X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একজন পেশাদার হতাশাবাদীর লেখা!

আহসান কবির
১২ জুলাই ২০১৯, ১৮:৩৪আপডেট : ১২ জুলাই ২০১৯, ১৯:০৯

আহসান কবির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং দুটো কৌতুক বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। প্রথম কৌতুক এমন:
পুলিশ স্টেশনে এসেছেন এক লোক। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটি কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে বললেন, আমাকে সাব্বির নামের এক লোক কুপিয়েছে। আমি মামলা করতে এসেছি।
পুলিশ অফিসার: ঘটনার কোনও ভিডিও আছে?
লোক: জি না।
পুলিশ অফিসার: তাহলে আপনি পরে আসুন! আমি এখন ব্যস্ত আছি।

কৌতুক-দুই:

পুলিশ স্টেশনে এসেছেন এক লোক। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটি কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে বললেন,

আমাকে নয়ন নামের এক লোক কুপিয়েছে। আমি মামলা করতে এসেছি।

পুলিশ অফিসার: ঘটনার কোনও ভিডিও আছে?

লোক: অবশ্যই আছে।

পুলিশ অফিসার: তাহলে আমি মামলা নিচ্ছি। যদি ভিডিওটা ভাইরাল হয় তাহলে মামলার কাজ অতি দ্রুত এগিয়ে চলবে, প্রয়োজনে ক্রসফায়ারে আসামির লাশ পড়বে! আর না হলে কোটি কোটি মামলার তালিকায় আরও একটা যুক্ত হবে।

এবার আসি গল্পের কথায়। যে থাকে গল্পে, অস্ত্র উদ্ধারের নামে সে যায় অল্পে। গল্পটা পুরনো অনেক, বারবার একই গল্প বলার পরেও এই গল্প কেউ বিশ্বাস করে না। তাই গল্পটা আগের মতোই আছে। যেমন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও মাদক মামলায় আগেও কয়েকবার গ্রেফতার হওয়া সাব্বির রহমান নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে নিয়ে মধ্যরাতে অস্ত্র উদ্ধারে নামে পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নয়ন বন্ডের সহযোগীরা গুলি ছুড়তে থাকে। প্রাণ রক্ষার্থে পুলিশও গুলি চালায়। গোলাগুলির একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয় নয়ন বন্ড। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গোলাগুলির পর দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গুলি, চাপাতি ও রামদা উদ্ধার করেছে পুলিশ।

অস্ত্র উদ্ধারের নামে যদি প্রতিদিন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়, তাহলে দেশটা আফগানিস্তান,পাকিস্তান কিংবা সিরিয়ার মতো হয়ে যাওয়ার কথা। বন্দুকযুদ্ধের পরে পিস্তল, রাইফেল, দেশি বন্দুক, রামদা, গুলিসহ অনেক কিছু উদ্ধার হয়, যা দিয়ে ‘অস্ত্রের খনি’ খুলতে পারে বাংলাদেশ। অস্ত্র উদ্ধারের নামে পুলিশ বা র‌্যাবের সঙ্গে গত ১৭ বছরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ২৫৯৭ জন। বিনা বিচারে মারা গেলো এতজন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কি আদৌ উন্নতি হয়েছে?

সর্বশেষ আলোচিত ক্রসফায়ারে গেছে বরগুনার রিফাত শরীফ (চাই না এমন হতভাগ্য হয়ে কেউ পৃথিবীতে আসুক কিংবা প্রিয়তমার সামনে খুন হোক) হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত সাব্বির রহমান নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমর কবিতা—‘আদিম হিংস্র মানবিকতার আমি যদি কেউ হই/স্বজন হারানো চিতায় তোদের লাশ আমি তুলবই’ মেনে নিয়েই বলা যায়, ক্রসফায়ার কিংবা গুম কোনও সমাধান নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর বহু দেশে বহুগুণ বেশি হিংস্রতার জন্ম দিয়েছে, বাংলাদেশেও এই হিংস্রতা ফিরে এসেছে, আরও বহুগুণে ফিরে আসবে!

রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে নেওয়া হয়েছে কিন্তু বন্ডের প্রধানতম সহযোগী ফরাজীকে নেওয়া হয়নি অস্ত্র উদ্ধারের নামে ক্রসফায়ারে! এ কারণে আগেই বলা হয়েছে, ভাগ্যবানরা যায় বিচারে, ভাগ্যহীনদের যেতে হয় গুমে কিংবা ক্রসফায়ারে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ক্রসফায়ারে নেওয়া হয়নি, সঠিক বিচারের আওতায় এনে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের বিচার হয়েছিল প্রচলিত আইনে। একসময়ে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বা ক্রসফায়ার চালানোর কারণে পাকিস্তান, ইরাক কিংবা আফগানিস্তান এখন কী অবস্থায় আছে, তা বোধকরি সবাই ধারণা করতে পারেন।

প্রশ্ন জাগে মনে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত কারা দেয়? কারা বিচার করে—কোন কোন অপরাধ করলে ক্রসফায়ার হবে, কোন কোন অপরাধ হলে নেওয়া হবে প্রচলিত বিচারের আওতায়? কারা ক্ষমা পায়, কারা বেঁচে আসতে পারে?

এবার তাই সরকারি ডাক্তারদের অনুসরণে কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিস অথবা রহস্যময় কাহিনি তুলে ধরা হচ্ছে। এসব একাধিকবার একাধিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তবু তিনটি উদাহরণ টানা হচ্ছে শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। নাকি একজন পেশাদার হতাশাবাদীর মতো বলতে হবে যে, এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাওয়া যাবে না?

এক. ২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। এই ঘটনার কয়েক দিন আগে তাকে অপহরণের চেষ্টা করা হয় এবং তিনি চিৎকার চেঁচামেচি ও ধস্তাধস্তি করে লোকজন ডাকলে উপস্থিত জনতা একজনকে ধরে ফেলে এবং ওই একজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ ব্যাপারে থানায় জিডিও করা হয়েছিল! আমজনতা অবশ্য নিশ্চিত নয় যে, এটি সরকারের কোনও লোক করেছে নাকি কারও প্রাইভেট প্র্যাকটিস!

দুই. এই ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে চালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। তার পরিবার ও বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, র‌্যাবের সদস্যরাই তাকে অপহরণ করেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী দেখাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে । ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। এ কারণে একটা কোটি টাকা দামের প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। চৌধুরী আলমের মতো ইলিয়াস আলীর বিষয়টা আসলে অপহরণ না কারও প্রাইভেট প্র্যাকটিস? নাকি এসব এমন কারও কাজ, যাদের সরকার শনাক্ত করতে পারছে না বা গ্রেফতার করতে ভয় পাচ্ছে?

তিন. ২০১২ সালে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে অপহরণ করা হয় এং পরে টাঙ্গাইলের কাছে তার লাশ পাওয়া যায়। দেশ বিদেশের মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। ২০১৩ সালের নভেম্বরে সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম হীরু এবং হুমায়ূন কবির পারভেজ হরতাল ও অবরোধের কারণে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসছিলেন। পথিমধ্যে এই দুইজন ও ড্রাইভারকে অপহরণ করা হয়। পরে মারপিট করে ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সাইফুল ইসলাম হীরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের মে মাসে এই দুইজনের পরিবারের সদস্যরা মামলা করেছেন এবং মামলায় আসামি করা হয়েছে র‌্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাইদ মোহাম্মদ ও মেজর সাহেদকে। যাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায়।

‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ যারা করছেন অথবা যারা রহস্যময় ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাদের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। জানা যাচ্ছে না ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত কারা দেয়, কারা ভাগ্যবানের খাতায় কীভাবে নাম লিখিয়ে প্রচলিত আইনের আওতায় বিচারের জন্য আসতে পারে? আমরা কবিতায় পড়েছি—‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে!’ মেরি শেলির লেখা ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্পও জানি আমরা। গল্পের মূল বক্তব্য এমন—পরের ক্ষতি করার জন্য যে দৈত্যকে সৃষ্টি করা হয় সেই দৈত্য একদিন তার সৃষ্টিকারীকেই মেরে ফেলে! সুতরাং এ কালের ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্প শুনে বিদায় নেই।

এক বিজ্ঞানী ইয়া বড় এক দৈত্য বানিয়েছেন। দশাসই ফিগার, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। আধুনিক সব অস্ত্র থাকে দৈত্যের পকেটের ভেতর। তবে দৈত্য নিজে কিছু করতে পারে না। রিমোট কন্ট্রোল টিপে দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন বিজ্ঞানী। তো বিজ্ঞানী তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে আসলেন তার সৃষ্ট দৈত্যকে দেখাতে। বিজ্ঞানী তার বন্ধুকে নিয়ে বিজ্ঞানাগারে ঢোকামাত্র ‘হো হো’ করে হেসে উঠলো দৈত্য। বিজ্ঞানী খেয়াল করলেন দৈত্যটা রিমোট কন্ট্রোল হতে নিয়ে হাসছে। বিজ্ঞানীর বন্ধু ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন—‘এখন আমরা কী করবো?’

বিজ্ঞানী উত্তর দিলেন—‘এখন যা করার দৈত্যটাই করবে’। যতটুকু সময় পাই আমরা শুধু হাত তুলে প্রার্থনা করতে পারবো!

আসুন সঠিক বিচার যেন দ্রুত পেতে পারে মানুষ তার জন্য প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেন আর একটিও না ঘটে! যেন দিন দিন আমার মতো পেশাদার হতাশাবাদীর সংখ্যা না বাড়ে!

লেখক: রম্যলেখক

/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ