X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব: ব্যাপারখানা কী!

ওমর শেহাব
২৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:১৯আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:১৯

ওমর শেহাব প্রথমেই জানিয়ে রাখি, আমি ভিন্ন একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোম্পানিতে কাজ করি। আমরা আকারে গুগলের একটি পার্কিং লটের চেয়েও ছোট, কিন্তু যেহেতু একই জিনিস বানাচ্ছি, কাজেই সেই অর্থে প্রতিযোগী। আরও প‌্যাঁচ আছে! গুগল আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটি বিনিয়োগকারী, তবে তাদের সঙ্গে আমরা প্রযুক্তিগত তথ্য বিনিময় করি না। প‌্যাঁচের ওপর একটি ‘গিঁট’ও আছে! গুগলের এই অর্জনকে আরেকটি গুগলের মতোই বড় প্রতিষ্ঠান বেশি গুরুত্ব দিতে বারণ করছে, যার নাম আইবিএম। এই আইবিএমের সঙ্গে আমাদের আবার প্রযুক্তিগত তথ্য বিনিময়ের একটি চুক্তি আছে। শুরুতেই এই ব্যাপারগুলো খোলাসা করে নেওয়া জরুরি।
দ্বিতীয়ত, নিজে পেশায় বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞান নিয়ে দেশের কোনও গণমাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো লিখছি, কাজেই আমার উত্তেজনার কোনও শেষ নেই। মুক্তচিন্তক বিজ্ঞানলেখক শহীদ অভিজিৎ রায়ের কথা তাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে!
যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাদের অনেকেরই হয়তো সম্প্রতি গুগলের কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি বা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একটি সংবাদ চোখে পড়েছে। ২৩ অক্টোবর গুগল আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ব্লগে জানায়, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচারে ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি ইউজিং অ্যা প্রোগ্রামেবল সুপারকন্ডাকটিং প্রসেসর’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে [১]। এই প্রবন্ধে তারা দেখিয়েছে সিকোমোর নামে তাদের সর্বশেষ যে কোয়ান্টাম প্রসেসর (আপনার কম্পিউটারে যেমন ইন্টেল পেন্টিয়াম প্রসেসর আছে, তেমন কোয়ান্টাম কম্পিউটারেও প্রসেসর থাকে) আছে সেটি দিয়ে তারা এমন একটি গণনা ২০০ সেকেন্ডে শেষ করেছে, যেটি এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসিতে অবস্থিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার সামিট দিয়ে শেষ করতে দশ হাজার বছর লাগবে [২]!

  গুগলের সিকোমোর প্রসেসর  

নিঃসন্দেহে এটি একটি চমকপ্রদ ঘটনা! অনেক কারণেই একটি মানুষের নজর কেড়েছে। প্রথমত, গুগল মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কাজেই তারা যখন কোনও কিছুতে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে, সেটি কৌতূহল জাগানিয়া। দ্বিতীয়ত, কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম গণনবিদ্যা নিয়েও দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সেই আগ্রহ শুধু উন্নত দেশের মধ্যে আটকে নেই। আমার জানা মতে, বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর একাধিক ছাত্রছাত্রী এই বিষয়ে শেষ বর্ষের গবেষণাটি নিয়মিত করে থাকে। এছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে একটি নিয়মিত সেমিনারও হয়ে থাকে, যেটি ফেসবুকের মাধ্যমে চাইলে যে কেউ দেশের যেকোনও প্রান্তে বসে দেখতে পারে। আমি নিশ্চিত আমার জানার বাইরেও এ নিয়ে দেশে অনেক কাজ হচ্ছে। তৃতীয়ত, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্পও টুইটারে এই নিয়ে তাদের প্রশাসনের কৃতিত্ব দাবি করেছে। কাজেই সেই দেশে যার একমাত্র আগ্রহের বিষয় শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদ, সেও খুব সম্ভবত এ নিয়ে জানে।

আইবিএমের কোয়ান্টাম কম্পিউটার

এই লেখা বোঝার জন্য কারও কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং জানার দরকার নেই। তবে কারও যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে এ নিয়ে আমার একটি চল্লিশ পাতার চার পর্বে লেখা বাংলা প্রবন্ধ আছে, যেটি বিনেপয়সায় এই ওয়েব ঠিকানায় গিয়ে পড়া যাবে (নির্লজ্জ আত্মপ্রচারণার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী) [৩]। পড়লে লাভ, তবে না পড়লে ক্ষতি নেই।

 

এখন তাহলে প্রথমে বলা যাক কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যাপারটি কী। এটি হলো কম্পিউটিং বা গণনার একটি মডেল বা রূপকল্প, যার ভিত্তি হলো পদার্থবিজ্ঞানের ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো শাখা কোয়ান্টাম মেকানিকস।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন ‘বুঝলাম, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম মেকানিকস, তাহলে আমরা যেসব কম্পিউটার (ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ক্যালকুলেটর, ইত্যাদি) ব্যবহার করি, তার ভিত্তি কী?’ খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব কম্পিউটার ব্যবহার করি, তার ভিত্তি আসলে পদার্থবিদ্যা নয়, গণিত। আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে দ্বিমিক পাটিগণিত। আমাদের মুদি দোকানে বাজার করার সময় হিসাব করার জন্য ব্যবহার করি দশভিত্তিক গণিত। কিন্তু দশ ছাড়া অন্য সংখ্যার ভিত্তিতেও সংখ্যা ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। দশভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থায় চার আর পাঁচ যোগ করলে হয় এগারো, কিন্তু আটভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থায় এই যোগের ফল হলো এগারো। দ্বিমিক সংখ্যাব্যবস্থায় চার বা পাঁচ বলে কিছু নেই। এখানে সবচেয়ে ছোট অঙ্ক শূন্য আর সবচেয়ে বড় অঙ্ক এক। কাজেই আপনি দুই পর্যন্ত গুনতে চাইলে দুই অঙ্কের সংখ্যায় যেতে হবে যেটি হলো ১০! ১৮৫৪ সালে জর্জ বুল নামে একজন গণিতবিদ আবিষ্কার করেন, যেকোনও গাণিতিক পদ্ধতিকে দ্বিমিক গণিতের ভাষায় প্রকাশ করা যায়। এর অর্থ হলো আপনি যদি দ্বিমিক গণিতে দক্ষ হন, তাহলে আমাদের দৈনন্দিন গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য দশভিত্তিক গণিতে আপনার নতুন করে দক্ষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি সমস্যাটিকে দ্বিমিক গণিতের ভাষায় অনুবাদ করে সেটিতে আপনার যে দক্ষতা, তা ব্যবহার করে সমাধান করবেন। ১৯৩৭ সালে ক্লদ শ্যানন বৈদ্যুতিক বর্তনীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দ্বিমিক গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেন। গত আট দশকে এই ধারণাটিই বিকশিত হয়ে কম্পিউটার আর ক্যালকুলেটরে রূপ নিয়েছে।

আয়নকিউতে আমরা যে কোয়ান্টাম প্রসেসর ব্যবহার করি তার ছবি। উপরিপাতনের মাধ্যমে যে নীল বিন্দুর সারি বসানো হয়েছে, সেগুলো ইটেরবিয়াম পরমাণুর সত্যিকারের ছবি

যেকোনও প্রযুক্তি প্রথমদিকে অনেক খরুচে হয়। কম্পিউটারও তাই ছিল। তাই প্রথমদিকের কম্পিউটারগুলোতে সবাই শুধু জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতো। কোয়ান্টাম মেকানিকসের দুরূহ সমস্যাগুলো তার মধ্যে অন্যতম। কোয়ান্টাম মেকানিকসের ব্যাপারটি কী? আপনি আয়নার সামনে গিয়ে নিজের দিকে তাকান। আপনার শরীরের শতকরা ৬০ ভাগ হলো পানি। পানি একটি যৌগিক পদার্থ। আপনি যদি একটি বড় গ্লাসে সেই পানি নিয়ে একটু একটু করে কমাতে থাকেন, একসময় আপনার হাতে থাকে একটি মাত্র পানির অণু। একটি পানির অণুতে কী আছে? দুইটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন পরমাণু। আসুন আমরা একটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন পরমাণুর কথা ভুলে যাই। বাকি হাইড্রোজেন পরমাণুতে কী আছে? মাঝখানের জায়গায় একটি ভারী প্রোটন আর একটু বাইরের দিকে একটি হালকা ইলেকট্রন। এখন ধরেন আমি আপনার কাছে জানতে চাইলাম ইলেক্ট্রনের ভর ও গতিবেগ কত। আপনি দুইটি একইসঙ্গে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। কেন? কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকসের একটি মৌলিক সূত্র হলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাসূত্র। এটি বলে প্রকৃতি আপনাকে কখনও একটি কোয়ান্টামকণার সম্পূর্ণ তথ্য দেবে না। এরকম আরও কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। আনন্দের বিষয় হলো, অসঙ্গতিপূর্ণ হলেও এর মধ্যে কোনও লুকোনো রহস্য নেই। এর গণিত ও পদার্থবিদ্যা আমরা পুরোপুরি বুঝি। যে কেউ কয়েক বছরের প্রশিক্ষণের পর এ নিয়ে কাজ করতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করি, যার আড়ালে কোয়ান্টাম মেকানিকস লুকিয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এক্সরে, এমআরআই, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, সার উৎপাদন ইত্যাদি। কাজেই যেকোনও পদার্থের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য কোয়ান্টাম মেকানিকস কীভাবে নির্ধারণ করে, সেটি বোঝা খুব জরুরি। এই মুহূর্তে এইসব কঠিন গণনা করা হয় সুপার কম্পিউটারে, কিন্তু গণনাগুলো এতই জটিল আর বড় যে, খুব বড় যৌগিক পদার্থ বা খুব জটিল মৌলিক পদার্থ হলে সুপার কম্পিউটারও সেগুলো করতে পারে না।

এ কারণেই ১৯৮৫ সালে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান প্রস্তাব করেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের জটিল গবেষণাগুলো এমন কম্পিউটার দিয়ে করা হোক, যার মূলনীতি দ্বিমিক পাটিগণিত নয়, বরং কোয়ান্টাম মেকানিকস। সেক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিকসের গণিতকে দ্বিমিক গণিতে অনুবাদ করার ঝামেলাটা পোহাতে হবে না। শুধু তাই নয়, কোয়ান্টাম মেকানিকসের গাণিতিক সমস্যা, যেটি জটিল সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, সেটি দ্বিমিক গণিতের ভাষায় সহজে অনুবাদ করা যায় না। এ কারণে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সমস্যা একটু জটিল হলেই সবচেয়ে ভোলো সুপার কম্পিউটারেও সেটি সমাধান করা যায় না।

 

লকহিড মার্টিনের সাবেক প্রধান নর্ম অগাস্টিন একবার বলেছিলেন সারা বিশ্বের যে বার্ষিক উৎপাদন (জিডিপি), তার এক-তৃতীয়াংশ কোয়ান্টাম মেকানিকস সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো কোয়ান্টাম মেকানিকসের আরও দ্রুত আর আরও নিখুঁতভাবে করার নতুন কোনও পদ্ধতি আবিষ্কারের বিরাট ব্যবসায়িক মূল্য আছে। কাজেই ফাইনম্যানের স্বপ্ন আর বৈশ্বিক অর্থনীতির দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কারও খুব একটা দেরি হলো না। সবাই হৈ হৈ রৈ রৈ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর চেষ্টা শুরু করলো। প্রথমদিকে এটি সীমাবদ্ধ থাকলো বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি গবেষণাগারের মধ্যে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে পিটার শর নামে এমআইটি’র একজন গণিতবিদ দেখালেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যখন বড়সড় আর শক্তিশালী হবে, তখন সেটি দিয়ে খুব সহজে আমাদের ইন্টারনেটের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ফেলা যাবে। সোজা কথায় আপনার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড তখন আর গোপন থাকবে না (এখনই হার্ট অ্যাটাক করার দরকার নেই, ওই পর্যায়ে যেতে আরও বিশ, ত্রিশ বছর বাকি আছে)। এটি দেখে বিভিন্ন দেশের মিলিটারিও তাদের গবেষণাবরাদ্দে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং যোগ করলো। তখন পর্যন্ত আমরা জানি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে বেশ কিছু দুর্দান্ত কাজ করা যাবে, কিন্তু সেই পর্যায়ে যেতে প্রায় বছর ত্রিশেক লেগে যাবে। কিন্তু ২০১৩ সালে হার্ভার্ডের কিছু গবেষক দেখালেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে কাজের কাজ করতে ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। তারা একটি নতুন পদ্ধতি প্রস্তাব করলেন, যেটি ব্যবহার করে পাঁচ বছর পরে যেসব ছোটখাট-মাঝারি কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসবে, সেগুলো দিয়েই পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের এমন সব কাজ করা যাবে যেটি সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটারও করতে পারবে না। এর মধ্যে আরেক দল গবেষক (উদাহরণ: হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের জিল কালাই) এসে হাজির হলেন, যারা বলে দিলেন কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো এত কঠিন যে, এটি কখনও ঠিকমতো কাজ করবে না। এই দুই দলের টানাপড়েনের মধ্যে ২০১২ সালে ক্যালটেকের বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল (ঘটনাচক্রে তিনি আমাদের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা) কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি বা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব নামে একটি পরীক্ষণের প্রস্তাব করলেন। প্রস্তাবটি হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন একটি কাজ করে দেখাক, যেটি সবচেয়ে ভালো সুপার কম্পিউটারেরও করতে গেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।

কয়েক বছর পরে, ততদিনে, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। এদের মধ্যে আছে মাইক্রোসফট, আইবিএম, গুগল, রিগেটি, সাইকোয়ান্টাম, আর আমরা আয়নকিউ। এর মধ্যে গুগলের মনে ধরলো প্রেসকিলের প্রস্তাবটি। তারা ঠিক করলো তারা কোনও সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবে না। তারা কেবল হিজিবিজি হিজিবিজি গণনা করবে (অর্থাৎ গণনার মৌলিক ধাপগুলো দৈবচয়নের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে চালিয়ে যাবে)। এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কম্পিউটারের হিজিবিজি (দৈবচয়নের ভিত্তিতে চালানো গণনার মৌলিক ধাপগুলোর ধারা) আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হিজিবিজির মধ্যে পার্থক্য আছে। আপনার ল্যাপটপের পেছনের গণিতটি হলো দ্বিমিক পাটিগণিত, আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গাণিতিক ভিত্তি হলো জটিল দিকরাশি বা কমপ্লেক্স ভেক্টর স্পেস। শেষেরটি আরও অনেক বিশাল আর ঝামেলাপূর্ণ। গুগল হিসাব করে দেখল, কোয়ান্টাম গণনার এই মৌলিক ধাপগুলো একটু বিশেষভাবে সাজালে কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে যে ফল পাওয়া যাবে, সেই একই ফল সুপার কম্পিউটার থেকে পেতে অনেক সময় লাগবে। সেই আশায় কম্পিউটারটি বানানোর জন্য গুগল ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক জন মার্টিনিসকে ছিনিয়ে নিজেদের কাছে নিয়ে এলো ২০১৪ সালে। গত তিন বছর প্রতিবারই গুগল ঘোষণা দিতো এ বছর বড়দিনের আগেই আমরা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করব। এভাবে ২০১৭ গেলো, ২০১৮-ও গেলো। তারপর কিছুদিন আগে গুগল আবার একই ঘোষণা দিলো, কিন্তু আমরা হেসে উড়িয়ে দিলাম। তারপর অক্টোবরের ২৩ তারিখে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাদের সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রত্যক্ষদর্শী হলাম।

আমাদের কেউ কেউ ব্যাপারটি আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিল, কারণ এই গবেষণায় নাসার যে দলটি সহযোগিতা করেছিল, তাদের একজন ভুল করে খসড়া গবেষণাপত্রটি অনলাইনে কয়েক ঘণ্টার জন্য ফেলে রেখেছিল। কিন্তু আজকে দেখলাম এতে চমক একদমই হারিয়ে যায়নি।

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে, একটি কম্পিউটারে হিজিবিজি গণনা করে কী লাভ? এটি কি কারও কোনও কাজে আসবে? খুব ভালো প্রশ্ন। আসলেই এটি কোনও কাজে আসবে না। তাহলে গুগল কেন করলো? এই কাজটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোনোদিনই সম্ভব হবে না বলে যারা এতদিন দাবি করছিল, তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে পেরেছে। এটি গুগলের বিজ্ঞানীদের জন্য মানসিক শান্তি। এছাড়া আমেরিকায় যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আছে, তাদের প্রতি তিন মাস পর পর আর্থিক প্রতিবেদন দিতে হয়, যার ওপর শেয়ারের মূল্য নির্ভর করে। এই নতুন ঘোষণা হয়তো সেটিতে ভালো প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া কোয়ান্টাম কম্পিউটারে দরকারি কাজ করতে গেলে এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কাজে দেবে।

অনেকে এটাও জানতে চাইতে পারে, আইবিএম কেন এটিকে ছোট করার চেষ্টা করছে [৪]। এটিও একটি ভালো প্রশ্ন। আইবিএমের মতে গুগলের সুপারকম্পিউটারে ১০০০০ বছর লাগার দাবিটি সত্যি নয়। সর্বশেষ আবিষ্কৃত পদ্ধতি ব্যবহার করলে আড়াইদিন লাগবে। আইবিএমের এই দাবিটি সত্যি। কেন সেটি না করার পরও গুগলের গবেষণাপত্রটি গৃহীত হলো, সেটি আমারও একটি প্রশ্ন। কিন্তু যেসব নিরপেক্ষ নিরীক্ষক এটি গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে একজন, স্কট এরনসন, এটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো এটি সত্যি, সেই পদ্ধতি ব্যবহার করলে এখনকার সেরা সুপারকম্পিউটার সামিট আড়াইদিনে কাজটি করতে পারবে। কিন্তু তারপরও সেটি গুগলের সিকোমোর প্রসেসরের চেয়ে একহাজার আশি গুণ ধীর। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই চিন্তাধারার সঙ্গে কিছুটা একমত, কিন্তু সেটি হাতে কলমে প্রমাণ করার আগে নেচারের এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করা উচিত হয়নি। তবে দিনশেষে সম্পাদক যেহেতু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন কারও খুব বেশি কিছু বলার নেই।

পাঠকরা জানতে চাইতে পারেন ‘আচ্ছা গুগল তো কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলো, তোমরা (অর্থাৎ আমার প্রতিষ্ঠান আয়নকিউ) বা আইবিএম কি ভেরেন্ডা ভাজছ?’ খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি আমাদের কথা বলতে পারি। কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। কারণ একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার যখন দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কম্পিউটারের (আপনার মোবাইলফোন আর সামিট সুপার কম্পিউটার এদের সবার গাণিতিক রূপকল্প একটাই—‘ট্যুরিঙ যন্ত্র’) ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তখনও সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে তেমন কিছু করা যায় না! একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রত্যেকটি যুক্তিধাপ বা লজিক্যাল অপারেশনের মানে কিছু খামতি থাকে। একে বলে ফিডেলিটি বা বিশুদ্ধতা। গুগলের সিকোমোর প্রসেসরের ফিডেলিটি ০.৬৪। এটি এক এর যত কাছে হবে, তত ভালো আর যত দূরে হবে তত খারাপ। আপনার কম্পিউটেশন বা গণনা যত লম্বা হবে তত এই সংখ্যাটি নিজের সঙ্গে নিজে গুণ হতে থাকবে। ধরুন আপনার একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই যুক্তিধাপ তিনবার চালাতে হবে। তাহলে শেষমেশ আপনার যে ফল আসবে তার বিশুদ্ধতা হবে ০.৬৪ X ০.৬৪ X ০.৬৪ = ০.২৬। দেখলেন আপনি ১.০ থেকে কত দূরে সরে গেলেন? তাহলে কী উপায়? কী করলে দিন শেষে বিশুদ্ধতা ১.০ এর কাছে থাকবে? এর জন্য আপনার মৌলিক যুক্তিধাপের বিশুদ্ধতা ০.৯ এর যতটা সম্ভব কাছে থাকতে হবে। দশমিকের পরে যত বেশি নয় থাকবে তত ভালো। আমরা আয়নকিউতে সেটার ওপরেই মনোযোগ স্থির রেখেছি। আইবিএমও তাদের মতো করে কাজ করছে।

যে যেভাবে আগাক না কেন, গুগলের এই কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব তাদের জন্য একটি বিশাল অর্জন, তাই তাদের অভিনন্দন!

নাসা যখন ভুলে গুগলের খসড়া গবেষণাপত্রটি ফাঁস করে দেয়, গুগলের দলনেতা জন মার্টিনিস আমাদের সবাইকে একটি ইমেইল করেছিলেন। আমি নিচে সেটি অনুবাদ করে দিলাম।

‘আপনারা সবাই জানেন, আমার খসড়া গবেষণাপত্রটি ইতোমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। অবশ্য, চূড়ান্ত সংস্করণ শিগগিরই বের হবে। এই প্রকল্পে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মান যাচাইয়ের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি ও সেই মান অর্জনের জন্য প্রসেসরটির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মধ্যে সঙ্গত করতে হয় সেটি দেখানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনারা এটি পড়ে দেখবেন এবং কোনও প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। মৌলিক যুক্তিধাপের বিশুদ্ধতা থেকে কীভাবে পুরো প্রসেসরটির বিশুদ্ধতা আমরা নিরূপণ করেছি, সেই নতুন পদ্ধতিটির প্রতি আমরা বিশেষভাবে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

যখন মানুষ অনলাইনে আমাদের প্রসেসরটি ব্যবহার শুরু করবে, আমরা এই পদ্ধতিটি তাদের ব্যবহার করার সুযোগ দেবো। তবে আপনারা নিজেরা যেভাবে নিজেদের প্রসেসরের বিশুদ্ধতা নির্ণয় করেন, সেটি অবশ্যই আমাদের প্রসেসরের ওপরও চালাবেন। নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে বুঝতে পারব কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে কার্যকর।’

তথ্যপঞ্জি:

[১] গুগলের ব্লগ প্রবন্ধ (http://bit.ly/32EgFye, তেইশে অক্টোবর এগারটা একুশ মিনিটে দেখা হয়েছে)

[২] নেচারের প্রবন্ধ (https://go.nature.com/33Y4TPq, তেইশে অক্টোবর এগারটা বাইশ মিনিটে দেখা হয়েছে)

[৩] কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: ব্যাপারখানা কী! ওমর শেহাব (http://bit.ly/2BHu4JS, তেইশে অক্টোবর এগারটা আটত্রিশ মিনিটে দেখা হয়েছে)

[৪] আইবিএমের সমালোচনা (https://ibm.co/3429sbH, চব্বিশে অক্টোবর একটা তিপ্পান্ন মিনিটে দেখা হয়েছে)

লেখক: কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, আয়নকিউ, মেরিল্যান্ড, সংযুক্ত শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ