X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্রসফায়ারে চাই না, দ্রুত ন্যায়বিচার চাই

প্রভাষ আমিন
০৭ জুলাই ২০১৯, ১৬:৫০আপডেট : ০৭ জুলাই ২০১৯, ১৭:০৯

প্রভাষ আমিন এমন আশঙ্কা আমি আগেই করছিলাম। মঙ্গলবার সকালে ঘুম ভাঙলো অফিসের ফোনে। আশঙ্কাটা সত্যি হলো, বরগুনার সাব্বির রহমান নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আমার আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ১৭ বছরে ২ হাজার ৫৯৭ বার আমার এই দীর্ঘশ্বাস সইতে হয়েছে। বিএনপি আমলে শুরু হওয়া  ক্রসফায়ারের নামে এই বিচারবহির্ভূত ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড চলেছে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও, চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদেও। ক্রসফায়ার মানে হয়তো একজন সম্ভাব্য অপরাধীর বিনা বিচারে মৃত্যু। একইসঙ্গে তার পৃষ্ঠপোষকদের চিরদিনের জন্য বাঁচিয়ে দেওয়া। ক্রসফায়ার মানে আইনের শাসনহীনতা, প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা। মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে বন্দুকের নলে ভূলুণ্ঠিত করার নামই ক্রসফায়ার।
নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের আশঙ্কা করছিলাম, কারণ বরগুনা কলেজের সামনে রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। শঙ্কাটা হলো, প্রচলিত আইনে বিচার নয়, অধিকাংশই পুলিশকে অভিযুক্তদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ খুনিদের ঘটনাস্থলে নিয়ে কুপিয়ে মারার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেআইনি কাজের পরামর্শ দিতে পারে, উসকানি দিতে পারে; আমার বিশ্বাসই হয় না। কিন্তু বছরের পর বছর এটাই হয়ে আসছে। বর্তমান সরকার জানে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি ভালো হয়নি। জনরায়ের সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তারা সবসময় জন আবেগের সঙ্গে চলতে চায়। আর বাংলাদেশে এখন চট করে মানুষের আবেগ বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ফেসবুক। ফেসবুকে যে বিষয়ে জনমত গড়ে ওঠে, সরকার সাধারণত তার বাইরে যায় না।

কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তার বদলি, সবই ফেসবুকের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই রিফাত শরিফ হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের ক্রসফায়ারের পক্ষে প্রবল জনমত দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এই ঘটনায় চিহ্নিত খুনিদের কেউ ধরা পড়লেই ‘অস্ত্র উদ্ধারে’ যাবে পুলিশ। তাই হয়েছে। তবে নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের পর অনেকেই ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছেন, প্রচলিত আইনে বিচার  চেয়েছেন। তাই দু’দিন পর রিফাত ফরাজী ধরা পড়লেও এবার পুলিশ অস্ত্র উদ্ধারে যায়নি। এক যাত্রায় দুই ফল।

আমি বরাবরই ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। আর মানুষের জীবন যেহেতু সবচেয়ে মূল্যবান, তাই সেটি কেড়ে নেওয়ার আগে যেন সর্বোচ্চ বিবেচনা প্রয়োগ করা হয়। তাই প্রচলিত আইনে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামি রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পর্যন্ত চাইতে পারেন। কিন্তু ক্রসফায়ার মানে হলো, ‘ধরো আর মারো’। এমনিতে আইনের চেতনা হলো, ১০ জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু কোনও নিরপরাধ লোক যেন সাজা না পায়। কিন্তু ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনার সময়ই নেই। অনেক সময় নামে মিললে, চেহারা মিললে; ভুল লোকও ক্রসফায়ারে মরে যায়। অনেক সময় দেখে ফেললে সাক্ষীকেও জীবন দিতে হয়। ১৭ বছরে যে ২ হাজার ৫৯৭ জন ক্রসফায়ারে জীবন দিয়েছেন, তাদের কয়জন সত্যি সত্যি অপরাধী ছিল? কয়জনের অপরাধ ফাঁসির যোগ্য ছিল? তাদের অপরাধ যে মৃত্যুদণ্ডতুল্য, সে রায় কে দিয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব কখনোই জানা যাবে না। প্রচলিত আইনে মামলা হয়, তদন্ত হয়, বিচার হয়, নিম্ন আদালতের রায় হয়, হাইকোর্টে আপিল হয়, সুপ্রিম কোর্টে আপিল হয়, রিভিউ হয়, রাষ্ট্রপতির মার্জনা চাওয়া যায়। আর ক্রসফায়ারে কিছুই লাগে না।

দ্রুততম বিচার, ততোধিক দ্রুততম কার্যকর। আমি বলি, ক্রসফায়ারকেই যদি আমরা সমাধান মনে করি, তাহলে প্রচলিত আইন-আদালত বন্ধ করে দেওয়া হোক। নাহলে আজ থেকে ক্রসফায়ার বন্ধ করা হোক। এক দেশে দুই আইন চলা উচিত নয়। নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের পর ফেসবুকে অনেকেই বলেছেন, আমি ক্রসফায়ারের বিপক্ষে। কিন্তু এই সন্ত্রাসীদের জন্য ক্রসফায়ারই ঠিক আছে। কী অদ্ভুত! আইন সবার জন্য একইরকম হতে হবে। আপনি একজনের ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারকে ভালো বলবেন, আরেকজনের জন্য খারাপ; এই দ্বৈতনীতি বন্ধ করতে হবে। যেটা খারাপ, সেটা সবার জন্যই খারাপ।

এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা চলবে বছরের পর বছর, মানবতাবিরোধী অপরাধীরা আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পাবে; আর পাড়ার মাস্তানকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে–এটা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। আমি কর্নেল ফারুক বা নিজামীর ফাঁসি চেয়েছি, ক্রসফায়ার নয়। নয়ন বন্ডেরও ফাঁসি চেয়েছি, ক্রসফায়ার নয়।

সাধারণভাবে সাধারণ মানুষ সরকারের এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টো। শুরু থেকেই সাধারণ মানুষ ক্রসফায়ারের পক্ষে। পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট করুন, ক্রসফায়ার বিপুল ভোটে জিতবে। নিজের ঘরে না আসা পর্যন্ত সবাই বলেন, বাংলাদেশে ক্রসফায়ারই ঠিক আছে। সাধারণ মানুষের এই ‘অনৈতিক’ সমর্থনকে পুঁজি করে সরকার বছরের পর বছর এই অন্যায়টা করে যাচ্ছেন। একটি ক্রসফায়ারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুটি অপরাধ করে–এক. বিনা বিচারে হত্যা; দুই. মিথ্যা কথা বলা।

এই যে আপনি-আমি ক্রসফায়ারকে সমর্থন দিচ্ছি, আমরাও কিন্তু এই অপরাধের অংশীদার। ২ হাজার ৫৯৭ জন মানুষের মৃত্যুর নৈতিক দায় আপনাকে-আমাকেও নিতে হবে। সমস্যাটা হলো, ক্রসফায়ারের জন্য অলিখিত দায়মুক্তি পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেপরোয়া হয়ে গেছে। ক্রসফায়ার কখনও কখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবসা। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয়। আবার পুলিশকে টাকা দিয়ে কাউকে ক্রসফায়ারে দেওয়া যায়। আপনি যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একটি ক্রসফায়ারের ছাড় দেবেন, তখন সে সেই সার্টিফিকেট দিয়ে আরো অনেক কিছু করে ফেলবে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন আপনার-আমার এই পরোক্ষ সমর্থনেই হয়েছে। আপনি যদি নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের সমর্থক হন, তাহলে টেকনাফের একরামের কন্যার কণ্ঠে ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে’ শুনে চোখের পানি ফেলার অধিকার আপনার নেই।

ক্রসফায়ারের পক্ষের সব যুক্তি আমি জানি। বড় অপরাধীদের ধরা কঠিন। ধরলেও প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকরা তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। সেটা না হলেও আদালতে তাদের বিপক্ষে কেউ সাক্ষী দিতে যায় না। গেলেও ঝানু উকিলের যুক্তির ফাঁদে পার পেয়ে যায় অপরাধী। রায় হলেও তা বছরের পর বছর আটকে থাকে বিভিন্ন ধাপে। ২০১২ সালে ঢাকায় প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেছিল বিশ্বজিৎকে। ৭ বছরেও কোনও আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে অনেকে বিচারের আশা ছেড়ে দেন। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। বিচারব্যবস্থার এই  জটিলতার  কারণেই সাধারণ মানুষ ক্রসফায়ারকেই সমাধান মনে করে। কিন্তু ক্রসফায়ার কখনোই একটা সভ্য দেশে সমাধান হতে পারে না। নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের পর হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা পছন্দ করি না। এতে পাবলিকের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে।’ হাইকোর্টকে ধন্যবাদ। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়। সরকারের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ—সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও অপরাধী যেন পার পেতে না পারে। কোনও নিরপরাধী যেন সাজা না পায়। কোনও প্রভাবশালীর পৃষ্ঠপোষকতায় যেন নয়ন বন্ডরা তৈরি হতে না পারে। সবাই যেন আইনের সুরক্ষা পায়। আমরা কারো ক্রসফায়ার চাই না, দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই।

ক্রসফায়ার দিয়ে কখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। যত বেশি ক্রসফায়ার, ধরে নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত খারাপ। ক্রসফায়ার মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, ক্রসফায়ার মানে বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা। এটা চলতে দেওয়া, সমর্থন করা আমাদের এক ভয়াবহ দিনের দিকে নিয়ে যাবে। আজ আপনি নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারে উল্লাস প্রকাশ করছেন, কাল যখন আপনার কোনও নিরপরাধ বা স্বল্প অপরাধী ভাই ক্রসফায়ারে মারা যাবে; আপনি প্রতিবাদ করবেন কোন মুখে? ক্রসফায়ার একটি অপরাধ, পাপ। এ পাপের দায় আপনার, আমার, সরকারের, আদালতের—সবার। এ দায় থেকে মুক্তি পেতেই আমাদের সবাইকে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ক্রসফায়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমএমজে/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ