X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বলে আগুন, নেভে মানবতা

জোবাইদা নাসরীন
২৯ আগস্ট ২০১৯, ১৩:২৪আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০১৯, ১৬:২১

জোবাইদা নাসরীন আবারও মানুষ ঘুরেফিরে দেখছে পৃথিবীর মানচিত্রকে। মানুষকে এবারের মানচিত্রমুখী করিয়েছে অ্যামাজন। মানচিত্রের হিসাবে দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় অর্ধেক এবং ইউরোপের দুই-তৃতীয়াংশ আয়তনের বিশাল এলাকাজুড়ে আসন পেতে আছে মানুষের সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা। আছে সাড়ে পাঁচ কোটি বছর পুরনো বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিবন অ্যামাজন, যাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস। তিন কোটির বেশি মানুষের বাস এই বনের গভীরে। রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী, বলা হয়ে থাকে যারা মূলত রক্ষা করে চলছে অ্যামাজনকে। এছাড়া আছে হাজার হাজার উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং লক্ষাধিক প্রজাতির পাখি। সুবিশাল এই জীববৈচিত্র্য বিশ্বের মানুষের কাছে অনেকটাই অজানা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় ৩০ লাখ স্বতন্ত্র প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণীর আবাসস্থল এই অ্যামাজন। এখনও প্রায়ই নতুন নতুন প্রজাতির গাছ কিংবা একটি প্রাণী এবং এমনকি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সন্ধান দিয়ে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। অ্যামাজন সম্পর্কে যাই জানুক আর না জানুক এই তথ্য অনেকেই জানেন, পৃথিবী নামের এই গ্রহের মোট অক্সিজেনের পাঁচ ভাগ অর্থাৎ ২০ শতাংশ জোগানদাতা এই অ্যামাজন। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে  এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে অ্যামাজন।

প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেয় অ্যামাজনের বিস্তৃত বনাঞ্চল। এই গাছগুলো যখন কাটা হয় বা আগুনে পুড়ে যায়, তখন শোষণ করে রাখা কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।

গত দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের হৃৎপিণ্ড জ্বলছে। কারণ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস যে অ্যামাজানের সঙ্গে লাগা। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে এই রেনফরেস্টের শত শত কিলোমিটার বনভূমি। প্রতি মিনিটে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় দুটো ফুটবল মাঠের সমান বনাঞ্চল। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট আট মাসে অ্যামাজনে ৭৫ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আরও বলা হয়েছে গত বছর আগস্ট পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। এই বিষয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ২০১৩ সালে পুরো ব্রাজিলে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, চার মাস বাকি থাকতেই এ বছর তার চেয়ে বেশি আগুন লেগেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন যদিও শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অ্যামাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একেবারে বিরল নয়। কিন্তু এবারের মতো এত ভয়াবহ আগুন কখনও দেখেনি অ্যামাজনবাসী এবং এর আগে এভাবে পোড়েনি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনাঞ্চল। শুধু ধোঁয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে। কামসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু অ্যামাজনে লাগা আগুনের কারণে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ২২৮ মেগা টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন ২০১০ সালের পর কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের এ হার সর্বোচ্চ। শুধু কার্বন ডাইঅক্সাইড নয়, বিপুলসংখ্যক গাছ পোড়ার কারণে বাতাসে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসও নির্গত হচ্ছে।

লাতিন আমেরিকার গর্ব এই অ্যামাজান। ভৌগোলিকতার দিকে থেকে অ্যামাজনের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশই ব্রাজিলে অবস্থিত। তবে আগুনের তেজ এবং ভয়ংকর রূপ কেবল ব্রাজিল অংশের অ্যামাজনে নয়, বরং লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোও দেখছে। ভেনেজুয়েলার অ্যামাজন অংশে এ বছর ২৬ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। আর বলিভিয়া অংশে ১৭ হাজারেরও বেশিবার আগুন লেগেছে। কলম্বিয়াতেও খুব পিছিয়ে নেই । এই দেশের অংশে আগুন লেগেছে ১৪ হাজারের বেশিবার।

এই আগুনের সূত্র নিয়ে চলছে নানা বাহাস। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের রক্ষাকবচ ও জীববৈচিত্র্যের অপরূপ লীলাভূমি নিয়ে আজ পুরো বিশ্ব খুবই চিন্তিত, বিচলিত। মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আজ অ্যামাজন নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন। এই আগুনের উৎসস্থলও কিন্তু মানুষ। মিডিয়া ট্রায়াল চলছে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে। অ্যামাজন নিয়ে তার ব্যবসাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার কথা প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন বেশ কয়েকবার। যেমন তার নির্বাচনি প্রচারণার সময়েও তিনি অ্যামাজনকে মাইনিং ও কৃষিকাজের জন্য ব্যবহারের কথা বলেন। এছাড়া তিনি প্রচণ্ড মাত্রায় আদিবাসীবিরোধী একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। অ্যামাজনের আদিবাসীরা সেখানকার আদিবাসী। বর্তমানে অ্যামাজনের এই অবস্থার জন্য তাই তারা বলসোনারোকে দায়ী করেন। বলা হচ্ছে তার প্রধান লক্ষ্যই নাকি অ্যামাজনের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করা। অ্যামাজনের বনাঞ্চল ধ্বংস করে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা, সয়াবিন চাষের জন্য কৃষি জমির সম্প্রসারণ করা, গোচারণ বানানো। অ্যামাজনের ৪ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার ইতোমধ্যে গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এখন লাতিনে জ্বলতে থাকা অ্যামাজনের এই আগুন আমাদের কেন দুশ্চিন্তায় ফেলে? অ্যামাজন আমাদের ধাক্কা দেয় সুন্দরবনের দিকে ফিরে তাকাতে। অ্যামাজনের মতোই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। সিডর-আইলাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে  ভয়াবহতায় এই সুন্দরবনই নিজের বুক উজাড় করে দিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এই সুন্দরবন। কিন্তু উন্নয়নের বাকোয়াজ তুলে, কাঠ ব্যবসায়ী এবং অন্যদের লাভমুখী তৎপরতায় আজ এই সুন্দরবনও উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে সুন্দরবনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদিত ১৯০টি ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদফতর। এগুলোর মধ্যে ২৪টি প্রকল্প মারাত্মক দূষণকারী ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত। এর অর্থ হলে এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সুন্দরবনের মাটি, পানি ও বাতাসের মারাত্মক দূষণ ও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অর্থায়নে সরকার কয়লাভিত্তিক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে সুন্দরবন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। আপাতভাবে দূরে মনে হলেও সুন্দরবনের মূল এলাকার আশেপাশে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এর বাফার জোন। সেখানে কোনও প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ারই কথা নয়। কিন্তু তা তো করা হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের গাছপালা কেটে সুন্দরবনকে অনেকটাই ন্যাড়া মাথা বানিয়ে ফেলেছে। স্থান পেয়েছে এখন শুঁটকি পল্লি।

আমরা অ্যামাজনের জন্য হাহাকার করি, পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছি দিন দিন। অথচ এই সুন্দরবন নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা হয় না, মন-প্রাণ কিছুই পোড়ে না।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ