X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প: একজন আন-আমেরিকান

আনিস আলমগীর
১০ ডিসেম্বর ২০১৫, ০৩:৩৭আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ০২:০৮

Anis Alamgir দুই শতাধিক বছর আমেরিকার কালো-লোকগুলোর ওপর সাদা-লোকগুলো অমানবিক আচরণ করেছিলো। পশুর মতো কালো-লোকগুলোকে খামারে ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতো। কোনও ভুল ত্রুটির কারণে গাছে ঝুলিয়ে মেরে ফেলতেও তারা অপরাধবোধ করতো না। অস্ত্র রাখার অধিকার ছিলো সাদাদের। আর তারা সেই অস্ত্র কালোদের ওপর নির্বিচারে ব্যবহার করতো। আমেরিকার সমাজে কালোরা ছিলো দাস। জন্মসূত্রে সব মানুষ সমান, এ স্বতঃসিদ্ধ সত্য থেকে যে শাসনতন্ত্রের উদ্ভব, সে শাসনতন্ত্রেও কালোদের সম্পর্কে কোনও কথা ছিলো না।

আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্ট হয়ে দাস প্রথা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ তা প্রতিরোধ করতে উদ্ধত হলো। কারণ আমেরিকার চাষাবাদের ক্ষেত্র হলো দক্ষিণ। উত্তর হলো বাণিজ্য সমৃদ্ধ। দীর্ঘ সময়ব্যাপী গৃহযুদ্ধ হলো। কারণ দক্ষিণ দাস প্রথার প্রশ্নে উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিলো। লিংকন যুদ্ধ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করে আমেরিকার সংহতি রক্ষা করেছিলেন। আমেরিকার শাসনতন্ত্রকে বলা হতো প্রজাতান্ত্রিকতার বাইবেল। এ কথাটা যথার্থ নয় তা প্রিসিডেন্ট লিংকন বুঝে ছিলেন। তাই তিনি দাস প্রথা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির মধ্যেও অনেক জনপ্রতিনিধি ছিলেন যারা প্রেসিডেন্ট লিংকনের সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন না। তারা প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন শুধু ইউনিয়নকে রক্ষা করার জন্য। তাদের কাছে দাস প্রথা বিলোপের বিষয়টা ছিলো গৌণ।

দক্ষিণ ডেমোক্রেটদের আধিপত্য, উত্তরে রিপাবলিকানদের দাপট। এরমাঝে ১৮৬৪ সালের নির্বাচন হলো। জন সি ফ্রেমন্ট শেষ পর্যন্ত তার নাম প্রত্যাহার না করলে লিংকন রিপাবলিকান পার্টির দ্বিতীয়বার মনোনয়নই পেতেন না। ফ্রেমন্ট বলেছিলেন- জাতির ক্রান্তিকালে “ঘোড়া বদল না করাই ভাল হবে”। সে নির্বাচনে লিংকনের প্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ বি ম্যাকলিলান পরাজিত হয়েছিলেন। লিংকন ভোট পেয়েছিলেন ২১২টি আর ম্যাকলিলান পেয়েছিলেন ২৫ ভোট।

নিজ দলের বিরোধিতা স্বত্বেও লিংকন শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন ফ্রেমন্ট এর বিজ্ঞজনোচিত কৌশলী সিদ্ধান্তের কারণে। দাস মুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন লিংকন। দাসদের চূড়ান্ত মুক্তি পেতে আরও বহু সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিলো। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালেই নাগরিক অধিকার আইন আর ভোটাধিকার আইন গৃহিত হয়েছিলো। তখনও সুশীলেরা বলেছিলেন- কালোদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে সরকার যেন তাদেরকে বাধ্য না করে। তখন কালোদের নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘আইন করে ভালবাসা আদায় করা যায় না। কিন্তু নিপীড়ন থেকে বাঁচা যায়।’ এখন কালোর সন্তান বারাক হোসেন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

আমেরিকা এমন একটা দেশ যেখানে সম্ভবত বিশ্বের এমন কোনও জাতি নেই যাদের কম হোক আর বেশি হোক- যার লোক সেখানে বসবাস করে না। বর্তমান আমেরিকায় লোক সংখ্যা ৩১ কোটি। এরমধ্যে এক কোটি মুসলমান। বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে তারা আমেরিকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। তারা এখন আমেরিকান।

আমেরিকার ইউরোপের লোকেরাই আদিতে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা এখনও সংখ্যায় বেশি। তারাই ফসল আবাদের জন্য আফ্রিকা থেকে কালো-লোকগুলোকে ক্রীতদাস হিসেবে এনেছিলো। এখন ক্রীতদাস নেই সবাই মুক্ত মানুষ। কিন্তু সাদাদের জুলুম এখনও কমেনি। ২০৪০ সালের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সাদারা আমেরিকায় সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। আফ্রিকান আমেরিকান ও এশিয়ান আমেরিকানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। মাত্র এক প্রজন্ম আগে ওবামার পিতা এসে আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন এখন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। শুরু যখন হয়েছে তখন ইউরোপিয়ান আমেরিকানেরা আর তাদের থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ট্রেডিশন ধরে রাখতে পারবেন না।

আমি এতোসব কাহিনী বলছি পাঠকদের এটা বুঝানোর জন্য যে টানা দড়ি ছিড়ে যায়। সাদারা এক সময়ে কালোদের পাশে বসেনি, এক হোটেলে যায়নি, এক স্কুলে পড়েনি- এখন তাদের সন্তানেরা যারা মিলিটারি এবং পুলিশ বাহিনীতে আছে তারা ওবামাকে স্যালুট করে।

২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কী ডেমোক্রেট, কী রিপাবলিকান- কারও কোনও ভাল প্রার্থী নেই। প্রাইমারিতে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে আছেন আর আর ডেমোক্রেট প্রার্থীদের মাঝে এগিয়ে আছেন হিলারি ক্লিনটন। এরা কেউই উত্তম মেধার মানুষ নন। মধ্যমেধার হাতে গিয়ে একটা সুপার-পাওয়ার এর ক্ষমতা পড়লে বিশ্বের অবস্থাটা কী হবে? আমেরিকার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। ওবামা খুবই কষ্টে-শিষ্টে গত ৮ বছর সামাল দিয়ে আসছেন। সম্ভবতো আমেরিকার আগামী দিনের প্রেসিডেন্টকে আরও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে হবে। এজন্য কোনও উত্তম লোক সাহস করে প্রার্থী হতে চাননি। অনেককে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিসেবে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনকে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। খুবই অভিজ্ঞ লোক। দু-দফা ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। উত্তেজনা ছড়ানো পছন্দ করেন না। কিন্তু তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করারই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোরকেও অনেকে প্রার্থী করানোর চেষ্টা করছেন। তিনিও প্রার্থী হতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে না।

রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প প্রাইমারিতে এখনও অগ্রগামী রয়েছেন। তিনি কয়দিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকায় যত মসজিদ গড়ে উঠেছে সবগুলো ভেঙে দেবেন। সব মহল থেকে এর প্রতিবাদ হয়নি, তবে নিন্দা থেমে থাকেনি তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে তিনি দাবি উত্থাপন করেছেন- আমেরিকায় মুসলমানদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান বন্ধ করে দেওয়ার। এবার শুধু আমেরিকায় নয়, পুরো বিশ্বে ঝড় উঠেছে তার মন্তব্যে। এর থেকে ফুটে উঠছে আমেরিকার আগামী নেতৃত্ব কাদের হাতে পড়ছে এই শঙ্কা। অনেকে বলছেন আমেরিকা আসলে এখন ট্রাম্পদের মতো মাথা মোটাদের দখলে। ট্রাম্পই আমেরিকার প্রতিচ্ছবি। আবার অনেকে মনে করেন সারা বিশ্বে মুসলমানদের যে সন্ত্রাসী ইমেজ তাকে পঁজি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটারদের মন পাওয়ার জন্য একের পর এক মুসলিম বিরোধী কথা-বার্তা বলে যাচ্ছেন। সর্বশেষ ক্যালিফোর্নিয়ায় বন্দুক হামলা তাকে আরও উৎসাহ যুগিয়েছে।

ট্রাম্পের বক্তব্যে এর নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউস । ওবামা বলেছেন, এটা সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিপূর্ণ বক্তব্য। ট্রাম্পের এই কর্মকাণ্ডের নিন্দার পর আমেরিকায় মুসলমানদের অবদান প্রকাশ করে তার জবাব দেওয়া হচ্ছে। অনেক স্থানে ট্রাম্পকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। নিষিদ্ধ করেছে। তাকে ব্রিটেনে প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি এক আবেদনে এর মধ্যে স্বাক্ষর পড়েছে ২ লাখের বেশি মানুষের। পেন্টাগন বলেছে, ট্রাম্প এর বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তার দলেও তার মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের নানা সমালোচনা হচ্ছে। তবে এতো সমালোচনার পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচন থেকে পিছু হটবেন না বলে দিয়েছেন।

আমেরিকার সুশীল সমাজ আমেরিকায় সমাজটার বৈচিত্রের প্রতি লক্ষ্য রেখে যারা কথা বলেন না তাদেরকে আন-আমেরিকান বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষ তারা এটাকে দেশদ্রোহী কার্যকলাপ হিসেবে দেখে। অনেকে এরই মাঝে ট্রাম্পকে আন-আমেরিকান বলে নিন্দা করেছেন। বহু জাতির লোক এসে আমেরিকান জাতিটা গঠন করেছেন। সব ধর্মের লোক সব জাতির লোক আছে এ জাতিটার মাঝে। এমন বৈচিত্র্যের কথা বিস্তৃত হয়ে যারা কথা বলবেন তারা আমেরিকার সর্বনাশ করবেন।

কর্তাদের অপরিনামদর্শিতার কারণেই সাধারণত জাতীয় বিপর্যয়ের উদ্ভব হয়। কালোদের নিয়ে বহু অমানবিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন সাদা আমেরিকানেরা। এখন যদি মুসলমান নিয়ে সেই কর্মটি শুরু করতে চান তবে পরিণাম ভাল ফল হবে না। পোপ ভ্যাটিকান সিটি থেকে আহ্বান জানিয়েছেন খ্রিস্টান আর মুসলমানেরা যেন ভাই-ভাই হিসেবে চলে। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পের উচিৎ ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করা।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ