X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বিতর্ক

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:০৪আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:০৯

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ জনগণ মুসলমান হলেও ইসলাম ধর্ম নিয়ে আলোচনা বেশ স্পর্শকাতর। যদিও এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কারণ ইসলাম ধর্ম নিয়ে মুক্ত আলোচনার অনুমতি কোরআন ও  হাদিসে রয়েছে। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মুসলমান ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। পাশাপাশি একশ্রেণির রাজনীতিবিদ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতে সদা তৎপর থাকেন। এ কারণে তারা কখনোই মন থেকে ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের তাদের আগ্রহের কমতি না থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ায় তাদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় দিনে দিনে মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ধর্মান্ধ হয়ে পড়ছে। ফলে উদার, সহনশীল, মানবতাবাদী ইসলাম ধর্ম এদেশে স্পর্শকাতর ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। জঙ্গিবাদের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে মুক্ত আলোচনা করতে এখন বৌদ্ধিক সমাজ ভয় পায়। কারণ, এ ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওঁৎ পেতে থাকা ওই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলেই তারা যে কাউকে ইসলাম ধর্মবিরোধী বলতে অথবা নাস্তিক আখ্যা দিতে একটুও দ্বিধা করছে না। ওই ভয়ই মূলত বৌদ্ধিক সমাজকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি অবশ্যই ইসলাম ধর্মের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এ রকমটি চলতে থাকলে অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে আলোচনা স্পর্শকাতর এমনটি প্রতিষ্ঠা পেলে ইসলাম ধর্ম মূল চরিত্র হারিয়ে বিকাশের পথ হারাবে।

সুফি-সাধকদের হাত ধরে যে ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম হিসেবে এদেশে প্রবেশ করে তা শেষপর্যন্ত বিদ্বেষী মনোভাবের তৈরি করবে। ইসলাম ‘সন্ত্রাসবাদীর ধর্ম’ হিসেবে উল্লেখিত হবে। ইসলাম ধর্মের নামে অনৈসলামিক কাজ করা সহজ হয়ে যাবে। অবশ্যই তাতে ওই স্বার্থন্বেষী মহল লাভবান হবে।

ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটা সহজ হবে। তাই ইসলাম ধর্ম নিয়ে আলোচনা স্পর্শকাতর বিষয় নয়। একে নিয়ে মুক্ত আলোচনার অনুমতি ইসলামে আছে, সেই বিষয়টি ইসলাম ধর্মের স্বার্থে সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া দরকার।

দুই.

রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এই ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সারা বাংলাদেশ যখন উত্তাল, তখন ব্যক্তি জীবনে পরিপূর্ণ ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনে না চললেও এরশাদ ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দেন। ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সহানূভূতি লাভের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা। যদিও তার ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ওই ফন্দি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়। কিন্তু তার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও বাতিল করা সম্ভব হয়নি। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদ যে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দিলেন, তা ইসলামসম্মত কিনা, সেই বিষয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলারও সাহস করেননি।

তিন.

ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া কতটুকু ইসলামসম্মত, সেই বিষয়টির চর্চা করতে গিয়ে রাষ্ট্র ধর্ম হবে ইসলাম—কোরআন ও হাদিসের কোথাও এমন বক্তব্য খুঁজে পাইনি। মদিনা সনদ বলছে, মহানবী (সা.) মদিনা রাষ্ট্রে কখনও ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়েও ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে—মহানবীর (সা.) ও তার সাহাবিদের ইসলাম ধর্মের প্রতি ভালোবাসা কি স্বৈরশাসক এরশাদের চেয়ে কম ছিল? এরশাদ বুঝলেন, ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করতে হবে; কিন্তু মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিরা কেন বুঝলেন না? আগেই বলেছি, এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন স্রেফ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। রাজনীতির চাল হিসেবে। আর মহানবী (সা.) ও সত্যযুগের খলিফারা ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রের ফ্রেমে বাঁধেননি এই কারণে যে, মহানবী (সা.)-এর প্রচারিত ইসলাম ধর্ম কোনও একটি জাতি বা গোষ্ঠী বা সমাজ বা রাষ্ট্রের ধর্ম নয়। তিনি ছিলেন বিশ্বনবী। তার প্রচারিত ইসলাম ধর্ম প্রকৃতপক্ষে বিশ্বধর্ম।

 বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য আল্লাহ এই ধর্মকে একমাত্র ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন। কিন্তু যদি মহানবী (সা.) ইসলাম ধর্মকে মদিনা রাষ্ট্রের ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করতেন। তাহলে ইসলাম ধর্ম তার বৈশ্বিক চরিত্র হারাতো বলে আমার মনে হয়। তখন কেবল মদিনার ধর্ম বা আরবদের ধর্ম হিসেবে বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত হতো। পরবর্তী খলিফারাও হয়তো একই কারণে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ করেননি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এদেশের মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের ওই বৈশ্বিক চরিত্র বুঝতে পারেননি বলেই বিনাবাক্য ব্যয়ে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দিলে মেনে নিয়েছেন। খুশিতে গদগদ হয়েছেন! বলে রাখা ভালো, ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে এর বৈশ্বিক চরিত্র পাল্টে রাষ্ট্রীয় চরিত্র দেওয়া হলে তাতে ইসলাম ধর্মের মূল চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসলাম ধর্ম তার বৈশ্বিক চরিত্র হারিয়ে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হয়ে উঠবে।

 আর একটি বিষয় মনে রাখা দরকার—যখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তখনও ইসলাম ধর্ম  ছিল। ভবিষ্যৎতে যদি কখনও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্মও বিলুপ্ত হবে—বিষয়টি এমন নয়। তাই রাষ্ট্রের ওপর ইসলাম ধর্মের মর্যদা বা অস্তিত্ব নির্ভর করে না। আর যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি তুলে ধরছেন, তারা যে বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার তত্ত্ব যদি মুসলমানরা মেনে নেয়; তবে ইসলাম ধর্মই ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে—সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে পৃথিবীর ধর্ম কী হবে? তখন মুসলমানরা কী বলবেন? তারা কি তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার তত্ত্ব মেনে নেবেন? ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্র ধর্ম না থাকলেও ওই দেশের আচেহ প্রদেশের ধর্ম ইসলাম। তেমনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য ধর্মাম্বলীরা যদি দাবি তোলেন—ঠিক আছে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম মেনে নিলাম। কিন্তু আমরাও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমাদের গ্রাম বা শহর বা ইউনিয়নের ধর্ম নির্ধারণ করব? তখন মুসলমানরা কি হিন্দু বা খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণে ওই এলাকা বা অঞ্চলের ধর্ম হিন্দু বা খ্রিষ্ট বলে মেনে নেবেন? প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব বা মর্যাদা নির্ভর করে না সেই বিষয়টি মুসলিমদের উপলব্ধি করতে হবে। না হলে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতার তত্ত্বের ফাঁদে নিজেরাই আটকে যাবে।

মুসলমানদের উচিত হবে, ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে কিনা, সেই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা। এরপর ওই বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিদের চেয়ে যদি কারও ইসলামের প্রতি দরদ বেশি হয়, তাহলে তার ফাঁদে পা না দেওয়াই ভালো। কারও কথায় বিশ্বাস করে হুজুগে না মেতে অলসতা ত্যাগ করে কোরআন ও হাদিসচর্চা করলে মুসলমানরা নিজেরাই অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন। লেবাসের আড়ালে ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবেন। আর মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিরা কেন ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও ইসলামকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ও তা রক্ষা করার রহস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। বর্তমান সরকার রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান বারবার জানালেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্মের বিতর্কের বিষয়টি সুরহা করতে পারেনি। বাহাত্তরের সংবিধান মেনে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বমহিমায় এখনও প্রতিষ্ঠিত করেনি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় স্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই ঘোষণা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তাই সরকারের কাছে অচিরেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গিয়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জোর দাবি জানাই। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ