X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা ঘোষণা হলে সন্ত্রাসমুক্ত কেন নয়?

সালেক উদ্দিন
১৫ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৪:৪২আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৬:৪৭

Salek Uddin সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম বাল্যবিবাহ রোধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লালমনিরহাটের হাতীবান্দা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন বেসরকারি সংস্থা প্লান ইন্টারন্যাশনাল স্বেচ্ছাসেবক ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশে একক এবং এশিয়ায় যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এশিয়া মহাদেশে তিনি ছাড়াও ইন্দোনেশীয় এক নাগরিক রয়েছেন। একইসঙ্গে গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ডের জন্য সাতজনের চূড়ান্ত তালিকায় আছে ফরিদা ইয়াসমিনের নাম।

এই ফরিদা ইয়াসমিন কে? তার অবদানই বা কী?

ফরিদা ইয়াসমিনের বাড়ি হাতীবান্দা শহরের মাস্টার পাড়ায়। ১৯৮১ সালে তিনি বাল্যবিবাহের শিকার হন। নিজের ক্ষেত্রে হয়েছিল বলেই বাল্যবিবাহের কুফল তিনি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন। তখন থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেন। মনে মনে সংকল্প করেন- বাল্যবিবাহের কারণে কোনও মেয়েশিশু যেন তার শৈশব ও স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে, এজন্যই কাজ করবেন। সেই থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি বিএসএস পাস করে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি শিশু সুরক্ষা, জেন্ডার, অ্যাডভোকেসিসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর থেকেই তিনি যেখানেই বাল্যবিবাহের খবর পান সেখানেই হাজির হন। অন্যদের এ কাজে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন।

২০১৩ সালের ১৩ জুন খবর পান লালমনিরহাটের হাতীবান্দা উপজেলার একটি গ্রামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান তিনি। বর ও কনে পক্ষের কাছে বাল্যবিবাহের কুফল তুলে ধরে বিয়ে বন্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু কোনও কাজ হয় না। উভয় পক্ষের কাছে অপমানিত হন। পরে তিনি প্রশাসনের সাহায্যে সেই রাতে অকালে বধূ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ওই ছাত্রীকে। সেই থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬১টি বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছেন এই নারী। তার এই অবদানে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্প্রতি লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন জেলাটিকে বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা ঘোষণা করেছে।

ফরিদা ইয়াসমিনের নিরলস প্রচেষ্টা এবং লালমনিরহাট জেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা ঘোষণাকে আমরা স্যালুট করি। শুধু স্যালুটই করি না বিশ্বাসও করি এভাবেই একদিন পুরো বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। এই আশাবাদের কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হলো- বাল্যবিবাহের সমস্যাটি যদি এভাবে সমাধান হতে পারে তবে দেশ যে সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের ক্যানসারে ভুগছে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কি দূরহ কাজ?

একজন সচেতন মানুষ যদি বলে, একটি জেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণার সাহস যদি আমাদের থাকে, তবে সন্ত্রাসমুক্ত ঘোষণার সাহস আমাদের হয় না কেন? কেউ যদি বলে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিম্নপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ক্ষমতাধর মানুষরা সন্ত্রাসকে লালন করছে, তবে কি সে খুব একটা বেশি ভুল করবে?

দেশের আনাচে কানাচে যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে তার কটার খবরই বা আমরা জানি। গুটি কয়েক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যা শত শত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রিন্ট মিডিয়া বা টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের জানার সুযোগ হয়, খুব বেশি হলে সেই দু-একটা খবরই আমরা জানি। আর এই দু’একটার সংখ্যাও এতো যে এক লেখায় লেখে শেষ করা যায় না। লেখার জন্য এর মধ্যেও বেছে নিতে হয় উল্লেখযোগ্য দু’একটা। যেমন- গত দু’মাসে যে সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হলো তার মধ্যে যে ১০টি হত্যাকাণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে সেগুলো হল: ১. সেপ্টেম্বর ২৮ তারিখে রাজধানীর গুলশানে দুর্বত্তের গুলিতে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা নিহত ২. অক্টোবরের ৩ তারিখে রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোসি হত্যা ৩. অক্টোবরের ৫ তারিখে ঢাকার মধ্য বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান হত্যা ৪. অক্টোবরের ২২ তারিখে ঢাকার গাবতলী পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা ৫. তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হামলায় নিহত হয়েছেন সাজ্জাত হোসেন ও জামাল উদ্দিন ৬. শাহবাগের নিজ কার্যালয়ে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিনকে হত্যা ৭. নভেম্বরের ৪ তারিখে আশুলিয়ায় পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে দুর্বত্তের হামলায় পুলিশ সদস্য মুকুল নিহত ৮. নভেম্বরের ১০ তারিখে রংপুরের কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলীকে হত্যা ৯. নভেম্বরে ২৬ তারিখে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলায় মোয়াজ্জেম হোসেন নিহত।

এছাড়া মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে যারা সংবাদ শিরোনাম হতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ধর্মযাজক লুক সরকার, ধর্মযাজক ফাদার পিয়েরো পিচমকে, কবরস্থানের খাদেম হাসনাইন।

৫ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদীতে ধর্মযাজক লুক সরকাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে ইতালীয় ধর্মযাজক ফাদার পিয়েরো পিচমকে হত্যার জন্য গুলি করা হয়েছিল। ১২ নভেম্বর সৈয়দপুরে হাতীখানা কবরস্থানে প্রতীকী কারবালার খাদেম হাসনাইনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে এরা ৩ জনই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন।

এছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে খবরটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল তা হলো- সরকারি দলের এমপি লিটন কর্তৃক শিশু সৌরভকে নিজ গাড়িতে বসে গুলি করে আহত করার ঘটনা। পুলিশ কর্তৃক এমপি-কে খোঁজে না পাওয়া এবং ওই সময়ে এমপি নিজ অপকর্ম জায়েজ করার জন্য ঢাকায় বসে তদ্বির চালিয়ে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার ও পরে জামিনে মুক্তি। মুক্তির সময় সরকারি দলের স্থানীয় কর্মীরা তাকে ফুলের মালায় বরণ করে মোটর শোভাযাত্রা করে। একজন কলামিস্ট তো এ দৃশ্য দেখে যে কলামটি লেখেন তার শিরোনাম ছিল ‘লিটন ভাই ভালো লোক, ফুলের মালা তারই হোক’।

এগুলো তো গেল হত্যা বা হত্যা চেষ্টার কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নমুনা। বাংলাদেশে এ ধরনের সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এর ব্যাপ্তি বহুদূর। পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল কোনওটাই এর ছোবল মুক্ত নয়। সর্বত্রই চলছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মুক্তিপণ আদায়, অনাদায়ে চার বছরের শিশু কন্যাকেও হত্যা, ব্যবসায়ী অপহরণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সর্বত্র সবসময় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এগুলো যে শুধু এই সময়েই লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা নয়। আগেও ছিল, এখনও আছে। প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির মতোই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ফলে চোখ খুললেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখা যায়।

নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে বর্তমান সরকার দেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেভাবে হাতে নিয়েছে তার কিয়দাংশও অন্য কোনও সরকারের আমলে হয়নি। মানুষ এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফসল ভোগ করতে শুরু করেছে। তারপরও যে কথা না বললেই নয় তা হলো- বর্তমানে দেশময় যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে তা দূঢ়ভাবে রোধ করা না গেলে এই সরকার থেকেও একদিন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে সন্ত্রাস নির্মূল হচ্ছে না কেন? কেনইবা নির্মূলের পরিবর্তে জ্যামেতিক হারে এর বিস্তার লাভ করছে। তার প্রধানতম কারণ হতে পারে যে, সন্ত্রাস চলছে ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায়। সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনও দল থাকে না। সবসময় সরকারি দলই এদের দল। যে দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন কৌশলে সেই দলেই ঢুকেছে। আর সব স্তরের দলনেতারা এদেরকে শক্তির উৎস ভেবে ছায়া দিয়েছে। এদের ব্যবহার করেছে। এরাও দলীয় কর্মের পাশাপাশি তাদের আসল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে নির্ভয়ে।

এখনই সময় এদেরকে চিহ্নিত করার। এখনই সময় এদের পরিত্যাগ করার এবং এখনই সময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রথা চালু করে শাস্তি নিশ্চিত করার। কারণ একটি সমাজের মানুষের সন্ত্রাস প্রবণতা তখনই লোপ পায়, যখন মানুষের মধ্যে এই মর্মে বিশ্বাস জন্মায় যে, সন্ত্রাস করলে কঠিন শাস্তি পেতেই হবে। যখন মানুষের সামনে দৃশ্যমান হয় পূর্বের সন্ত্রাসীরা কত কঠিন শাস্তি পেয়েছে! তখনই মানুষের চিত্ত তাকে সন্ত্রাসি কর্ম থেকে বিরত রাখে।

যাইহোক, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে কথায় যদি ফিরে আসি তাহলে বলতে হয়, ফরিদা ইয়াসমিনদের সম্মান দিয়ে লালমনিরহাট জেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা ঘোষণা করেছেন জেলা কর্তৃপক্ষ। হয়তো একদিন দেখা যাবে লালমনিরহাট জেলা সত্যি সত্যিই বাল্যবিবাহ মুক্ত হয়েছে এবং সেই থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশের সবকটি জেলাই বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এদেশ বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। ঠিক একইভাবে আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে একজন কি তার নিজ এলাকাকে সন্ত্রাস মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা দিতে পারেন না? এবং প্রমাণ করে দেখাতে পারেন না যে, তার এলাকা সত্যি সত্যি সন্ত্রাস মুক্ত? যদি পারতেন তবে তিনিই হতেন উদাহরণ। বাকীরা তাকে অনুসরণ করতো। ফলশ্রুতিতে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশ একটা সন্ত্রাস মুক্ত দেশ হতো।

জাতি অপেক্ষা করছে সেই একজন সাহসি সন্তানের জন্যে যে শুধু মুখে বলবে না, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে জনগণই ক্ষমতার উৎস, সন্ত্রাস নয়। জাতি অপেক্ষা করছে সেই জননেতার জন্যে, যে তার অনুসারীদের মধ্যে সন্ত্রাসীদের বেছে বের করবে এবং পরিত্যাগ করবে। শুধু পরিত্যাগই করবে না সন্ত্রাসীর দৃশ্যমান কঠিন শাস্তির ব্যবস্থাও করবে, যা দেখে আর কেউ কোনওদিন যেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে না জড়ায়। জাতি অপেক্ষা করছে সেই জননেতার জন্যে, যে ঘোষণা করতে পারবে আমার এলাকা সন্ত্রাস মুক্ত, যেভাবে সাহস নিয়ে লালমনিরহাট জেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

আমরাও অপেক্ষায় রইলাম, সেই একজন সাহসি সংসদ সদস্যকে দেখার জন্যে, যে জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে প্রথম এগিয়ে আসবে। নিজ নির্বাচনি এলাকাকে সন্ত্রাস মুক্ত ঘোষণা করবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ