X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের শিক্ষাঙ্গনেও মহাবিপদ সংকেত

তুষার আবদুল্লাহ
০৯ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:১৬আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৪৮

তুষার আবদুল্লাহ আমি একটি লজ্জা নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি। তখন আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। স্বৈরাচারমুক্ত হয়ে দেশের বিদ্যায়তনগুলোয় ছাত্ররাজনীতির বসন্ত তখন। কলেজে বেলা ১১টার দিকে দুটি বড় ছাত্রসংগঠন মিছিল নিয়ে বের হয়। করিডোর, ক্যাম্পাস ঘুরে এসে সিঁড়ির গোড়াতে মুখোমুখি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে তারা। এ নিয়ে সংঘর্ষ-বিরোধ হতো না কখনও। প্রত্যেকে নিজের মতো করে কর্মসূচি শেষ করতো। এমনই একদিনে মিছিলের দাওয়াত দিতে ওই সময়ের  ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা ক্লাসে ঢুকতে চাইলেন। ইতিহাসের শিক্ষক তখন আমাদের নিয়ে কোনও এক রণক্ষেত্রে। তিনি ওই নেতার দিকে তাকিয়ে ইশারায় অপেক্ষা করতে বললেন। নেতা স্যারের কথা না শুনে ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। আমরা রণক্ষেত্রে থাকা অবস্থাতেই চৌকিতে উঠে স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। আমরা অবাক। বক্তব্য শেষ করে ওই ছাত্রনেতা স্যারের সঙ্গে অশোভন আচরণ করলেন। আমরা হতভম্ব ও ক্ষুব্ধ। ওই ছাত্রসংগঠনের যেসব ছাত্রছাত্রী ক্লাসে ছিল, তারাও ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি। সরাসরি ওই নেতাকে ক্ষোভের কথা জানানো হলো। তিনি খুব একটা পাত্তা দিলেন না। স্যারকে দেখলাম তার সহকর্মীদের কাছে বিষয়টি বললেন, অভিযোগ করলেন অধ্যক্ষ ও  উপাধ্যক্ষের কাছে। কিন্তু তাদের দুঃসাহস ছিল না ছাত্রসংগঠনটির নেতাকে ভর্ৎসনা দূরে থাক, জিজ্ঞাসা করার। কারণ, তারা রাজধানীর প্রভাবশালী ওই কলেজে বদলি আসতে পেরেছিলেন, টিকে ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ বলে কিংবা অনুকম্পায়।

গাভী বৃত্তান্তের ছায়া-প্রচ্ছায়া কলেজ জীবনেই জানা হয়ে গেছে। কলেজ ডিঙিয়ে যাওয়ার পর থেকে আজ অবধি দেশের প্রায় সকল জন বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কাছ থেকে দেখেছি ছাত্রসংগঠনগুলোকে তারা কেমন নিরাপত্তা দেয়াল ভাবেন। বা ছাত্রসংগঠনকে তোয়াজ করে কীভাবে নিজেদের পদ-পদবি টিকিয়ে রাখেন। একাধিক উপাচার্যকে দেখেছি তার ক্যাম্পাসের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকে দেখলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়তে। টেলিফোনে মোসাহেবি ভঙ্গিতে কথা বলতে। ছাত্রসংগঠনের নেতাকে নিজের গাড়িতে তুলতে পেরে একজন উপাচার্যের বুকের ছাতি প্রশস্ত হতে দেখেছি তো এই সেদিনও। সাধারণ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকদের কত উদ্যোগ, উৎসব গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তারা হাতিয়ার ‘ছাত্রসংগঠন’ দিয়ে।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দিয়েই তো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিলমোহর দিয়ে দেওয়া হয়। নিজ নিজ ফ্যাকাল্টি, অনুষদে চলে রাজনীতির নোংরা, বীভৎস অনুশীলন। যার বিস্ফোরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কর্মসূচি ও সংকটে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক রঙহীন শিক্ষক কয়জন আছেন, বলা মুশকিল। রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনমনস্কতা ব্যক্তিগত। অনেক শিক্ষকের পাঠদান ও গবেষণায়ও তা প্রভাব ফেলে। তখন হয়তো তাদের প্রচ্ছন্ন রঙের কথা প্রকাশ্য হতো। কিন্তু যারা রাজনৈতিক দলের প্রতীক প্রকাশ্য বুকে ধারণ করে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করেন, দৃশ্যমাধ্যমের টকশোতে গিয়ে নিজ দলের পক্ষে সাফাই গান ও প্রতিপক্ষের প্রতি হুঙ্কার দেন, তখন তাদের প্রতি সাধারণের শিক্ষক, উপাচার্যসুলভ শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। বরং এ ধরনের ব্যক্তিদের কাছে সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিতে পাঠিয়েছি, এই লজ্জাবোধ হয়।

আমাদের অনেক তারকাখচিত শিক্ষককে দেখেছি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ক্যাম্পাসে টিকে থাকতে। সাধারণ ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি ও সংকটকালে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে। ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আর্থিক সংযোগ নতুন নয়। অতি পুরনো। এখন যোগাযোগমাধ্যম ও তথ্যের জানালা বেড়ে যাওয়ায়, জানাজানিটা বেড়েছে মাত্র। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন এর আগেও কোনও কোনও উপাচার্যকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করেছে। তারা সোনা বা সোনামুখী বলেও উপাধি পেয়েছে। তখন ওই উপাচার্যদেরও হয়তো মনে হয়েছে কোনও ‘গণঅভ্যুত্থান’ তাকে মুক্ত করেছে। হয়তো ‘গণঅভ্যুত্থান’ বিষয় সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান না থাকায়, জুতসই উদাহরণ তুলে ধরতে পারেননি। তবে কেউ না কেউ তো পারবেন, পেরেছেনও। দৃশ্যমাধ্যমে দেখতে হলো শিক্ষকদের একপক্ষ ছাত্রসংগঠনের ‘পেদানি’ খাচ্ছে, অন্যপক্ষ উল্লাসে হাততালি দিচ্ছে। ‘গণঅভ্যুত্থান’-এর উল্লাস। এর বিপরীত চিত্র দেখার অভিজ্ঞতাও সাধারণের আছে। হাততালির পক্ষ কেমন করে বদলে যায় আমরা জানি। এই জানা ও দেখাটাই লজ্জার। যে লজ্জা, সেই কলেজের ইতিহাস ক্লাস থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের শিক্ষকরা রঙহীন না হলে, উপাচার্যরা গণঅভ্যুত্থানের অপেক্ষার প্রহর গুনতেই থাকলে, আমাদের শিক্ষার বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। বিদ্যায়তনে এখন আর শিক্ষা নেই, আছে দলীয় রাজনীতি। শিক্ষা ফিরিয়ে না আনতে পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণি শুধু নয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তানেরাও এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশমুখী। যাদের যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে তারা ফিরে আসার কথা ভাবছেন না। ভাববেন কেন? কোনও শিক্ষকের আদর্শ জিইয়ে রাখার তাড়না যে তাদের মস্তিষ্কে বুনে দেওয়া হয়নি। সত্যিই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এক মহাবিপদ সংকেত জারি রয়েছে। ‘মনরেডিও’-তে কান পাতছি না বলে, আমাদের বিপদ আসন্ন।

লেখক: বার্তাপ্রধান, সময় টিভি

/এসএএস/এমওএফ/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ