X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

উপাচার্যের বিজয়, নীতি-নৈতিকতার পরাজয়

মো. জাকির হোসেন
০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:২৫আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৮:৩৯

মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তৃতীয় আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক শিরীন আখতারকে আমরা যখন বরণ করে নিচ্ছি, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ক্ষমতায় টিকে থাকতে বৈধ-অবৈধ সকল পন্থায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খবরে প্রকাশ, দুর্নীতির অভিযোগে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় তিন মাস ধরে আন্দোলন চলছে। উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, সমাবেশ ও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করছেন। ফলে কার্যালয়ে যেতে পারছিলেন না উপাচার্য। এ অবস্থায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে উপাচার্যকে ‘মুক্ত’ করেছেন। উপাচার্য ফারজানা ইসলাম হামলার মাধ্যমে মুক্তির এ ঘটনাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এজন্য তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হামলায় আট জন শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আর উপাচার্য সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী রক্তাক্ত হওয়ার দিনটিকে তার জন্য ‘অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ক্ষমতা ধরে রাখতে উপাচার্য এখানেই ক্ষান্ত হননি। জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা মানেননি। ছেলেদের আটটি হলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হল ছেড়ে যাননি। ছাত্রীরাও হলের তালা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের চারজন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। এদিকে হল ছাড়তে বাধ্য করতে উপাচার্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক যদি কেউ হল ছেড়ে না যান, তবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনবোধে হল খালি করতে পুলিশের সহায়তা নেওয়া হবে। হলে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না। তার মানে আরেক দফা পিটুনির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হুমকি উপেক্ষা করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের অপসারণ আন্দোলন অব্যাহত রাখায় আন্দোলন ঠেকাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর এবার সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল ও অফিস বা আবাসিক এলাকায় শিক্ষার্থীদের অবস্থানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের সব দোকানপাটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান ও উপ-উপাচার্যের শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের ‘দর কষাকষি’র অডিও ফাঁসের পর অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন চলছে। একই অবস্থা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম রোস্তম আলীর কাছে এক চাকরিপ্রার্থীর ঘুষ ফেরত চাওয়ার অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফলে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে উত্তাল পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিন ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা উত্তম-মধ্যম দিয়েও টিকে থাকতে পারেননি। পুলিশ প্রহরায় রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে উপাচার্যকে। বুয়েটে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম অচল, বন্ধ আছে কুয়েট। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও বহুদিন ধরেই পত্রিকার খবরের শিরোনাম হচ্ছে নানা ইস্যুতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত চলছে।
আমি যাদের সঙ্গে আইন পড়েছি, সে সহপাঠীদের দু’জন অস্ট্রেলিয়ার দুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বেশ কয়েকজন উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের বিচারক। একাধিক বন্ধু অতিরিক্ত সচিব ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কয়েকজন প্রথিতযশা আইনজীবী। কেউ সংসদ সদস্য। কয়েকজন রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ও মূল দলের জেলাপর্যায়ের সভাপতি, সম্পাদক। বেসরকারি চাকরি ও উদ্যোক্তা হিসেবেও ভালো অবস্থানে আছেন কয়েকজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলে হয়তো সহপাঠীদের সহকর্মী থাকতাম কোনও এক পেশায়। অন্যান্য বিবেচনার পাশাপাশি মান-সম্মানের সঙ্গে শুদ্ধ জীবন-যাপনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। আজ জীবনের অপরাহ্ণে দাঁড়িয়ে দেখি কতিপয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও উচ্চাভিলাষী কিছু শিক্ষকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশার মান-মর্যাদা মারাত্মক হুমকির মুখে। সম্মানজনক এ পেশাটি ক্রমশই মূল্যহীন হয়ে পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিকে অভিযুক্ত করে সব শিক্ষককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে লাগামহীন মন্তব্য, বক্তব্য দিচ্ছেন। অথচ সত্যিটা হলো আমি আমার গত ২৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি ৯০-৯৫ শতাংশ শিক্ষক কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাদের ওঠবস নেই। সমগ্র চাকরিজীবনে একবারের জন্যও রাজনীতিবিদদের কাছে তদবির-লবিংয়ের জন্য যাননি। তারা নিয়মিত ক্লাস নেন। অতি অপ্রতুল গবেষণার সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও গবেষণা করেন। কিন্তু কয়েকজন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য আর উচ্চাভিলাষী কিছু রাজনৈতিক তদবিরবাজ, লবিংবাজ শিক্ষকের জন্য এ নিরীহ, নিবেদিত শিক্ষকগণ বিনা দোষে জাতির কাছে অভিযুক্ত হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোনও ভদ্রলোক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে উৎসাহবোধ করবেন না। জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্যকে কাছে পেলে জিজ্ঞেস করতাম আপনার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা হচ্ছে না, এর দায় থেকে আপনিও মুক্ত কি? এই যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী একটি ছাত্র সংগঠনের হাতে প্রহৃত হলেন, সে তো কেবল আপনি উপাচার্যের দায়িত্ব কোনোভাবেই ছাড়বেন না, সে কারণেই, তাই নয় কী? উপাচার্য হিসেবে আপনার টিকে থাকার লড়াইয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, শত্রুতামূলক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা শিক্ষার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না? আপনি আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হলো কেন? আপনার একজনের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনে যে অনিশ্চয়তা নেমে এলো, এর জন্য আপনার অনুতাপ হয় না? একজন শিক্ষকের এত পদের ‘লোভ’ থাকা কি ভালো দেখায়? আপনার কারণে পুরো শিক্ষক সমাজকেই যে অনেকে গালি দিচ্ছে, অভিযুক্ত করছে, তার দায় আপনি কীভাবে মেটাবেন? যদি ধরে নেই, আপনার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই মিথ্যা, তাহলেও কি আপনার উচিত ছিল না শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে একটা দিনও আপনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না থাকে? আপনি কি জানেন না, কত গরিব মা-বাবার সন্তান জমিজমা বিক্রি করে, মায়ের কানের দুল, বোনের বিয়ের টাকা খরচ করে, ভাইয়ের চিকিৎসার টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা করছেন। মা-বাবা তাকিয়ে আছেন তাদের সন্তান দ্রুত পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। আপনার উপাচার্যের খায়েশপূরণের ফাঁদে পড়ে যে দরিদ্র মা-বাবার কষ্ট দীর্ঘায়িত হলো, স্বপ্নপূরণ অনিশ্চিত হলো, তার কী হবে? আপনি তো এক মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদেও প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এরপরও শিক্ষক-শিক্ষার্থী পিটিয়ে উপাচার্য পদে থাকতেই হবে কেন? কী এমন জাদুর কাঠি আছে এ পদে? আপনার নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে অনেকদূর এগিয়েছে, এমন খবর শুনিনি। অসম্মানজনকভাবে উপাচার্যের পদ আঁকড়ে না থেকে আরেকজনকে নেতৃত্বের সুযোগ দিতে উদার হতে বাধা কোথায়? আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত—রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অতিসত্বর নেতৃত্বের লোভ করবে। (কিন্তু স্মরণ রেখো) এটি কিয়ামতের দিন অনুতাপের কারণ হবে। সুতরাং তা (ইহলোকে) কত উৎকৃষ্ট ও (পরলোকে) নিকৃষ্ট বিষয়!’ (বুখারি, নাসাঈ)। অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে কোনও দশ ব্যক্তির আমিরকে কিয়ামতের দিন বেড়ি পরানো অবস্থায় উপস্থিত করা হবে। পরিশেষে হয় তাকে তার (কৃত) ন্যায়পরায়ণতা বেড়িমুক্ত করবে, নচেৎ তার (কৃত) অত্যাচারিতা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।’ (আহমাদ, বাইহাকী, সহিহুল জামে)
তথাকথিত গণঅভ্যুত্থান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে জখম-রক্তাক্ত করা, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দিয়ে আপনি বিজয়ীর হাসি হাসলেও পরাজিত হয়েছে নীতি ও নৈতিকতা। পতন হয়েছে শিক্ষার। আর লজ্জাবনত হয়েছেন হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। গোপালগঞ্জের ঘটনার পুনরাবৃত্তির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। সংশ্লিষ্ট সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সকল বিবেচনার ঊর্ধ্বে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের স্বার্থ প্রাধান্য পাক। ঐতিহ্যবাহী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হোক।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ