X
মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫
২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রাজনীতির মাঠে অরাজনৈতিক শূন্যতা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৩০আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৩২







সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা নূর হোসেন দিবসের প্রাক্কালে গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গকারী নূর হোসেনকে আরও একবার হত্যা করা হলো। অত্যন্ত কদর্য ভাষায় এই শহীদকে এডিকটেড, ইয়াবাখোর আর ফেনসিডিলখোর বলেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। তাকে ক্ষমা চাইতে হবে—এমন একটা দাবি উঠেছে। কিন্তু ক্ষমা চাইলেই এমন অপরাধের ক্ষমা হয় কিনা, সেটা রাজনীতিবিদরাই ভাবুক, কারণ রাজনীতিই আমাদের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু রাজনীতিকের মুখে এমন ভাষাই বলে দিচ্ছে, কারা আমাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।



একটা সময় ছিল বড় রাজনীতিবিদ মানেই তাদের উত্থান ছাত্র রাজনীতির আঙিনা থেকে। সেখান থেকে উঠে এসে দেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন, এমন রাজনীতিকের সংখ্যা এখনও কম না। রাজনীতি সচেতন হতে গেলে ছাত্রাবস্থা থেকেই তা শুরু করার কথা বলে গিয়েছেন অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। রাজধানীকেন্দ্রিক বা যে অঞ্চলেরই হোক, রাজনীতি বা ক্ষমতার বড় পদে থাকা মানুষদের সন্তানরা খুব একটা নেই রাজনীতিতে। তবে তারা রাজনীতি আর ক্ষমতার সুবিধা ভোগ করেই বড় বাণিজ্য বা অর্থ উৎপাদনকারী কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নেই। সরকারি অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় যে ছাত্র রাজনীতি আছে, সেটা কোন রাজনীতি, এমন একটা প্রশ্ন আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বড় মিছিল হয়, আর বাকিদের দেখা যায় প্রশাসনবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা তীব্রতর হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে সময় দেওয়ার চেয়ে সারাদিন লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে। খুব সকালে সূর্য ওঠার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনে লম্বা লাইন দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন এমন বিদ্বজ্জন পয়দা করার জাতি আর নেই সারা বিশ্বে। কিন্তু এটা বিদ্যা শিক্ষা নয়, বিসিএস শিক্ষা। তাই অনেকে মজা করে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছাত্র রাজনীতির প্রতি অনীহার মূল কারণ, ছাত্র রাজনীতিটাই সঠিক পথে নেই। দেশজুড়ে ক্যাম্পাসগুলোয় যে রাজনীতি আছে, তা ছাত্র রাজনীতি নয়। ছাত্রদের একটা অংশের সিরিয়াসনেস বাদ দিলে বিরাজমান ছাত্র রাজনীতি শিক্ষা আর ছাত্রদের স্বার্থের সঙ্গে অসঙ্গিপূর্ণ রাজনীতি। আর দেশের যে রাজনীতি, সেটাও নতুন প্রজন্মকে টানতে পারছে না। কী শাসক, কী বিরোধী, সব পক্ষেই অনেক নেতার বিরুদ্ধে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ, যা মানুষের কাছে সেইসব নেতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, শিক্ষকদের নানা রাজনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শের লড়াইয়ে হিংসা ও চাঁদাবাজি সংস্কৃতির বিকাশ ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।
বুয়েটে আবরার হত্যা, বিএনপির আমলে সনি হত্যা, আগে এবং পরে নানা সহিংস ঘটনা ও রাজনৈতিক ভ্রান্তনীতির প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতে পড়ছে। এই সবকিছু মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক মনোবল যে ধাক্কা খেয়েছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। আর এ কারণে হলে সিট পাওয়ার আশায় ছাত্র রাজনীতি করলেও নতুন করে কেউ সক্রিয়ভাবে, আন্তরিকভাবে ছাত্র সংগঠনে আসতে চাইছে না। আবার নীতি আদর্শ নিয়ে যারা ছাত্র রাজনীতি করতে আসে, এখনকার বাস্তবতা তাদের মনে প্রভাব ফেলছে নেতিবাচকভাবে।
আমাদের দেশে রাজনীতিতে এক অনর্থক এবং দুর্বোধ্য কুনাট্যরঙ্গ চলতেই থাকে। রাজনীতি হলো জনসেবার ক্ষেত্র, সুসংহতভাবে রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তটাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্র। আর এজন্য প্রয়োজন হয় আদর্শের পক্ষে থাকা, দলের আদর্শ ও দেশ সেবায় অবিচল থাকা। কিন্তু সেটি আমরা কমই দেখি রাজনীতিবিদদের মধ্যে। নীতিহীনতা দেখে দেখে রাজনীতির ওপর থেকে সাধারণ নাগরিকদের এক বিরাট অংশের আস্থা এমনিতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বিগত জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে আমরা দেখেছি নির্বাচনে জেতার পর কী ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চলেছে। দেশব্যাপী হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, হিন্দু নারী, বালিকা ধর্ষণের উৎসব চলেছে মাসের পর মাস। এখনও সুযোগ এলেই এই প্রচেষ্টা নেয় একটি পক্ষ। ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগকে বিলীন করে ফেলার চেষ্টাও দেখেছি।
এই প্রতিহিংসার রাজনীতি অতুলনীয়। বিভাজনের কৌশল, বিদ্বেষের মেরুকরণ, প্রতিহিংসার রাজনীতি, ভয় দেখানো, ব্ল্যাকমেইল করা, ক্ষুদ্র রাজনীতিকে অভীষ্ট মেনে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে মতাদর্শের রাজনীতি ভুলে যাওয়ার রাজনীতি এ দেশে। আর এই রাজনীতির সাফল্যের পাসওয়ার্ড একটাই—টাকা। এই অর্থের রাজনীতিই ক্যাসিনো সংস্কৃতি আমদানি করে, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়।
আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি সচেতন হোক। কিন্তু তারা দেখছেন আজকের রাজনীতিটা এক ধরনের বদলা নেওয়ার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। কেবলই প্রতিপক্ষকে বধ করার কৌশল এই রাজনীতিতে। এই রাজনীতিকে কোনোভাবেই উচিত রাজনীতি বলা যায় না। যারা লেখালেখি করেন, তাদের জন্য একটা সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা সহজ ছিল। কারণ সেটা শুধু রাজনীতির ভিত্তিতেই হতো। কিন্তু রাজনীতির আলোচনায় অবধারিতভাবে চলে আসছে অর্থের বিষয়টি। অর্থ যখন রাজনীতির প্রধান উপকরণ হয়, তখন তার বিশ্লেষণ অনেক কঠিন হয়ে যায়, তখন রাঙ্গাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাজনীতিহীনতা যখন রাজনীতির অস্ত্র হয়, তখন রাজনৈতিক মতাদর্শ, কর্মসূচি, স্লোগান, জমায়েত রাজনীতি সচেতন মানুষ এ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যায়। আজ পেশাজীবীদের মাঝে, বাসে, ট্রেনে, পথে-ঘাটে যে রাজনীতির আলোচনা তা জীবন্ত, চলমান ও সৃষ্টিশীল কোনও রাজনীতির আলোচনা নয়। খুব ছোটখাট রাজনৈতিক নেতা যখন চড়া মূল্যের গাড়িতে করে সভাস্থলে আসা যাওয়া করেন, তখন রাজনীতির মাঠে পড়ে থাকে এক অরাজনৈতিক শূন্যতা। অপ্রিয় হলেও সত্য, মশিউর রহমান রাঙ্গার মতো ‘ছোট’ রাজনীতির কারবারিরা, আজ মহাধনাঢ্য ও ক্ষমতাধর হয়ে অসুস্থ রাজনীতিকে সহজ করে দিচ্ছেন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মঙ্গলবার হো‌টেল ল‌বি‌তেই বৈঠক কর‌বেন ড. ইউনূস
মঙ্গলবার হো‌টেল ল‌বি‌তেই বৈঠক কর‌বেন ড. ইউনূস
কী বার্তা আসছে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের প্রথম বৈঠক থেকে
কী বার্তা আসছে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের প্রথম বৈঠক থেকে
ঈদের ছুটি শেষে প্রশাসনে কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ
ঈদের ছুটি শেষে প্রশাসনে কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় নজরে বিরল খনিজ রফতানি
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় নজরে বিরল খনিজ রফতানি
সর্বশেষসর্বাধিক