X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে নতুন আইন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:০৯আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১১

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সংসদে পাস হয়ে গেজেট প্রকাশ, তারপর ১১ মাস রাষ্ট্র নিশ্চুপ। পাত্তা ছিল না সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর। অবশেষে ১ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকর হতে যাচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর গত বছর সংসদে এই আইনটি পাস হয়। আশার কথা এই যে, সড়ক খাতে সক্রিয় একটি মাফিয়া চক্র এই আইনটি কার্যকর করার আগেই সংশোধনের চেষ্টায় প্রভাব বিস্তার করলেও কোনও ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই গত ২২ অক্টোবর (মঙ্গলবার) এই আইনটির গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু করলে নড়েচড়ে বসে সরকার। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করে। কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে অবশেষে এই আইন আলোর মুখ দেখলো।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে যারা কাজ করেন, তাদের সকলের দাবি ছিল এই আইনটিতে ‘সড়ক নিরাপত্তা’ শব্দটি থাকুক এবং চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হোক সর্বনিম্ন এসএসসি। সেটি না করে করা হয়েছে ৮ম শ্রেণি। এরপরও একটি নতুন আইন কার্যকর হচ্ছে, এটিই বড় অর্জন এবং এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই।  

১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারের সময়ে জারি করা ‘দ্য মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিনেন্স’ (মোটরযান অধ্যাদেশ)টি আদালতের নির্দেশে পরিবর্তন করে সড়ক পরিবহন আইন নামে পাস হওয়া আইনে সড়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা রাখা হয়েছে। আইনে পয়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে (চালকদের) পয়েন্ট কাটার সিস্টেম আছে। অর্থাৎ, ড্রাইভার যদি একবার দোষ করেন, তাহলে একটা বা দুইটা পয়েন্ট কাটতে থাকে। এভাবে পয়েন্ট নিল (শূন্য) হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। কোন অপরাধে কত পয়েন্ট কাটা যাবে, সেটা তফসিলে বলা আছে। পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে আর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে না।

ফি বছর ঘটা করে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয় রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে। মাইকে প্রচারিত হয়, পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়, বেতার টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, পথে পথে লিফলেট বিলি হয়, টি-শার্ট পরে র‌্যালি হয়। কিন্তু কাজ কি কিছু হয়? হয় না, কারণ বাস্তবতা হলো—পুলিশের সামনে দিয়েই বাস, ট্রাক আইন ভঙ্গ করছে, বাসে-বাসে রেষারেষি করছে। হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানোর ব্যাপারে কড়াকড়ি হলেও এখনও তা চলছে অনেক ক্ষেত্রে। মোবাইল কানে লোকে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। আর সারা বছর সড়কে কাটাকাটি, খোঁড়াখুঁড়ি তো আছেই। 

বাসমালিকরা বলছেন, চালকদের নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দিয়েছেন তারা। খুবই ভালো কথা। কিন্তু তারা নিজেরাই কিছু মৌলিক নিয়ম মানছেন না। তারা শহরে টার্গেট টিপ বন্ধ করছেন না, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দিয়ে এই পেশাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে আনছেন না এবং গাড়ির ফিটনেস ও চালকের বৈধ লাইসেন্সের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস হচ্ছেন না। সড়ক খাতের শ্রমিকদের কল্যাণের নাম করে যে কোটি কোটি টাকা চাঁদা ওঠে, সেই অর্থ কোথায় যায়, তার কোনও সদুত্তর পরিবহন খাতের পেশিবহুল শ্রমিক নেতাদের কাছে পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের কোনও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এসব শ্রমিক সংগঠন থেকে দেওয়া হয় না, কোনও ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও চোখে পড়ে না। আর যে নাগরিকরা পথ বা গণপরিবহন বেশি ব্যবহার করেন, তারাও রাস্তা বা পরিবহন ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকছেন না। 

আইন কার্যকর হচ্ছে, এটি ভালো খবর। কিন্তু আমরা জানি কী কী কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে এবং কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। অতিরিক্ত গতিতে, ঝুঁকিপূর্ণ যান নিয়ে, বিশেষ করে বাসচালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এই একটি জায়গায় পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের অঙ্গীকার প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইনরক্ষকদের ঢিলেঢালা ভাব ও দুর্নীতির কারণে গাড়িচালকদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়ে। পথচারীদেরও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে আমাদের মানসিকতার আমূল বদল প্রয়োজন। 

বাংলাদেশের পরিবহন খাত প্রায় পুরোটাই বেসরকারি খাতের বাণিজ্য। সরকারি বিআরটিসিও বেসরকারি খাতে লিজেই পরিচালিত হয়। এত এত বাণিজ্য হয়, রাতারাতি কতজন অবাক করা ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন এই খাতে জড়িত হয়ে। কিন্তু তারা কখনও একটি ভালো চালক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান করতে উদ্যোগী হননি। এই আইনে সে দিকটি আনা হয়েছে।  

পরিবহন খাতে সরকারের চ্যালেঞ্জ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণহানি কমানো। চালক, সড়ক, যানবাহন এবং ব্যবস্থাপনা কোনোটিই ঠিক নেই দেশে। দুর্ঘটনা এড়াতে কড়া আইনের পাশাপাশি এসব বিষয়ের উন্নতি প্রয়োজন। জনমানসে সচেতনতাও প্রয়োজন। অনেক সময়েই দেখা যায়, ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে কিংবা চলন্ত বাস থেকে ওঠানামা করার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমাতে আইনের কড়াকড়ি ও সচেতনতা বৃদ্ধি যেমন দরকার, তেমনি ট্রাফিক বিভাগের কাঠামোরও উন্নয়ন প্রয়োজন। দুর্ঘটনা ঘটলে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়, ফলে চিকিৎসার সময়ও কম পাওয়া যায়। 

তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালাতে গিয়ে পথচলতি মানুষকে পিষে দিয়ে যাচ্ছে, কখনও রেষারেষি করতে গিয়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে–প্রতিদিনের এই ছবিটি বদলাতেই হবে। সড়ক আইনের বিরুদ্ধে যারা রাস্তায় শ্রমিকদের নামিয়ে মানুষের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিয়ে পুরো জাতিকে অপমান করেছিল, তাদের জন্য বার্তা–কোনও পরিবর্তন ছাড়াই এই আইন বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তাদের জন্য আরও বার্তা এই যে, বেপরোয়া গাড়ি চালালে আইনি ব্যবস্থা থেকে ছাড় পাবেন না তারা। পুলিশের কাছেও মানুষের দাবি–নতুন আইন কার্যকর হলেই তারা নিশ্চিন্ত থাকবেন না, যথাযথ প্রয়োগ করবেন সেই আইন। 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ফুটবলার
ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ফুটবলার
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
তীব্র গরমে উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
তীব্র গরমে উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ