X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির প্রতীক

প্রভাষ আমিন
১৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৯:১২আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৫:১৮

Probhash Amin নিবার পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজের উদ্বোধন। শুক্রবার অফিসে মুন্নীর (মুন্নী সাহা) সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলছিলাম। রাতে মুন্নী ফোন করে বললো, চল মাওয়া যাই, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আসি। একে তো নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। আমি একপায়ে খাড়া। কিন্তু সহকর্মী শহিদুল আযমের ডে অফ বলে যাওয়ার কথা ভাবিনি। শেষ পর্যন্ত শহিদুল আযমের ডে অফ বাতিল করেই সকাল সকাল রওয়ানা হলাম মাওয়ার উদ্দেশে।
এমনিতে ঢাকার অনেক অনুষ্ঠানে সময়ের অভাবে যেতে পারি না। সেখানে অতদূর ছুটে যাওয়া নিছক একটি অবকাঠামোর নির্মাণের উদ্বোধন দেখতে নয়, সত্যি সত্যি ইতিহাসের সাক্ষী হতে।

আমরা একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঘন কুয়াশার কারণে অনুষ্ঠানও এক ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়েছিল। হাতে অনেক সময়। একাত্তরের ফারজানা রূপা ইলিশ খাওয়াতে আমাদের ঘাটে নিয়ে গেলেন। ঘন কুয়াশার কারণে সেখান থেকে পদ্মা সেতুর কিছুই দেখা গেল না। ঘাট থেকে ফেরার পথে আমি আর মুন্নী আবার গেলাম পদ্মার তীরে। সেতুর কর্মযজ্ঞ দেখবো বলে। কিন্তু কুয়াশা এত ঘন যে ১০ হাত দূরের কিছুও স্পষ্ট দেখা যায় না। অনেক দূরে আবছা আবছা অবকাঠামো দেখা গেল। ব্যাপারটা অনেকটা সিনেমাটিক। অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক বাধার কুয়াশা ভেদ করে আজ সত্যি হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। আবছা হলেও দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পদ্মার বুকে অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে।

বিকালে অফিসে ফিরে আবার মুন্নীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাতের টক শো নিয়ে। টক শোর শিরোনাম কী হবে, তা নিয়ে। কেউ বলছেন, স্বপ্নের সেতু, কেউ- স্বপ্ন হলো সত্যি, কেউ বললেন গর্বের প্রতীক, কেউ বলছেন, মর্যাদার প্রতীক। শেষ পর্যন্ত মর্যাদার প্রতীক হয়েছে। আমি বলেছিলাম, পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির প্রতীক। আসলেই আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির কারণেই পদ্মা সেতু সকল দোলাচল, অনিশ্চয়তা, ষড়যন্ত্রের কুয়াশা ভেদ করে বাস্তব রূপ পাচ্ছে। কোনও টাকা ছাড় হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে শেখ হাসিনা ছাড়া বাকি সবাই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু আপাতত হচ্ছে না। এমনকি অর্থমন্ত্রী নিজেও বারবার বিশ্বব্যাংক-নির্ভরতার কথা বলছিলেন। আসলে আমাদের ভাবনাটাই এতদিন পরনির্ভর, বিদেশনির্ভর ছিল। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি, বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য নির্ভর। খাদ্যসহ সবকিছু আমদানি নির্ভর। দাতাসংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলোকে আমরা হুজুর হুজুর করে চলতাম। আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ মানেই ছিল ঝড়-ঝঞ্জা-জলোচ্ছ্বাস, দারিদ্র্য-মঙ্গা। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা বদলে যেতে থাকি। অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। আমদানির বদলে খাদ্য আমরা রফতানি করি। তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স, ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তিও হয়ে উঠছে আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। দারিদ্র্য কমেছে, মঙ্গা শব্দটিই এখন ডিকশনারিতে ঠাঁই নিয়েছে। অর্থনীতির সবগুলো সূচকেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। দারুণ চমক দেখিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্যানিটেশন-নানা সূচকে রীতিমত উদাহরণ মানা হয় বাংলাদেশকে। এত অগ্রগতির পরও আমাদের মাইন্ডসেটে পরনির্ভরতা রয়েই গিয়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা ব্রিটিশ হাইকমিশনার আমাদের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন কখনও কখনও। কিছু হলেই আমরা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেই, বিচার দেই। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়ে আসলে আমাদের সেই মানসিকতায় প্রচণ্ড আঘাত করেন। আমরাও যে পারি সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আসলে জমানা অনেক আগেই বদলে গেছে। আমি টের পাইনি। নইলে পাঁচ বছর চেষ্টা করেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাননি, ২০ বছর আগে এটা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, আতঙ্কজনক ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিলেন। আর এখন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রশংসা করেন, বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির বিগ প্লেয়ার। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন বলেন, বাংলাদেশ এখন ম্যাটার করে। সত্যি সত্যি বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ম্যাটার করে। আমরা আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছি।

গত কদিন ধরেই পত্রপত্রিকায় টিভিতে পদ্মা সেতু নিয়ে তুলকালাম। ৬.১৮ কিলোমটিার দীর্ঘ এই সেতু দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো, এই সেতু হলে দারিদ্র্য কমবে, জিডিপি বাড়বে, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা। কিন্তু আমার কাছে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অন্য জায়গায়। বিশ্বব্যাংকের টাকায় হলে হয়তো এইসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। কিন্তু পদ্মা সেতু আমার কাছে নিছক একটি সেতু নয়। পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতীক, স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতীক। অনেক সময় টাকা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না, মানসিকতা আটকে রাখে। পদ্মা সেতু আমাদের সেই পরাধীনতার, ভৃত্য মানসিকতার অর্গল থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিশ্বের সবাই দেখেছে, বিশ্বব্যাংকের মুখের ওপর ‘না’ করে দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি। বাংলাদেশে মানে এখন ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস-দারিদ্র্য-মঙ্গা নয়। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশ এখন ক্রিকেটে সমীহ জাগানো নাম। আগে যে জনসংখ্যা সমস্যা ছিল, এখন তা-ই সম্ভাবনা। বাংলাদেশের নারীরা এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের তারুণ্য এখন অমিত সম্ভাবনার আধার। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর আগে এবং পরে- এইভাবে ভাগ হবে। পদ্মা সেতুর পরের বাংলাদেশ সম্ভাবনার, সক্ষমতার দাপুটে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে ভেবেই কবি লিখেছিলেন, জ্বলে পুড়ে ছাড়খার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।

অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। সবকিছুতে আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপি খুঁজি। কিন্তু পদ্মা সেতুকে আমি রাজনীতির বাইরেই রাখতে চাই। গণতন্ত্রহীনতা, মতপ্রকাশে বাধা, বিরোধী দলকে দমন ইত্যাদি নানা সমালোচনা সত্ত্বেও পদ্মা সেতুর কৃতিত্ব আমি বর্তমান সরকারকেই দেব। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পদ্মা সেতুর একক কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তিনি গোঁয়ারের মতো সব বাধা ঠেলে আউট অব দ্য বক্স ভাবতে পেরেছিলেন বলেই আজ পদ্মা সেতু হচ্ছে। বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে তুলে ধরতে শেখ হাসিনার মতো ‘গোঁয়ারে’র বড় বেশি দরকার। পদ্মা সেতু তাই যুগ যুগ শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমি আর আমাদের সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে টিকে থাকবে।

 

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 

ইমেল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ