X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জুড়াও সংসার দাহ

তসলিমা নাসরিন
১৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৩:৩৪আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৬:৩০

Tasleema Nasrin প্রথমে নিলুফার নামের একটি মেয়ের কাহিনি শুনুন। তারপর বলছি যা বলার।

‘শিক্ষিত মেয়ে। দেখেশুনে বিয়ে করানো হয়েছে। মেয়ে দেখতে ভাল, পড়াশোনায় ভাল। বাড়ির সকলে মেয়ে পছন্দ করেছে। কিন্তু মেয়েটির একটি জিনিস কারও পছন্দ হচ্ছে না, মেয়ে সারাদিন বই পড়ে। এ কী মেয়ে, বই নিয়ে এত পড়ে থাকলে চলবে নাকি?  তাহলে কী করতে হবে?  না, ওঠ, বাড়িতে কত কাজ আছে, কর। বাড়ির কাজ আর কী! থালা বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, ঘরবাড়ি ধোয়া মোছা, নাস্তা বানানো, মশলা বাটা, রান্না করা। এসব কাজ মেয়েটির করতে ইচ্ছে হয় না। তার ইচ্ছে হয় বই পড়তে, সে বিজ্ঞান সাহিত্য ইতিহাস ভূগোল যা হোক।

স্বামী অফিসে চলে যায়, ফেরে বিকেলে।বিকেলে ফিরেই স্বামী তাকে ঘরে ডাকে। বলে- ‘চা দাও।’

মেয়েটি চা দেয়।

স্বামী চা খেতে খেতে বলে- ‘বিকেলটা খুব সুন্দর, তাই না?’

মেয়েটিকে বলতে হয়- ‘হ্যাঁ সুন্দর।’

স্বামী সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে—‘আজ অফিসে কি হয়েছে জানো? রকিব সাহেব এক কাণ্ড করলেন...’

রকিব সাহেব, সুলতান সাহেব, হুরমত আলী, আনোয়ার সাহেব….এদের গল্প শুনে বিকেল পার করতে হয় মেয়েটির। তারপর সন্ধেয় স্বামী সিনেমা দেখবেন, নয়ত বেড়াতে বেরোবেন, মাঠে হাঁটবেন,সঙ্গী হতে হবে তার। মেয়েটি হয়ত শুয়ে আছে, মন ভাল লাগছে না। স্বামী বলল- ‘ এসো তো টিভিতে ছবি দেখব এসো।’

- ‘ছবি?  আমার যে ভাল লাগছে না?’

- ‘ভাল লাগছে না মানে? এসো।’

মেয়েটির যখন গান গাইতে ইচ্ছে করছে, স্বামী তাকে রান্নাঘরে চিংড়ির মালাইকারি রাঁধতে পাঠালো। মেয়েটির যখন বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছে, স্বামী তাকে নিয়ে গেল বিছানায়। এভাবে নিজের ইচ্ছেকে মেয়েটি দেখল নিয়ন্ত্রণ করছে সে। নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সে লক্ষ করে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একদিন সে স্বামীকে বলে—‘শোন, আমি কিছু কাজ করব।’

-  ‘কাজ মানে?’

 - ‘কোথাও জব টব যদি পাই।’

- ‘তুমি জব করবে?’

- ‘হ্যাঁ।’

বাড়ির বউ চাকরি করতে চায় জানাজানি হয়ে গেল। ছি ছি রব চারদিকে। শাশুড়ি বললেন- ‘আমাদের খানদানি ফ্যামিলি। কখনও কোনও মেয়ে এ বাড়ি থেকে চাকরি করতে যায় নি।’

মেয়েটি অর্থাৎ নিলুফার জেনে যায়, তাকে চাকরি করতে দেওয়া হবে না। সে এর কোনও কারণ খুঁজে পায় না। বলে – ‘সংসারে তো উপার্জন বাড়ত।’

- ‘আমি কি উপার্জন করছি না? তাছাড়া বাচ্চা কাচ্চা হলে তখন?’

- ‘তখন কী?’

- ‘তখন কী করে চাকরি করবে? বাচ্চা মানুষ করতে হবে না?’

- ‘বাচ্চা কি আমি একা মানুষ করব? তুমি করবে না?’

- ‘আমি বাচ্চা মানুষ করব? বলছ কি তুমি?’

- ‘বাচ্চা কি আমার একার? তোমারও তো!’

বাচ্চা যে তারও মাহবুব জানে। কিন্তু বাচ্চাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, মলমূত্র ত্যাগ করানো, হাঁটানো, কথা বলানো এসব নিলুফারকেই করতে হবে। নিলুফার বুঝে পায় না এগুলো তাকেই কেন করতে হবে। তাকেই কেন সব দায়িত্ব নিতে হবে। আর দায়িত্ব যদি থাকেই তবে চাকরি করতে অসুবিধা কী। সবারই তো উচিত, যে যে কাজে পারদর্শী, তা করা। মানুষ কি কেবল সংসারের জন্যই ত্যাগ করবে, সমাজ বা দেশের জন্য করবে না? তা নাহলে নিলুফার কেমেস্ট্রি নিয়ে পড়ল, কী লাভ হলো তবে, এই সংসারে কেমেস্ট্রি তার কী কাজে লাগবে!

নিলুফার শুয়ে থাকে। ঝাঁক ঝাঁক ভাল-না-লাগা তাকে ঘিরে ধরে। সে বোঝে সে আটকা পড়েছে জালে। এই জাল ছিঁড়ে তার কি কখনও বেরোনো সম্ভব! মাঝে মধ্যে সে নিজেই ভাবতে বসে এই সংসার তাকে কী দিচ্ছে, স্বামী সন্তান আর খাওয়া পরা। ব্যস। এর বাইরে কি মানুষের জীবন নেই? এর বাইরে কি বড় একটা জগৎ নেই? নিশ্চয়ই আছে। নিলুফার বুঝে পায় না সে তার ইচ্ছেগুলো কাকে বোঝাবে। ভেবেছিল স্বামী শিক্ষিত, সে অন্তত বুঝবে। কিন্তু তাই যদি না হয়, নিলুফারের বাকি জীবন কি স্বামী এবং সন্তান সেবায় যাবে, আর কিছু নেই করার? জগত বলতে আর কিছু নেই নিলুফারের? ফসফরাস, সালফার, পটাসিয়াম, সোডিয়ামের বিচিত্র চরিত্র শিখে কী লাভ হলো তবে তার? বড় বিষণ্ণ বসে থাকে সে। স্বামী দেখে ফুঁসে ওঠেন, বলেন- ‘ এ তো বড় মুশকিল হয়েছে। সকালে কী জামা পরব, কোন মোজা, তাও আমাকে খুঁজে নিতে হচ্ছে। জুতোয় ধুলো পড়া। এসব দেখবে কে? বিয়ে করেও যদি এই ভোগান্তি হয়, তাহলে বিয়ে করা কেন! বউ থাকবে হাসি খুশি। তা না, সেও মেজাজ করছে।’

শাশুড়ি চোখ রাঙান। বলেন- ‘ মাহবুবের মন ভাল থাকে না কেন বৌ?’

- ‘তা কী করে বলব?’

- ‘তা তো তোমার জানতে হবে। ওর মন ভাল করার দায়িত্ব তোমার। শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করিয়েছি, ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারবে, দশটা জায়গায় কথা বলতে পারবে। ছেলে মেয়েকে পড়াতে পারবে। লেখাপড়া করেছ, তুমি বুঝবে স্বামীর মন কিসে ভরবে।’

নিলুফার দরজায় দাঁড়িয়ে শোনে কথাগুলো। তার ভাল লাগে না। রাতে স্বামী বাড়ি ফিরলে শাশুড়ি বললেন—‘লেখাপড়া জানা বউ, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গেও মেপে কথা বলে’।

- ‘তাই নাকি?’

- ‘তা নয়ত কী। আমার হয়েছে বিপদ। আত্মীয় স্বজনের সামনে বউ-এর কথা বড় মুখ করে বলব, তাও সম্ভব না। বউ থাকবে বউ এর মতো। তার অত দেমাগ কেন? ননদদেরও মানুষ মনে করে না। ওরা ভাবী বলতে অজ্ঞান। ওদের ভাল মন্দ দেখবে তা তো নয়ই, ওদের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। বাব্বা কী নাক উঁচু।’

মাহবুব চুপ হয়ে শোনে সব। নিলুফার ভেবেছিল শাশুড়ি পুরানো কালের নিয়মে তাকে চালাতে চাইছেন বুঝবে তা মাহবুব। কিন্তু সে তা বুঝলই না বরং শাশুড়ির সামনে নিলুফারকে ডেকে বলল- ‘শোন, তুমি কী চাও বলো তো? সংসারে অশান্তি করতে এসেছ? আমার মা বাবা ভাই বোনকে খুশি করতে পারছ না! তাদের কথা শোন না তুমি। পেয়েছ কী? ভেবেছ এসব করে কিছু আদায় করতে পারবে?’

- ‘আদায়?’

- ‘হ্যাঁ আদায়। ভেবেছ খানিকটা পড়াশোনা করেছ বলে আমার মা বোন তোমার দাসী হয়ে থাকবে?’

- ‘দাসি?’

- ‘হ্যাঁ দাসি। তাই তো ভাবছ তুমি? ভেবেছ আমাকেও নাকে দড়ি বেঁধে ঘোরাবে।’

- ‘কী বলছ এসব?’

- ‘হ্যাঁ ঠিকই বলছি। আমি আজ লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম বাড়ির বউ-এর মতো বাড়িতে থাকবে। এর কোনও অন্যথা হয় না যেন।’

মাহবুবের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল। বলল- ‘তোমার কি খাওয়া পরার কোনও অভাব হচ্ছে? যদি না হয় তবে কী কারণে তুমি সবার সঙ্গে মেজাজ দেখাও?’

নিলুফার কোনও কথা বলে না, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

এরকমই যাচ্ছিল দিন। নিলুফার বুঝে নিয়েছে এখানে তার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও দাম নেই। তার মা দাদীরা যেভাবে জীবন পার করেছে, সেভাবে তার জীবনও পার হবে। মা দাদীরা লেখাপড়া কম জানতেন। সে বেশি জানে বলে যে নিয়ম কিছু বদলাবে তা নয়। নিয়ম একই। বাড়ির কারও সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মাহবুবের সঙ্গেও নয়। সংসারটা তার কাছে গলার ফাঁসের মতো লাগে।

মাহবুব দিন দিন বিরক্ত হচ্ছে। বলছে- ‘তুমি যদি চলে যেতে চাও যাও। তোমাকে দিয়ে আমার চলবে না।’ নিলুফার ভাবছে এভাবে জীবন চলতে পারে না। সে কোনও ময়না বা টিয়ে নয় যে তাকে খাঁচায় আটকে রেখে মানুষগুলো তাকে সংসার শেখাবে। কিন্তু যাবেই বা কোথায় সে। বাবা মারা গেছেন। মা আছেন ভাইয়ের সংসারে। ভাইয়ের সংসারে গেলে নিলুফার বুঝতে পারে এরকম কথাই উঠবে যে নিলুফার খুব বেপরোয়া হয়ে উঠছে, স্বামী সংসারে মন নেই। তাকে এখানে ঠেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে ভাই ভাবী মা সকলে। জগতে কোথাও তার আশ্রয় নেই। যদি একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, রাস্তায় গন্তব্যহীন হাঁটে, লোকে বলবে বেশ্যা। যদি কোথাও চাকরি চায়, অসহায় জেনে চাকরিদাতারা তাকে নিয়ে খেলা করবে। জগতে কোথাও তার জন্য সামান্য আশ্রয় নেই। কোথাও তার ব্যক্তিত্ব, তার মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে সে দাঁড়াতে পারবে না, সকলে তার শরীর খামচে ধরবে। যখন এসব ভাবছে সে তখন রাত, বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। নিলুফার রান্নাঘরে যায়। ইঁদুর মারার ওষুধ হাতে নেয়। নিজেকে তুচ্ছ এক ইঁদুর বলে মনে হয়। পুরুষেরা হচ্ছে ‘মানুষ’, আর মানুষের এই জগতে ইঁদুর হয়ে বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ হয় না ভেবে সে একমুঠো ইঁদুর মারা ওষুধ মুখে নিয়ে গিলে ফেলে। এতে একটি কাজ হয়, নিলুফারের হৃদয় জ্বলছিল সংসারের আগুনে, সেটি জুড়োয়’।

-- না, নিলুফারের এই কাহিনি আমার পছন্দের নয়। পছন্দের নয় কারণ নিলুফার আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়। আমারও নিলুফারের মতো জীবন ছিল। আমি আত্মহত্যা করিনি। আমি লড়াই করে প্রতিববন্ধকতা সরিয়েছি। নিজের পায়ের তলায় মাটি তৈরি করেছি। একা চলেছি। যে মেয়েরা পরাধীন জীবন যাপন করতে রাজি নয়, তাদের একা থাকাই উচিত। অবশ্য যদি ভালো কোনও সঙ্গী জোটে, যে সঙ্গী নারীর অধিকারে একশ পারসেন্ট বিশ্বাস করে। এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে বড়ই কম। তাদের খুঁজে পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণ খুজে পাওয়ার মতো। 

 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ