X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুস্রোত থামেনি, শৃঙ্খলা ফেরেনি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩১ জুলাই ২০১৯, ১৩:৫৯আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৯, ১৪:০১

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে রয়েছে কেউ, পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। কারও থামার সময় নেই, ইচ্ছেও নেই। কিংবা মুখোমুখি সংঘর্ষের পর বীভৎস চেহারা নিয়ে পিচঢালা পথ রক্তাক্ত করে চলাচল বন্ধ করে আছে বাস, ট্রাক।
আমাদের সড়ক, মহাসড়কে এই ঘটনা আকছার হয়। সংবাদের শিরোনামও হয়। অধিকাংশ ঘটনার পরিণতি চরম বিয়োগান্ত। যেমন বিয়োগান্ত ছিল এক বছর আগে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীর মৃত্যু। সড়কে এই লাশ পড়েছিল দুই বাসের রেষারেষিতে। পরিবহন শ্রমিকদের উচ্ছৃঙ্খলতা, চালকদের বেপরোয়া আচরণ, সড়কে হত্যাযজ্ঞ—এটাই বাংলাদেশের চিত্র।
এই চেনা ছবিটা বদলাতে চেয়েছিল আমাদের ছেলেমেয়েরা। রমিজউদ্দিনের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীজুড়ে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। কিন্তু সেই ছবি বদলায়নি। বলতে গেলে ছবিটা আরও কদর্য হয়েছে। সড়কে মৃত্যু স্রোত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবহন শ্রমিকদের মারদাঙ্গা আচরণ। তারা প্রকাশ্যে, রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে, খোদ রাজধানীতে, পুলিশের সামনে জাতির মুখেও চুনকালি মেখে দেওয়ার মতো রাজপথে চলমান মানুষের মুখে পোড়া কালো মবিল লাগিয়ে পৈশাচিক ‌উল্লাস করেছিল। এজন্য কোনও অপরাধীর কোনও শাস্তি হয়নি, যেমন করে কিছুই হয়নি হেলমেটধারী সেইসব নরঘাতকের, যারা এই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলেনের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনরত গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট। পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও সড়কে শৃঙ্খলা আনতে নিয়েছিল নানা উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছিলেন ছাত্ররা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, তিনি উদ্যমী হয়ে সংসদে একটি আইনও পাস করেছিলেন। যদিও সড়ক পরিবহন আইনটি প্রত্যাশামতো ছিল না, তবুও আইনটিকে সংশ্লিষ্ট মহল স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু সড়ক নৈরাজ্যে যারা বিশ্বাস করে, সড়কে হিংস্রতা বজায় রাখা যাদের জন্য বাণিজ্য, তারা এই অতি সাধারণ আইনটিরও বিরোধিতা করে চলেছে। ফলে সংসদে পাস হওয়া একটি আইন কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এখন এই সড়ক নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী চক্রটি আইনটি যাতে কার্যকর না হয়, সেজন্য সংশোধন দাবি করে চলেছে।    

কত কত প্রতিশ্রুতি ছিল নানা তরফে, সেসব আজ আর উচ্চারিত হয় না। মালিকরা বলেছিলেন রেষারেষির প্রধান যে কারণ, টার্গেট ট্রিপ বন্ধ হবে—সেটা হয়নি। শ্রমিকরা বেতনে কাজ করবে, তাদের নিয়োগপত্র থাকবে, পরিচয়পত্র থাকে—সেটাও হয়নি। দাপাদাপি, পাল্লাপাল্লি চলবে না—সেটা আজও আছে এবং আছে বলেই বাংলাদেশ প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরারকে জেব্রা ক্রসিংয়েই হত্যা করতে পারে ফিটনেস ছাড়া বাস ও তার লাইসেন্সবিহীন চালক।

ফি বছর ঘটা করে সড়ক নিরাপত্তার লক্ষ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সপ্তাহের জায়গায় পক্ষ পালিত হয়েছে। কত কী হলো—গণমাধ্যমে প্রচার, লিফলেট বিলি ইত্যাদি। কিন্তু কাজ হলো কি? বাস্তবতা বলছে, পুলিশের সামনে দিয়েই বাস, মিনিবাস, টেম্পু, হিউম্যান হলার যেনতেনভাবে চলছে। বাসে-বাসে রেষরেষি তো আছেই।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের একটা বড় দাবি ছিল, সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন উচ্ছেদ করা। কিন্তু তা হয়নি। হাইকোর্টে জমা দেওয়া বিআরটিএ’র প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে এখনও আনফিট মোটরযান আছে প্রায় পাঁচ লাখ, যার সিংহভাগই চলাচল করছে রাজধানীতে। ছাত্র আন্দোলনের পর ঢাকায় বাস স্টপেজের জন্য ১২১টি স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। প্রথম কয়েক দিন এসব স্টপেজে বাস দাঁড়ালেও বর্তমানে বেশিরভাগ স্টপেজেই বাস থামছে না। একই অবস্থা চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা লাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও। বেশিরভাগ বাসই দরজা বন্ধ না করে চলছে।

এই এক বছরে ঢাকাসহ দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। সড়কে শৃঙ্খলা বা সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই এক বছরে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নানা নির্দেশনা এলো, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় কিছুই হলো না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি রাস্তার বেহাল দশার কারণেও বেশ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক আইন নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি কাজ। এসবের কোনোটি কি হয়েছে?  

প্রশ্ন আসতে পারে দায় কার। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের একটা দায়তো আছেই। কারণ সড়কের বড় স্টেকহোল্ডার তারা। কিন্তু বড় দায়তো সরকারের। সরকারকেই মানুষের জীবন নিরাপদ করতে হবে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। চালক প্রশিক্ষণ, যানবাহনের ফিটনেস আধুনিকায়ন, রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ সিস্টেমে বাস চলাচল নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বন্ধ করা সরকারের অঙ্গীকার। কিন্তু অঙ্গীকার পূরণের মনোভাব দৃশ্যমান নয়। 

আসল কথা হলো আমরা চাই কিনা সড়কে সুস্থতা আসুক। কথা অনেক বলা যায়, কিন্তু কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়ে পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে মৃত্যুমিছিল আটকানো যায় না। 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ