X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় কারা চালায়?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:২২আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:২৩

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত?’—এমন প্রশ্ন করে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এখন তার শিক্ষাজীবন নিয়েই বিপাকে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এর মধ্যেই জাতীয়ভাবে আলোচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিনা পরীক্ষায় ৩৫ জনকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভর্তি করার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সব মিলিয়ে দেশের পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বড় আলোচনায়।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানুষের কষ্টার্জিত করের পয়সায় চলে, অথচ তারা সারা বিশ্বে একাডেমিক র‌্যাংকিংয়ের কোথাও নেই। কেন নেই, সেই উত্তর বা ব্যাখ্যা আমরা আর চাই না। কিন্তু উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানগুলো, যাদের আমরা জাতির বিবেক বলে জানি, তাদের শিক্ষকরা, উপাচার্যরা যদি নৈতিকতা বা যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হন, তখন দুঃখ করা ছাড়া উপায় থাকে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষার স্বাধিকারের ধারণার সঙ্গে যুক্ত আছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার বিষয়টি। শিক্ষার পঠন-পাঠন, গবেষণা, ডিগ্রি, মূল্যায়ন প্রভৃতি শিক্ষা পরিচালনার সামগ্রিক বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-গবেষক-ছাত্রদের নিয়ে গঠিত সংস্থা। অর্থাৎ শিক্ষা প্রদানের আর্থিক দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষক-শিক্ষাবিদরাই। আবার আর্থিক দায়িত্ব বহনের অজুহাতে কী পড়বে, কে পড়াবে এবং কাকে পড়ানো হবে প্রভৃতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সরকার বা শাসক দলের জন্মাবে না। এটাই হলো সংক্ষেপে শিক্ষা পরিচালনায় স্বাধিকার তথা গণতন্ত্রের ধারণা। আর এই ধারণা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন একটি আইনের মাধ্যমে, যা ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ নামে পরিচিত।

কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই অধ্যাদেশকে ভিত্তি করে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যতটা দলীয় রাজনীতির চর্চা হয়েছে, তার সামান্যও হয়নি গুণগত মানের একাডেমি চর্চা। ছাত্ররাজনীতির সহিংস রূপের পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে চাঁদাবাজি সংস্কৃতি। কিন্তু শিক্ষক রাজনীতির কদর্য রূপও আজ উন্মোচিত। দলের কর্মী হিসেবে তারা নানা বর্ণে বিভাজিত হয়ে যেমন একে অন্যকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করছেন, তেমনি মোকাবিলা করছেন নিজেদেরই, একই বর্ণের ভেতর নানা গ্রুপের জন্ম দিয়ে।   

উচ্চশিক্ষার মান কী ও কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে তর্ক অনেক। উৎকর্ষ বলতে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত আছে অনেক শিক্ষকের। কিন্তু শিক্ষার মান কী করে উন্নত করা যায়, এ অঙ্ক সত্যিই কঠিন। মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সবার আগে যেটা করতে হবে, কোনোরকম আপস না করে ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলার অভ্যাস করতে হবে। এখানেই পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি, ছাত্রনেতাদের উন্নয়ন কাজের জন্য অর্থ দেওয়া, বা  কোনও এক উপাচার্য দূর মফস্বল শহরের ক্যাম্পাসে না গিয়ে কেন উড়োজাহাজে ঘুরেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন সেই শিক্ষকরা, যারা এত অধপতনের মাঝেও একাডেমিক থাকেন, বর্ণ দল করেও যারা নৈতিকতার পথে চলেন।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় একইরকম। ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে সাধারণত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সহিদুজ্জামানের একটা লেখা পড়েছিলাম একটি দৈনিকে, সেখানে তিনি বলছেন—‘বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির কোনো ক্ষেত্র নয়; এটি  শিক্ষা ও গবেষণার জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে চাকরির বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ। কিন্তু বাড়ছে না শিক্ষার গুণগত মান এবং তৈরি হচ্ছে না দক্ষ ও যুগোপযোগী গ্র্যাজুয়েট। গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা লেজেগোবরে।’

ভালোমানের শিক্ষক কাকে বলবো? শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সহজাত ক্ষমতার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থা তাকে তার বিষয়ের মূলনীতিগুলো সহজে বুঝিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। শিক্ষকের কাছে আশা এই, যে জ্ঞান আগে অর্জিত হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সম্যক ধারণা দেওয়া। শিক্ষকের ভূমিকাটা তাই একটু জটিল। তিনি হয়তো নিজের গবেষণা দিয়ে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে কিছু সংযোজন করেন না, কিন্তু ছাত্রছাত্রীর মধ্যে যথাযথ জ্ঞান সঞ্চার করে তাদের এগিয়ে যেতে, নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে সাহায্য করেন। শিক্ষক নিজে উঁচু মানের হবেন, ছাত্রছাত্রীর মধ্যে উঁচু মানের জ্ঞান বিতরণ করবেন, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে দশা, তাতে প্রশ্ন—কেমন স্নাতক তৈরি হয় এসব প্রতিষ্ঠানে?

শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ একটি বড় বিষয়। ভালো পরিবেশ সব সময় ভালো ফল দেয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একসময় এই পরিবেশটা ছিল। কিন্তু এখন নেই। শিক্ষক রাজনীতির কারণে শিক্ষাকে, গবেষণাকে বিসর্জন দিয়ে দলাদলিকেই প্রথিতযশা হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে মেনে নিয়েছে বড় একটা অংশ। অধ্যাপকরা পড়াবেন তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা পড়বে তাদের সাধ্যমতো। ক্যাম্পাস তৈরি করবে একটা পরিবেশ, যাতে ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা বাড়ে। দলাদলির তীব্রতায় যোগ্য শিক্ষকের চেয়ে বেশি নিয়োগ হয় এখন যোগ্য ভোটার।

একটি মঞ্জুরি কমিশন আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আছে ১৯৭৩ সালের একটি অধ্যাদেশ। আমাদের অনেক ভবন আছে, বেতনকড়ি, সুযোগ-সুবিধাও উন্নতির দিকে। কিন্তু যা নেই তা হলো শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাঠামো, গবেষণার পরিবেশের উন্নতির কোনও ভাবনা। শিক্ষক সমাজের মধ্যে পদ-পদবিমুখী মানসিকতা প্রোথিত করা হয়েছে এমনভাবে, তারা শিক্ষার মান বিষয়ে ততখানি গভীর ভাবনায় থাকেন না, যতখানি থাকেন নিজস্ব উন্নয়ন নিয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের সমন্বিত কোনও নীতিমালা নেই। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানও সমান নয় এবং ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈষম্য বিরাজমান। এ বৈষম্য দূর করতে ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে নীতিমালা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায়। উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানো ও সমুন্নত রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে শোনা গিয়েছিল। এই নীতিমালা হলে শিক্ষক নিয়োগের বাণিজ্য, দৌরাত্ম্য, পদোন্নতি জটিলতা, লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব কমাসহ শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে। শিক্ষার মান বজায় রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা নিতেই হবে। এটা করতে পারলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান উন্নত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যও দূর হবে। তবে সবার আগে মনের শুদ্ধতা দরকার। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত শিক্ষাবিদ, নিজের ইচ্ছায় উচ্চশিক্ষিত যেসব জ্ঞানী-গবেষক, যারা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন বুঝবেন, তাদের হাতে শিক্ষার গুণগত মান কখনোই মার খাবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির হাওয়া তো থাকবেই, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ক্যাম্পাসে কী কী প্রবেশ করতে পারবে, তার একটা ফিল্টারিং প্রয়োজন। আমাদের বাঁচতে হবে, আর বাঁচতে হলে শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে। সস্তার স্লোগান চেঁচিয়ে পরিবেশকে দূষিত করলে বাঁচবো না বেশিদিন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ