X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইন করে র‌্যাগিং বন্ধ করতে হবে

লীনা পারভীন
১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৪৭আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৫৮

লীনা পারভীন সম্প্রতি বুয়েটে নিহত হওয়া আবরারের ঘটনার প্রেক্ষিতে বেরিয়ে আসছে সব ভয়াবহ তথ্য। বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে ভর্তি হয় দেশের মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকা ছাত্ররা, সেখানে র‌্যাগিংয়ের নামে চলছে অত্যাচার। এসব নির্মমতার বর্ণনা পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম এই র‌্যাগিং বিষয়টা আসলে কী? আমরা যখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন ‘র‌্যাগ ডে’ পালন করতাম কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে, যেদিন ক্লাস শেষ হয়ে যেত। কিন্তু সেখানে তো আমরা আনন্দ ফুর্তি করতাম। রঙ খেলাখেলি, হৈ-হুল্লোড় করে দিন কাটাতাম। শিক্ষকদের দোয়া নিতাম। তাহলে এ কোন র‌্যাগিং কালচার ঢুকে গেলো আমাদের ছাত্রদের মাঝে?
তবে হ্যাঁ, আমরা শুনতাম ক্যাডেট কলেজে র‌্যাগিং ছিল, যেখানে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের সিনিয়ররা নানা রকম অর্ডার দিতো, আর সেগুলো করতে বাধ্য থাকতো নতুনরা। এভাবে একপ্রকার ওরিয়েন্টেশনের অংশ হিসেবেই করা হতো, যদিও সেগুলো নিয়েও ছিল প্রবল আপত্তি। তবে সেখানে কোনোপ্রকার হিংস্রতার খবর পাওয়া যায়নি। গুগলে ঢুকলাম জানার জন্য—কোথায় কোথায় এর উৎপত্তি এবং কেন? দেখলাম, এই কালচার প্রচলিত আছে কেবল দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে। নানারকম বর্বরতার চিত্রও পাওয়া গেলো এই র‌্যাগিংয়ের নামে।

কী করা হয় এখানে? জানলাম, এখানে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সিনিয়ররা তাদের মনের ইচ্ছামতো নানারকম কর্মকাণ্ড করতে বলে। যেগুলোর বেশিরভাগই শারীরিক কিংবা মানসিক অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে। ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাবিউসিভ (Abusive)। চাইলেই একজনকে মারতেও পারে, তবে কোনও আপত্তি করা যাবে না। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই র‌্যাগিং কালচার এখন সবদেশেই নিষিদ্ধের পথে। ভারতেও আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই র‌্যাগিং কালচার। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল মজা করার অজুহাতে এমন অমানবিক কার্যক্রম চলতে দেওয়া যায় কি?

ভাবাই যায় না, যে ছাত্রটি কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলো প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে, সেই ছাত্রটি পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকছে সিনিয়রদের র‌্যাগিংয়ের ভয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমেই যদি একজন ছাত্র এমন মানসিক পীড়নের মধ্য দিয়ে যায়, তাহলে তার জন্য এটা কতটা অবমাননাকর! এটা কি একবারও ভেবে দেখেছি আমরা?

প্রশ্ন হচ্ছে এই র‌্যাগিং কেন? কী প্রাপ্তি ঘটে এর মাধ্যমে? মূলত র‌্যাগিং শুরু হয়েছিল মজা করার মাধ্যমে নতুনদের পুরনোদের মাধ্যমে পরিচিতি ঘটানোর উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই। দিনে দিনে এটি রূপ নিয়েছে এক ভয়াবহ অত্যাচারে। উচ্চশিক্ষিত কিছু মাস্তান নিজেদের শান দিয়ে প্রস্তুত করতে থাকে কবে কোন জুনিয়রটিকে ইচ্ছামতো হেনস্তা করা যায়। কতভাবে করা যায়। এমন বিকৃত রুচিও কোনও সুস্থ মানুষের হতে পারে?

জানা গেলো, আবরারকে যখন ডেকে নেওয়া হয়েছিল, তখন অন্যরা ভেবেছিল হয়তো র‌্যাগিংয়ের জন্য নেওয়া হয়েছে, তাই তারা এর মধ্যে আর ঢোকেনি বা খোঁজও নেয়নি। তার মানে, র‌্যাগিংয়ের মাত্রা যত ভয়াবহই হোক না কেন, এটিকে মোটামুটি সবাই গ্রহণ করে নিয়েছে। আশ্চর্য লাগে যখন জানি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ নিয়ে কোনও মাথা ঘামায়নি এত বছর। অথচ, দিনের পর দিন হাজার হাজার ছাত্র একইরকমভাবে অত্যাচারিত হয়ে এসেছে। চড়, থাপ্পড়, কিল ঘুষি এমনকি হকিস্টিক দিয়েও চলে এসব র‌্যাগিং।

বাস্তবে এই র‌্যাগিংয়ের নামে চলে আসা অত্যাচার সন্ত্রাসের আরেক নাম। এটা কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ হতে পারে না। পৃথিবীর বেশিরভাগ সভ্য দেশগুলোর একটিতেও এমন র‌্যাগিংয়ের খবর পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ঘটনাই আছে শ্রীলংকা, পাকিস্তান বা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। তবে ভারতে বিভিন্ন রাজ্য সরকার এবং ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ড কমিশনের সম্মিলিত উদ্যোগে আইন করে এ ধরনের র‌্যাগিংকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গায় এন্টি র‌্যাগিং কমিটিও করা হয়েছে। খোলা হয়েছে হেল্প লাইন, যেখানে কেউ র‌্যাগিংয়ের শিকার হলেই সাহায্য চাইতে পারবে।

সময় হয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও আইন করে র‌্যাগিংয়ের নামে চলে আসা সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা। ইউজিসিকে অতি দ্রুত নিয়ম করতে হবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় র‌্যাগিং বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার। ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম গ্রহণসহ জরুরি হেল্প লাইন খুলতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ–একইরকম কালচার যেন আমাদের স্কুল, কলেজগুলোতে জন্ম না নিতে পারে সে লক্ষ্যে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করুন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে কড়া নোটিশ দিতে হবে এগুলো বন্ধে যেন তারা প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়, গঠন করতে হবে ছাত্র, শিক্ষকের সম্মিলিত কমিটি। হলগুলোতে শিক্ষকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। হলে হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে অ্যান্টি-র‌্যাগিং মানসিকতা।

র‌্যাগিং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতই পারে এই রাস্তা থেকে তরুণদের বাঁচাতে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে তার শক্ত ও দৃঢ় অবস্থানের কথা বলে আসছেন, তখন ব্যবস্থা নিতে হবে সামগ্রিক বিবেচনায়। ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারাকে ফিরিয়ে এনে চালু করতে হবে সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থাকে, যাতে করে ছাত্ররা কথা বলার জায়গা খুঁজে পায়। দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে ভেঙে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় অংশ। একজন ছাত্র যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে, তবে তার কাছে পড়ালেখার সুফল আশা করা ভুল। বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে তাদের আদরের সন্তানকে পাঠান শিক্ষা গ্রহণ করতে, আর সে সন্তানকে যদি বিনা কারণে কিছু সন্ত্রাসীর বিকৃত মানসিকতার কাছে লাশ হয়ে ফিরতে হয়, তবে এর দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ