X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসে আশুরা-কারবালা

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:১৪আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:২০

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। আর এই মহররমের দশ তারিখকেই পবিত্র আশুরা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বের মুসলমানরা পালন করে আসছে। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্ধ ‘দশ’। মহররমের দশ তারিখ হওয়ার কারণে এই দিনটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে রাজতান্ত্রিক উমাইয়া খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার পাঠানো সেনাবাহিনীর হাতে হজরত মুহাম্মদের (স.) নাতি হজরত হুসাইনের (রা.) শাহাদাৎ বরণ করার সময় থেকে ওই দিনটি তার শাহাদাৎ বার্ষিকী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আশুরার সঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে। পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি, আসমানগুলো ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে চারটি হারাম বা সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ ওই মাসের একটি হলো মহররম। ফলে সৃষ্টির শুরু থেকেই মহররম আল্লাহর নিকট পবিত্র মাস বলে বিবেচিত। এছাড়া ওই মাসের দশ তারিখ বা আশুরার দিন বিভিন্ন যুগে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনার সূচনা হয়েছিল। সেই বিবেচনায় আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
ইসলাম ধর্মমতে, এই আশুরার দিনেই আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টির সূচনা করেন। তিনি এই দিনেই প্রথম মানব হজরত আদমের (আ.) মধ্যে রুহ প্রবেশ করান। এছাড়া, এই আশুরার দিন যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের স্মৃতি বহন করছে, তার অন্যতম হলো, এই দিনে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়াকে (আ.) পৃথিবীতে পাঠানো হয়। এরপর সাড়ে তিনশ’ বছর কান্নাকাটি শেষে এই দিনেই হজরত মুহাম্মদের (স.) উছিলায় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা এবং হজরত ইউনুসকে (আ.) মাছের পেট থেকে উদ্ধারের ঘটনাও এই আশুরার দিনে ঘটে। হজরত সুলায়মান (আ.) তার হারানো রাজত্ব ফেরত পান এবং হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগ ভোগের পর সুস্থ হন এই আশুরার দিনেই। এছাড়া, এই দিনে হজরত ইউসুফ (আ.) চল্লিশ বছর পর পিতা হজরত ইয়াকুবের (আ.) সাক্ষাৎ পান এবং ফেরাউনের হাত থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তার জাতিকে আল্লাহ রক্ষা করেন। এই দিনেই ফেরাউন লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায় এবং হজরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে আল্লাহর নির্দেশে জাহাজ থেকে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন। 

ইসলামি চিন্তবিদদের মতে, কেয়ামত হবে কোনও এক আশুরার দিনে। তাই সব দিক বিবেচনায় এই দিনটি ইসলাম ধর্ম ও ইসলামের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমানে মুসলমানদের কাছে এই দিনটি হজরত হুসাইনের (রা.) শাহাদাৎ বর্ষিকী হিসেবে স্মরণীয়। ইসলামের ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান বিন আফফান (রা.)-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) ও সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হজরত মুয়াবিয়ার (রা.)-এর মধ্যে যে সিফফিনের যুদ্ধ হয়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে খারেজিদের পাঠানো গুপ্তঘাতক আবদুর রহমান বিন মুলজিমের হাতে হজরত আলীর (রা.) শাহাদবরণের পর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা পদে আসীন হন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা হওয়ার কিছু দিন পর হজরত আলীর (রা.) বড় ছেলে হজরত হাসানের (রা.) সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে হজরত হুসাইনের (রা.) পরিবর্তে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন মুয়াবিয়া। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াজিদ খলিফা পদে আসীন হলে হজরত হুসাইন (রা.) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকার মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করেন। 

ইতোমধ্যে ইরাকের কুফার অধিবাসীরাও ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য হজরত হুসাইনের (রা.) কাছে প্রায় ৫০০টি চিঠি পাঠান। কুফাবাসীর কথায় আস্তা রেখে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সম্মত হন হজরত হুসাইন (রা.)ও। তিনি এ লক্ষ্যে কুফার প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য তার চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম কুফায় পৌঁছানের আগেই কুফাবাসী ও হজরত হুসাইনের (রা.) অস্ত্রধারণের বিষয়টি ইয়াজিদ জেনে যান। ফলে তিনি কুফার শাসন-কর্তাকে বহিষ্কার করে আবদুল্লাহ বিন জিয়াদকে শাসক নিযুক্ত করেন। জিয়াদ দায়িত্ব গ্রহণ করেই কুফাবাসীকে অর্থের বিনিময়ে বিকল্পে ভয় দেখিয়ে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করেন। এছাড়া কুফাবাসীর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যও এর জন্য কম দায়ী ছিল না। সৈয়দ আমির আলী তার ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব স্যারাসিনস’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘দূরাকাঙ্ক্ষী, হিংস্র ও উদ্যমী কুফাবাসীদের চরিত্রে অধ্যবসায় ও স্থিরতার চূড়ান্ত অভাব ছিল। তারা দিন থেকে দিনান্তরে নিজেদের মনের খবরই জানত না। কিছু কারণ বা ব্যক্তি বিশেষের জন্য তারা এই মুহূর্তে আগুনের মতো প্রজ্বলিত তো পর মুহূর্তে আবার বরফের মতো শীতল এবং মড়ার মতো উদাসীন।’হজরত হুসাইন (রা.)-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল।

ফলে হজরত হুসাইন (রা.) যখন কুফাবাসীদের সাহায্য করার জন্য ইরাক সীমান্তে হাজির হলেন, তখন তিনি ইয়াজিদ প্রেরিত সৈন্য ছাড়া কোনও কুফাবাসীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। এমতাবস্থায় তিনি প্রতিশ্রুত সাহায্য প্রাপ্তির আশায় ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় শিবির স্থাপন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কুফাবাসীদের ছায়াও খুঁজে না পেয়ে তিনি ইয়াজিদের বাহিনীর নিকট তিনটি প্রস্তাব করেন: 

ক. তাকে মদিনায় ফেরদ যেতে দেওয়া হোক, 
খ. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে প্রেরণ করা হোক, যেন তিনি জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেন 
অথবা 
গ. তাকে নিরাপদে ইয়াজিদের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ করে দেওয়া হোক। 

কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনী তার কোনও অনুরোধই রাখলো না। ফলে কারবালার প্রান্তরে মাত্র ৩০ জন অশ্বারোহী, ৪০ জন পদাতিক এবং ১৭ জন নারী-শিশু নিয়ে তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর মোকাবিলায় অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৭২ জন সহযোদ্ধাসহ তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। ইয়াজিদ বাহিনী শুধু শিশুদের ফোরাত নদীর পানি পান না করতে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা দেখায়নি; তারা হজরত হুসাইনের (রা.) দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে কুফায় দুর্গে নিয়ে যায়। এছাড়া উবায়দুল্লাহ ওই ছিন্ন মস্তকে বেত্রাঘাত করে উল্লাস প্রকাশ করেন। ওই নিষ্ঠুরতা দেখে একজন কুফাবাসী ‘হায়!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। সেদিন থেকে শিয়া বা আলীর সমর্থকরা ‘হায় হুসেন’ বলে আশুরার দিন মাতম করেন।

যদিও আশুরার মূল শিক্ষা হচ্ছে ধৈর্য্য ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়া। হজরত হুসাইনের (রা.) আর্দশে উজ্জীবিত হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত থাকা, সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করায় আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু মুসলমানদের একটি অংশ হুসাইন (রা.) হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আবারও সহিংস হয়ে ওঠে এবং রক্তের হোলি খেলায় আরব উপদ্বীপকে সংঘাতময় করে তোলে। পি. কে হিট্টির ভাষায়, ‘তার পিতার চেয়ে আল-হুসাইনের রক্তদানই আলাদা মতবাদ গড়ার ব্যাপারে শিয়া সম্প্রদায়কে অনেক বেশি প্রেরণা দিয়েছিল। তখন থেকেই ইসলাম ধর্মে মুহাম্মদ যে শিক্ষা তুলে ধরেছিলেন, তাকে অবহেলা করা শুরু হয়।’ 

ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধানগুলো মেনে এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) অনুকরণে আশুরার দিন মুসলমানদের উচিত রোজা রাখা, ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন হওয়া, হজরত হুসাইন (রা.)সহ সব মুসলমানের জন্য প্রার্থনা করা, ইসলামের স্বার্থে ধৈর্যধারণ ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। তাদের মনে রাখা উচি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এল আজ সেই মুহররম মাহিনা। ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ