X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপারেশন ক্লিন পলিটিক্স

প্রভাষ আমিন
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৪০আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৪২

প্রভাষ আমিন বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাজনীতিবিদ পছন্দের দেশের ভিসা রেডি রাখেন, অনেকে টিকিটও রেডি রাখেন। নির্বাচনে ফল উল্টে যাওয়ার আভাস দেখলেই যেন উড়াল দিতে পারেন। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সমান বয়সী এই ‘চোর-পুলিশ’ খেলা। বিএনপি জিতলে আওয়ামী লীগ পালায়, আওয়ামী লীগ জিতলে বিএনপি পালায়। আর এক-এগারো সময়ে অধিকাংশই পালায়। তবে পালানো নেতাদের সংখ্যাটা খুব বেশি না। কখন পালাতে হবে, সেটা আর কেউ জানুক আর না জানুক, সেই নেতা সবচেয়ে ভালো জানেন। কে কতটা নির্যাতন করেছেন, মাস্তানি করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন–সেটা তিনিই ভালো জানেন। যার পাপ যত বেশি, তার পালানোর তাড়া তত বেশি। তবে গত এক যুগ ধরে পালানোর টেনশন নেই কারও।
টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনে এই ভয় ছিল না। কারণ তারা জানতেন, তারা যত অপকর্মই করেন না কেন; শেখ হাসিনা ঠিকই তাদের ক্ষমতায় এনে দেবেন। কিন্তু তারা ভাবতেও পারেননি, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতেই তাদের মাথায় এভাবে আকাশ ভেঙে পড়বে। আওয়ামী লীগ-যুবলীগের অনেক নেতাই উড়াল দিয়েছেন; যারা দেশের বাইরে যেতে পারেননি, তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা অভাবনীয়, অকল্পনীয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাদের কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করেছেন। তাদের সীমালঙ্ঘনের কারণেই আজ দেশজুড়ে চলছে শুদ্ধি অভিযান।

বাংলাদেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস বহু পুরনো। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দফায় দফায় সামরিক সরকাররা এসে রাজনীতিকে নষ্ট করে দিয়েছে। নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তারা তরুণদের হাতে তুলে দিয়েছে অস্ত্র আর রাজনীতিবিদদের জন্য উন্মুক্ত করেছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর দখলবাজি। এভাবে আস্তে আস্তে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এখন দুর্বৃত্তরাই সংখ্যাগুরু হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদরা এখনও আছেন, তবে তারা কোণঠাসা। যার যত লাঠির জোর, যার কাছে যত বেশি চাঁদার টাকা; তার ক্ষমতা তত বেশি, তিনি তত বড় নেতা।

ক’দিন আগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদেরে স্মরণ সভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দেশের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই’। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই স্মরণ সভায় তোফায়েল আহমেদ আরও বলেছিলেন, ‘আমরা ছাত্রজীবনে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেছিলাম। আজকে দেশের পত্রপত্রিকা পড়লে টেন্ডার, টাকার পেছনে ছোটার খবর পড়ি। এগুলো আমরা ভাবতেও পারিনি।’ তোফায়েল আহমেদের ধারণা যে সত্যি, তার প্রমাণ হাতেনাতে পেতে মাত্র চারদিন লেগেছে। ১৮ সেপ্টেম্বর সরকারের শুদ্ধি অভিযানে বেরিয়ে আসে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার জগতের খবর। তোফায়েল আহমেদ যতটা ধারণা করেছিলেন, অবস্থা তারচেয়েও ভয়ঙ্কর। নিছক টেন্ডার বা টাকার পেছনে ছোটা নয়। ঢাকার স্পোর্টিং ক্লাবগুলোকে ক্যাসিনো ক্লাব বানিয়ে ফেলেছে একটি চক্র। সেখানে প্রতি রাতেই ছিল কোটি টাকার ঝনঝনানি।

চলমান অভিযানটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি একধরনের আত্মশুদ্ধি। যারা ধরা পড়ছেন, যাদের নাম আসছে, তারা সবাই সরকারি দলের লোক, গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। ক্যাসিনোর যে চক্রটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি তো দৃশ্যমান। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, এটি শুধু ওপরের অংশ, নিচে লুকিয়ে আছে আরও অনেক রাঘব বোয়াল। ফ্রিডম পার্টি থেকে আসা খালেদ মাহমুদ ভুইয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন ক্যাসিনো সাম্রাজ্য। আর যুবদল থেকে আসা জি কে শামীম সামলাতেন টেন্ডার। তারা এখন যুবলীগের ছায়াতলে। আর তাদের ছায়া দেন যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। অভিযানের শুরু থেকেই আলোচনায় তার নাম। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সম্রাটকে গ্রেফতার করা হবে কিনা, তিনি কোথায় আছেন, তা নিয়ে নানা কৌতূহল। যদিও শোনা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তুলে নিয়েছে, তবে কৌশলগত কারণে এখনই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে না। এখন কৌতূহল হলো, এই সম্রাটদের ছায়া দিতেন কারা? কাদের প্রশ্রয়ে সম্রাটরা আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার বনে গেলেন?

এই সম্রাট-খালেদ-শামীমরা নিজেদের অপরাধটা জানতেন। তাই তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদ তিন গাড়ি অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জি কে শামীম গ্রেফতার হয়েছেন ৭ সশস্ত্র দেহরক্ষীসহ। আর কাকরাইলে যে অফিসে সম্রাট বসতেন, সেটি ছিল দূর্গের মতো। সম্রাট পর্যন্ত পৌঁছাতে নাকি অন্তত পাঁচটি নিরাপত্তা চৌকি পার হতে হতো। তবে সম্রাট-খালেদ-শামীমরাই যে এই অন্ধকার জগতের মূল নিয়ন্ত্রক, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের ওপরেও নিশ্চয়ই আরও অনেকে ছিলেন। ক্যাসিনোর টাকার ভাগ সিনিয়র রাজনীতিবিদ, পুলিশ, এমনকি সাংবাদিকদের কেউ কেউ পেতেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

তবে, শোভন-রাব্বানী বা সম্রাট-খালেদ-শামীমকে দিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাপলে ভুল করা হবে। দেশজুড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন অনেক সম্রাট-খালেদ-শামীম যেমন আছে; তেমনি আছেন অনেক ত্যাগী নেতাও। তৃণমূলেও ছড়িয়ে থাকা এই ত্যাগী নেতারাই আওয়ামী লীগের প্রাণ, তারাই আওয়ামী লীগের শেকড়। রিমান্ডে জি কে শামীম নাকি বলেছেন, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ ঠিক নেই। বাকি সবাইকে চাইলে কেনা যায়, শেখ হাসিনা ছাড়া। তার ধারণাটি আংশিক সত্য। শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগে আরও অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা এখনও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেন। সবাই খালেদ-শামীমের মতো হলে এই সংগঠন টিকতো না। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় বড় পদে থাকা অনেক ছাত্রনেতাকে চিনি, যারা এখনও বাড়ি থেকে টাকা এনে রাজনীতি করেন। দীর্ঘদিন যুবলীগের বড় পদে থাকা অনেকে এখনও সম্মানজনক জীবনযাপনে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। ফেসবুকে দেখলাম, পাঠাও চড়তে গিয়ে একজন দেখেছেন সেই চালক একটি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। এমনকি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ ১৪ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন বলেও পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মতিয়া চৌধুরী মন্ত্রী থাকতেও কারওয়ানবাজারে দরদাম করে সবজি কিনেছেন।

টানা ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় দলে অনেকে আগাছা জন্মেছে। চলমান অভিযানে সুযোগ এসেছে, সেই আগাছা পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগকে আবার সুন্দর আগামীর দিকে এগিয়ে নেওয়ার। এই অভিযানের পর অনেকে বলছেন, এই যে দেখুন, আওয়ামী লীগে সব টেন্ডারবাজ আর ক্যাসিনো সম্রাট। কিন্তু আওয়ামী লীগই দলের এই বিষফোঁড়া দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। দলের ভেতরে এমন একটি অভিযান চালাতে অনেক সাহস লাগে। সেই সাহস আর কারও না থাকলেও শেখ হাসিনার আছে। তার সরকারের সময়ই তার দলের দুর্নীতিবাজ নেতারা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই অভিযান শুরুর পর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছে। ৭৩ বছরে পা দেওয়া শেখ হাসিনা এখন নিছক আওয়ামী লীগ বা বাংলাদেশের নেতা নন, তিনি এখন বিশ্বনেত্রী।

সাধারণ র‌্যাব বা পুলিশ কোনও গুরুত্বপূর্ণ অভিযান চালালে তার একটা নাম দেয়। কিন্তু দেশ ও রাজনীতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ এই অভিযানের কোনও আনুষ্ঠানিক নাম নেই। সম্প্রতি এটিএন নিউজের এক টক শো’তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, এ অভিযানের নাম দিয়েছেন—‘অপারেশন ক্লিন পলিটিক্স’। তার প্রত্যাশা, এই অভিযানের মাধ্যমে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, শুদ্ধ হবে দেশের রাজনীতি। এটা শুধু তার প্রত্যাশা নয়, দেশের সবাই চান, রাজনীতি শুদ্ধ হোক, রাজনীতি ফিরে আসুক রাজনীতিবিদদের হাতে। টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে কিছু নেতাকর্মীর লোভের কারণে আওয়ামী লীগ ভাবমূর্তির যে ভয়ঙ্কর সংকটে পড়েছে, এই অভিযানের মাধ্যমেই যেন তা ফিরে আসে। তবে অভিযান যেন শুধু ক্যাসিনো, ক্লাব, বার আর স্পাতে না হয়। এ আসলে ধ্বংসের উপরিতল। যারা অর্থের বিনিময়ে দলের পদ আর মনোনয়ন বিক্রি করেছেন, ক্ষমতায় যেতে ভোট লাগবে না—এমন ভাবনা থেকে যারা জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন, যারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করেছেন, ব্যাংক লুট করেছেন, যারা মালয়েশিয়া-কানাডায় বাড়ি কিনেছেন, আওয়ামী লীগকে যারা গণমানুষের দল থেকে লুটেরাদের দলে পরিণত করেছেন; তাদের সবার বিরুদ্ধে চাই সর্বাত্মক অভিযান। রাজনীতিটা সত্যি সত্যি ক্লিন হোক। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন একজনই, তিনি শেখ হাসিনা। কারণ তার হারানোর কিছু নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ