X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও স্বাধীনতাবিরোধী বিভ্রান্তি

মো. জাকির হোসেন
৩০ আগস্ট ২০১৯, ১১:১৪আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৫১

মো. জাকির হোসেন

 

জাতির জনককে কারা হত্যা করেছে সে প্রসঙ্গে বক্তৃতা-বিবৃতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে হামেশাই বলা হয় ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি’, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি’, ‘বাংলাদেশবিরোধী শক্তি’, ‘পাকিস্তানের দোসররা’ জাতির জনককে হত্যা করেছে। ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ও ‘বাংলাদেশবিরোধী’ শক্তি, ‘পাকিস্তানের দোসর’, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি’—এ শব্দগুলো উচ্চারিত হলে আমাদের মানসপটে যেসব রাজনৈতিক দলের নাম ভেসে ওঠে সেগুলো হলো জামায়াতে ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। এসব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি যেসব সহযোগী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত তারা হলো শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী ও আল-শামস বাহিনী। সংগঠনের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আমাদের কাছে অতি পরিচিত। তারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মুক্তিকামী মানুষের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এদের মধ্যে প্রয়াত গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাসেম আলী, চৌধুরী মইনুউদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল বলে নাম প্রকাশিত হয়েছে তাদের কেউই জামায়াতে ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সঙ্গে জড়িত নন। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যারা অতি পরিচিত তাদের কারও নাম বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কিংবা বিচারে উঠে আসেনি। বঙ্গবন্ধুর ঘাতক হিসেবে প্রধানত খুনি ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ, একেএম মহিউদ্দিন, আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আবদুল মাজেদ সমধিক পরিচিত। অন্যদিকে, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অন্যদের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোশতাক যতই ষড়যন্ত্র করুক তার ষড়যন্ত্র সফল হতো না যদি না সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। আর মোশতাক ও মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র এগিয়ে নিতে, বাস্তবায়ন করতে পারতো না যদি জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা সম্ভবত সর্বপ্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৬ সালের ২১ এপ্রিল ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় খুনিদের অন্যতম খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে খন্দকার আব্দুর রশিদ সম্পর্কে একটি খবর প্রকাশের মধ্যমে। ওই সংবাদে বলা হয়, মেজর আব্দুর রশিদ মেজর জেনারেল জিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছে, ‘জিয়া যদি তাদের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতাকে হত্যার ব্যাপারে জিয়ার যে ভূমিকা রয়েছে, সে সম্পর্কে সকল গোপন তথ্য তারা ফাঁস করে দেবেন।’ (পরেশ সাহা, মুজিব হত্যার তদন্ত, ১৯৭৮)। এরপর ওই বছরেরই ৩০ মে খুনি ফারুক রহমানের যে বিবৃতি লন্ডনের ‘দ্য সান ডে টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও জিয়ার সম্পৃক্ততা প্রকাশ হয়েছে। ফারুক রহমান বিবৃতিতে দাবি করেন, ‘খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ও আমার ভায়রা কর্নেল অব্দুর রশিদ প্রথমে আমার কাছে মুজিবকে সরিয়ে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর প্রস্তাব দেন। আমি তাতে রাজি হই ও মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান করার প্রস্তাব দেই। মুজিবকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের পর মোশতাক ও জিয়া আমাদের পরিকল্পনায় সম্মত হন।’ (পরেশ সাহা, প্রাগুক্ত)।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে আসে যখন খুনি ফারুক ও রশিদ ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে সানডে টাইমসের সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে আইটিভি টেলিভিশনে World in Action প্রোগ্রামে সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ‘হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিয়াউর রহমানকে অবহিত করা হয় এবং তিনি এগিয়ে যাওয়ার গ্রিন সিগন্যাল দেন। এন্থনি মাসকারেনহাসের বই ‘Bangladesh- A Legacy of Blood’, মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজের ‘Anatomy of A Coup’ প্রতিবেদন ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আসামি ও সাক্ষীদের প্রদত্ত জবানবন্দিতে এ সত্যতার সন্দেহাতীত প্রমাণ মিলে। মাসকারেনহাস লিখেছেন,‘ফারুক জানায়, ২০ মার্চ ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে সে জিয়ার বাসায় তার সঙ্গে দেখা করে এবং তাকে বলে- The country requires a change। উত্তরে জিয়া বলেন, Yes, yes, lets go outside and talk। তখন জিয়া ফারুককে নিয়ে বাইরে বাড়ির লনে যায়। সেখানে ফারুক পুনরায় বলে, We have to have a change. We, the junior officers, have already worked it out. We want your support and leadership। জিয়া বলে, If you want to do something, you junior officers should do it yourself …’। ফারুক-রশিদের বক্তব্য অনুযায়ী জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন কিনা এ সন্দেহ দূর করতে মাসকারেনহাস এ বিষয়ে জিয়াকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন। মাসকারেনহাসের ভাষায়, ‘In July, 1976, while doing a TV programme in London on the killing of Sheikh Mujib I confronted Zia with what Farook had said.’ জিয়া এ ব্যাপারে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। জিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়ে মাসকারেনহাস লিখেন, ‘Zia did not deny it- nor did he confirm it.’

জিয়ার বাসায় খুনিদের বৈঠকের বিষয়ে অশোক রায়না তার বই ‘Inside RAW: The Story of India's Secret Service’-এ লিখেছেন, ‘মুজিবের বিরুদ্ধে ক্যু-এর ব্যাপারে খুনিদের সঙ্গে জিয়ার মিটিংয়ের পরে একটি স্ক্র্যাপ পেপার জিয়ার বাসার ট্রেস থেকে উদ্ধার করা হয়। ক্যু পরিকল্পনার স্ক্র্যাপ কাগজটি যত্ন সহকারে গার্বেজ করা হলেও ‘RAW’-এর একজন গুপ্তচর গৃহভৃত্যের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিল্লি পাঠানো হয়। এই স্ক্র্যাপ কাগজে যাদের নাম ছিল তারা হলেন জিয়াউর রহমান, মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর শাহরিয়ার ও জেনারেল ওসমানি।’ জিয়ার সম্পৃক্ততার সত্যতার আরও প্রমাণ মেলে ১৯৯৭ সালে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ও খুনি রশীদের সাক্ষাৎকারে। লিফশুলজের ভাষায়, ‘In 1997 I met Rashid for several hours in an European city… I went over with him exactly what he had told Mascarenhas about Zia’s involvement. Rashid confirmed to me the accuracy of his interview with Mascarenhas’। রশীদ জোরালোভাবে বলে যে, ‘He (Rashid) had met General Zia numerous times prior to the coup and that Zia was fully in the picture’. বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার জড়িত থাকার বিষয়ে খুনি রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদ তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘একদিন রাতে মেজর ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে জানায়, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। জিয়া নাকি বলে, ‘ইফ ইট ইজ এ সাকসেস দেন কাম টু মি। ইফ ইট ইজ অ্যা ফেইলার দেন ডু নট ইনভলব মি।’ জিয়া আরও বলেছেন, ‘শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ এর ক’দিন পর মেজর ফারুক আমার বাসায় এসে রশীদকে বলে যে, জিয়া বলেছে, ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যে দায়িত্ব নিতে পারবে। সে মোতাবেক রশিদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগামসি লেনের বাসায়।’

ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি তার India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan (A Political Treatise) গ্রন্থে খুনি ফারুক রহমানের সঙ্গে জিয়ার অন্তরঙ্গতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ১৯৭৩ সালের বসন্তে জিয়াউর রহমান যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ঢাকা ফেরার পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতি করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। সেই সময় খবর আসছিল, রাওয়ালপিন্ডির হেডকোয়ার্টারে জেনারেলরা হতাশা ও ক্রোধে গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বিষয়ে। আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ছিল, বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক রহমানের একটি স্যুটকেস ও রেজিমেন্ট ব্যাটন ফেরত নেওয়া, যেটি আমার কাছে রক্ষিত ছিল। ফারুক রহমান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে সৌদি সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং অফিসার হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে পাকিস্তান ফিরে যেতে ফারুক যখন লন্ডনে এলেন তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জন হতে চলেছে। ফারুক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ৩ ডিসেম্বর রাতে আমার সঙ্গে এসে দেখা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য তিনি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে নিরাপদে রাখার জন্য ফারুক তার স্যুটকেস ও রেজিমেন্ট ব্যাটনটি আমার কাছে দেন। তিনি বলেন, যুদ্ধে যদি বেঁচে যান তাহলে কোনও এক সময় নিয়ে যাবেন। আর যদি মৃত্যু হয় তাহলে যেন টেমস নদীতে ভাসিয়ে দিই। আমার সঙ্গে সাক্ষাতে জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করলাম, ফারুক রহমান আপনার একজন অধীনস্থ কর্মকর্তা, আপনি কেন তার স্যুটকেস নিতে এসেছেন? জিয়ার উত্তর ছিল, অধীনস্থ হলেও আমার সঙ্গে ফারুকের সম্পর্ক চমৎকার এবং এটি নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন। প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, ছয় সপ্তাহের ওয়াশিংটন সফরে আপনি কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন? তিনি জবাবে বললেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিফেন্স সেক্রেটারি থেকে নিচের দিকের অনেক সিনিয়র অফিশিয়ালের সঙ্গে দেখা করেছেন। এবার আমি জানতে চাইলাম আপনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, পুরনো দিনের কথা ভেবে আপনার নিশ্চয়ই ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশের সঙ্গে দেখা হয়েছে? জবাবে জিয়া বললেন, আমাদের দেখা হয়েছে। চিন্তা করতে লাগলাম একজন উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসার ফারুক রহমানের মতো অধীনস্থ কর্মকর্তার স্যুটকেস নেওয়ার মতো তুচ্ছ কাজ কেন করছেন? তবে কি কোনও বৃহত্তর পরিকল্পনা আছে? সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার? আমি জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু নিয়ে জিয়া-ফারুক রহমানরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নিচ্ছে—এমন মতামত দিয়ে দ্রুত দিল্লিতে রিপোর্ট পাঠাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সেটি সতর্ক বার্তাসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই বার্তা আমলেই নেননি। বললেন, ‘জিয়াউর রহমান ও ফারুক রহমানেরা আমার নিজের ছেলের মতো। ছেলে কখনও পিতাকে হত্যা করে না। ব্যানার্জি ভীতু লোক। তাই এটি পাঠিয়েছে। আমার বাঙালি কখনও আমাকে হত্যা করতে পারে না।’

খুনি ফারুক রহমান মামলার জবানবন্দিতে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে জিয়াই তাকে প্ররোচিত করেছেন। ফারুক বলেন, ‘সময়টা ১৯৭৪। দেশে তখন সেনাবাহিনী দ্বারা অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চলছে। সেই সময় জিয়ার আমার বাসায় আসা-যাওয়া ছিল। তিনি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং একসময় বলছিলেন, ‘তোমরা ট্যাংক টুংক ছাড়া দেশের আর খবরাখবর রাখো কী?’ আমি বলি, দেখতেছি তো দেশে অনেক উল্টা-সিধা কাজ চলছে। আলাপের মাধ্যমে আমাকে ইন্সটিগেট করে বলেছিলেন, ‘দেশ বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করা দরকার।’ ১৯৭৪ থেকেই যে  জিয়ার কার্যকলাপ এবং গতিবিধি ষড়যন্ত্রের পথে এগুচ্ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরেকটি ঘটনায়। তৎকালীন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম তার Making of a Nation Bangladesh- An Economist’s Tale গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৭৪-এর শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে জিয়া তার সঙ্গে দেখা করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘নিকট ভবিষ্যতে’ দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা এমন থাকবে না। নূরুল ইসলামের ভাষায়, ‘He (Zia) was confident that in the not too distant a future, the situation would improve and the prevailing drift and uncertainty would disappear.’ নিঃসন্দেহে জিয়ার এই বক্তব্য ইঙ্গিতবাহী। জিয়া কীভাবে জানেন ‘নিকট ভবিষ্যতে’ দেশে পরিবর্তন আসন্ন? জিয়ার এ মন্তব্য নূরুল ইসলামকেও বিস্মিত করে। তিনি তার বইয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘I was surprised by the tenor of his talk and the confidence with which he spoke about the restoration of political and economic stability.…. particularly by his confidence that in not ‘too distant’ a future….’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিপথ পাল্টে গিয়েছিলো। জিয়ার নেতৃত্বে এটি মিনি পাকিস্তানে রূপ নিয়েছিলো। পাকিস্তানের ইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া হয়েছিলো। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দণ্ডিত ও বিচারাধীন আসামিদের দায়মুক্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। দালাল আইন বাতিল ও ৭৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়েছিলো। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের অপব্যবহারের রাজনীতি উন্মুক্ত করা হয়েছিলো। স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী বানানো হয়েছিলো। প্রজ্ঞাপন জারি করে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তার হত্যাকারীদের শাস্তির বদলে সুরক্ষা দেওয়া ও পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তারপরও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জিয়া, ফারুক রহমান প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। জিয়া বীরোত্তম খেতাব পেয়েছিলেন। তাই জিয়াসহ যেসব মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তারা স্বাধীনতাবিরোধী নাকি পাকিস্তানের দোসর, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন? কেননা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের স্বাধীনতাবিরোধী বলা হলে, যাদের চেহারা ভেসে ওঠে, তাদের আড়ালে খুনি, বিশেষ করে ষড়যন্ত্রীদের অনেকের চেহারা আড়াল হয়ে যায়।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ