১৪:৩৯

আনিস আলমগীর ক’দিন আগে আমি সাইন্স ল্যাব মোড় থেকে বাসে উঠেছিলাম প্রেস ক্লাবে যাওয়ার জন্য। তখন মোড়ের পাশে এলিফ্যান্ট রোডের মসজিদটিতে মাগরিবের আজান হচ্ছিল। সামান্য দুই-তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন প্রেস ক্লাবে পৌঁছি, তখন বায়তুল মোকাররমে এশার আজান হচ্ছিল। ঢাকার যানজটের পরিস্থিতি কী পর্যায়ে গিয়েছে, উপলব্ধি করার বাকি নেই কারও।
এমন কঠিন যানজটে শুধু ঢাকা শহর নয়, পড়ে আছে হাইওয়েগুলোও। তবে একটুখানি সুখবর আসতে শুরু করেছে গত দুই-চার দিন ধরে ঢাকার বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার ২৫ মে ২০১৯ আটটি প্রকল্প সফল সমাপ্তির পর উদ্বোধন করেছেন। আটটি প্রকল্পই যাতায়াত ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা এখন দেড় ঘণ্টায় বা ঢাকা থেকে ফেনী যাওয়া যাচ্ছে দুই-আড়াই ঘণ্টায়, এমন অনলাইন সংবাদও দেখলাম বেশ কয়েকটা। এ পথের যারা যাত্রী তারা জানেন কত শত ঘণ্টা তাদের নষ্ট হয়েছে এ যাতায়াতে। ফোর লেন কোনও কাজে আসেনি যানজট ঠেকাতে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উদ্বোধন করায় স্বস্তিটা আসতে শুরু করেছে সবার মাঝে। ঈদে বোঝা যাবে কতটা কষ্ট তাদের কমেছে, নাকি এখনও কোথাও ত্রুটি রয়ে গেছে এই মহাসড়কে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় গোমতী সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪১০ মিটার এবং মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর ওপর দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৩০ মিটার। এর আগে, গত ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত একই প্রকল্পের দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতুর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। ঢাকা চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের প্রধান বন্দর, আর ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে সবই রফতানিযোগ্য মালামাল উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর অবস্থান।

ঢাকা শহরে আরেকটা বাইপাস সড়কের প্রয়োজন। এ সড়কটা হবে আমিনবাজার আর সাভারের মাঝখান থেকে বের হয়ে দক্ষিণমুখী প্রসারিত হয়ে সোনারগাঁ’র কাছে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের সঙ্গে মিলিত হবে। এ সড়কটা হলে ঢাকা শহরও যানজটমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ থেকে যতসব চট্টগ্রাম অভিমুখী যানবাহন আসে সবই এ সড়কটি ব্যবহার করবে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ীতে ফ্লাইওভার উদ্বোধন করা হয়েছে। কোনাবাড়ীর অসহনীয় যানজটের কষ্ট থেকে এবার হয়তো এ পথের যাত্রীরা মুক্ত হবেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক হয়ে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলাসহ ২৬ জেলার ৯০টি রুটের বিপুল যানবাহন চলাচল করে। এমন মহাসড়কে যানজট হলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী সীমাহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও স্থবিরতা দেখা দেয়। ঈদ উপলক্ষে এ রুটেই আগের দিন বাড়ি যাত্রা করে পথে ঈদ করার নজিরও আছে। শনিবার ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডের দু’টি ফ্লাইওভার আর চারটি আন্ডারপাস উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সড়কটি ২০১৩ সালে ডাবল লেন থেকে চার লেন করার প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল।

এখন পর্যন্ত এই সড়কে দু’টি সার্ভিস লেন, ২৯টি নতুন ব্রিজ, চারটি ফ্লাইওভার ও ১৪টি আন্ডারপাস সংযুক্ত হলো। গত বছর কিছু কিছু এলাকায় সেতুর কাজ এবং ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ায় তা চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। এ সড়কটির যাতায়াত সহজ হয়ে গেলে মানুষের কষ্ট যে শুধু লাঘব হবে তা নয়, অর্থনীতিতেও গতি আসবে।

মাহাথির মোহাম্মদ এর আগে ২২ বছর মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি টানা ১০ বছর শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছিলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। সড়ক, রেল আর বন্দর শক্তিশালী হলেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ফলপ্রসূ হয়।

সরকার পটুয়াখালীতে পায়রা নামে তৃতীয় একটা বন্দর নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেছেন। এ বন্দরটি নিয়ে আমার সংশয় হয় এটি লাভজনক হবে কিনা। কেননা বন্দরকে সচল রাখতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ড্রেজিং করাতে হবে। মংলা বন্দরকে সচল রাখতে গিয়েও এমন টাকা খরচ হচ্ছে। ভৈরব নদী, পশুর নদীতে তো স্রোতই নেই। ফারাক্কার প্রভাবে এ নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় জমিও বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হলে ৫০টি জাহাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারবে। যা হোক, বন্দর নির্মাণ হলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের মালামালও এ বন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারবে। তবে বন্দর তো লাভজনক হতে হবে।

সরকার একশ’ ইপিজেড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে যদি ইপিজেডগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় তবে বন্দরের সঙ্গে তো ইপিজেডগুলোর ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগ করতে আসবে না।

বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রতিবেদনে ২০৩০ সাল নাগাদ মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশিরা ভারতকে টপকে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কোনও কোনও অর্থনীতিবিদ তা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। আগামী ১১ বছরে ভারতকে টপকে যেতে হলে প্রতিবছর বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ২ শতাংশ হতে হবে মনে করেন তারা, যা তাদের মতে বাস্তবে অসম্ভব। তবে উন্নয়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্মুখ, সে বিষয়ে দেশের মানুষের আস্থা রয়েছে তার ওপর। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও উন্নয়নের যাত্রায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ নেই, বরং মানুষের আস্থা আছে।

উন্নয়নের যখন জোয়ার, তখন এবার আমাদের ব্যথিত করেছে বোরো ধান নিয়ে কৃষকের সমস্যায়। প্রতিদিন কৃষকের সমস্যা নিয়ে মিডিয়ায় নানারকম নেতিবাচক খবর আসছে। ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক, অথচ ব্যাপক হারে চাল আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। কম দামে চাল আমদানি করে আমদানিকারকরা লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু কৃষক ধান বিক্রি করে তার ধান উৎপাদনের খরচ পর্যন্ত তুলতে পারছেন না।

কৃষক সরকার থেকে ভর্তুকি চাচ্ছেন না। ঋণ মওকুফ চাচ্ছেন না। তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে রেহাই চান। সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ভালো দামে ধান বিক্রি করতে চান। এ চাওয়া ন্যায্য। পত্রিকায় ছবি এসেছে, কেউ মনের দুঃখে ধানক্ষেতে আগুনও দিয়েছেন। শিক্ষক-ছাত্র-পুলিশ অনেকে সহমর্মিতা জানিয়ে অসহায় কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন খবর দেখছি।

সম্প্রতি ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা ধানের ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। তবে ঘটনাটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেছেন, কৃষকের ধানক্ষেতে আগুন দেওয়ার যে ছবি মিডিয়ায় এসেছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারকে বেকায়দা ফেলার জন্য। সরকারি দলের কিছু নেতা বলছেন, ক্ষেতে আগুন লাগানোর ছবি নাকি ভারতীয় ছবি। আমাদের পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। তারা হয়তো জানেন না, ভারতের কৃষকরা আমাদের কৃষকের চেয়ে বেশি তেজি। তারা ক্ষেতে আগুন দেন না, আত্মহননের পথ বেছে নেন। নরেন্দ্র মোদির পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে সাত শতাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কৃষকরা দল বেঁধে শহরে এসেছেন হেঁটে।

আওয়ামী লীগকে এখন নানা কারণে মানুষ ভয় করে। কৃষকের প্রতিবাদের ছবি নিয়ে, আন্দোলন নিয়ে ভয়ের আবহ সৃষ্টি করা উচিত হবে না। মূল ধারার সংবাদপত্রে যেসব সংবাদ ছাপা হয় তা উড়িয়ে দিলে হবে না। সমস্যার গভীরে গিয়ে দ্রুত সমাধান করতে হবে। কৃষি থেকে কৃষককের মন উঠে গেলে ভয়াবহ বিপদ বাংলাদেশের। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি আমরা। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ভেঙে ফেললে হয়তো বড় কোনও দুর্ভিক্ষ গ্রাস করবে আমাদের।

কেউ কেউ বলছেন আগের খাদ্যমন্ত্রী লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করেই নাকি এ করুণ অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। কামরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে সমালোচকরা বলছেন, সরকার দাবি করে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, তারপরও খাদ্য আমদানির প্রয়োজন পড়লো কেন? কথা তো যৌক্তিক। সরকার সব সময় যা দাবি করবে তাতে তো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। সরকারের উচিত হবে এখন সরাসরি ধান কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেওয়া। রাখার জায়গা না থাকলে আপাতত কৃষকের হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা করা।

লেখক:সাংবাদিক  কলামিস্ট। ইরাক  আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ