X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাজী আনিস আহমেদের ‘চল্লিশ কদম’: ধর্মীয় মিথ ভাঙার সার্থক প্রয়াস

হাবিব আনিসুর রহমান
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৪৭আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:০২

হাবিব আনিসুর রহমান পাঠ শেষ হলে পাঠকের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন নাড়া দিয়ে উঠবে, পাঠক ভাববেন তিনি কী শুনলেন এতক্ষণ-আসলে ব্যাপারটা কী? আখ্যানটি এভাবে শুরু হয়েছে-কবরে শুয়ে আছেন শিকদার সাহেব, গতকাল সন্ধ্যায় তিনি মারা গেছেন, তিনি যে মারা গেছেন, সে সম্বন্ধে নিজে তিনি খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না বটে, তবে যারা তাকে কবর দিয়েছিল, তারা অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিতই ছিল যে শিকদার সাহেব মারা গেছেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা কাফনে ঢাকা, কবরে শুয়ে তিনি এখন মুনকার আর নাকির এই দুই ফেরেশতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার মনে পড়ছে যে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন মোল্লার খোঁজে, ঠিক তার পরেই কখন কী ঘটে গেছে, সে সম্বন্ধে তার স্মৃতি একদম পরিষ্কার নয়। তিনি মনেই করতে পারছিলেন না কখন তাকে গোর দেয়া হয়েছিল, তবে কোনো কোনো ঘটনা তাকে এমন দুর্দশায় এনে ফেলেছে, তার একটা আনুপূর্বিক পরম্পরা ভেবে নেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি, তিনি যখন ধানখেতের মাঝে একটা আলের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখনই হঠাৎ তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন খেতের মধ্যে, তখন যেই তাকে আবিষ্কার করে থাকুক না কেন-নিশ্চয়ই তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে শিকদার সাহেব মরেই গেছেন। বোঝা গেছে তারা কোনো হাকিম-বৈদ্যর পরামর্শ নেয়ারও চেষ্টা করেনি-তাহলে কি আর শিকদার সাহেব এভাবে কবরে থাকতেন?

মৃত্যুপরবর্তী গোসল আর জানাজা ইয়াকুব মোল্লারই বিশেষ তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভোঁতা একটা কোদাল দিয়ে তারা চটপট একটা গর্ত খুঁড়ে নিয়েছিল, যখন পাশেই শুয়ে শুয়ে শিকদার সাহেব গা থেকে কর্পূরের গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। গর্তের মাপমতো বাঁশের খুঁটি কেটে নিয়েছিল তারা, আর অন্যরা তাকে গর্তে নামানোর তোড়জোড় করছিল। তার চোখ দুটি যদি খোলা থাকত তো তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন মাথার ওপরে আকাশের ছাদটা একটু একটু করে বাঁশের খুঁটিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল-কবরের মুখটায় এক একটা করে বাঁশ সাজিয়ে একটা গড়ানো ছাদের চালই তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। যদি তার চোখ দুটি খোলা থাকত তো তিনি নিশ্চয়ই এই ভীষণ ভুলটাকে শুধরে দিতে পারতেন। তিনি নিজেই অবশ্য আদপেই নিশ্চিত নন তার এই দাফন অকালেই ঘটে গিয়েছে কি না? হয়তো তার বিবিসাহেবা তার ঘুম ভঙিয়ে তাকে যেকোনো মুহূর্তে জাগিয়ে দেবে, তাকে বলবেন যে তিনি সারা রাত ধরে একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলেন, সত্যি কি কারও স্বপ্নের ভেতর অনুভূতির এমন জীবন্ত রূপ বা চিন্তার এমন স্বচ্ছ প্রাঞ্জলতা সম্ভব?

যদি সত্যিই তার মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে সেটা মিলিয়ে দেখে নেয়ার একটাই উপায় আছে-পায়ের আওয়াজগুলো গোনা। চল্লিশ কদম। অন্তত মোল্লা তাকে এ রকমটাই বলেছিলেন, যিনি কিনা কোরান শরিফের সাত-সাতটা প্রচলিত রূপই পড়ে ফেলেছেন। সব হাদিসও পড়া মোল্লার। এত সব পঠন-পাঠনের পরস্পরবিরোধী তথ্য ছেঁকে নেয়ার পর ইয়াকুব মোল্লা শেষটায় নিশ্চিতভাবে এই তথ্যটা জেনে গিয়েছেন: সব মুসলমানকেই মৃত্যুর পর জেরা করতে কবরে আসেন দুজন ফেরেশতা, মুনকার আর নাকির। একজন পরপর লিখে নেন মৃত ব্যক্তি জীবদ্দশায় কী কী ভালো কাজ করেছিল। অন্যজন ফিরিস্তি নেন সব পাপ কাজের।

ইয়াকুব মোল্লা মধ্যযুগের সব শাস্ত্র ঘেঁটে দেখেছেন এবং শিকদার সাহেবকে বলেছেন যে মৃত্যুর পর যারা কবরে মাটি দেন তারা চল্লিশ কদম এগিয়ে গেলেই সেই মুনকার আর নাকির এসে মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা শুরু করে! এই বিষয়টি নিয়ে শিকদার সাহেব একটা ধাঁধার ভেতর ঘুরতে থাকেন, চল্লিশ কদম শেষ না হলে ফেরেশতারা আসবে না কেন? উনচল্লিশ কদম শেষ হলেও তো তারা আসতে পারে! চল্লিশ কদমই শেষ হতে হবে কেন? চল্লিশ সংখ্যাটির এত গুরুত্ব কেন? প্রতিদিন এত মানুষ মরছে কী করে, একই সঙ্গে তারা এসব মৃত মানুষের জেরা সম্পন্ন করতে পারে?

রবারের জুতো পায়ে দেয়া ব্যক্তিরা হেঁটে ফিরছিল কবর দিয়ে, তাদের মধ্যে একজনের পায়ে কাঠের খড়ম ছিল এবং শিকদার সাহেব ওই খড়ম পায়ে দেয়া ব্যক্তির পায়ের শব্দ শুনছিলেন, কেননা ওই ব্যক্তিই শোক পালনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যক্তি এবং তার খড়মের খটখট শব্দই গুনছিলেন শিকদার সাহেব, নয় দশ এগারো ...

কাজী আনিস আহমেদ এভাবে কবর ছেড়ে মানুষ যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কবরে শুয়ে শুয়ে শিকদার কদম গুনছেন আর যা কিছু ভাবছেন, সেই ভাবনাই এই উপন্যাসটির আখ্যান হিসেবে নির্মাণ করেছেন লেখক। এখানে লেখকের গল্প বলার বা পাঠককে গল্প শোনানোর কৌশলটি চমৎকার! শিকদার সাহেব নয় দশ এগারো গুনছেন আর পাঠকও তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ চল্লিশ কদম সম্পন্ন হলে তবেই পাঠক জানতে পারবেন ফেরেশতা দুজন কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল শিকদারকে। এই কৌশল অবলম্বন করেই কাজী আনিস আহমেদ জামশেদপুরের হাটবাজার, শিকদারের বন্ধু চিত্রশিল্পী ডসন, শিকদারের সুন্দরী বেগম সাহেবা নূরজাহান, ইয়াকুব মোল্লার মনোজগতের হদিস আর ডসনের শিল্পভাবনার সঙ্গে পাশ্চাত্যরীতির শিল্পকৌশলের গল্প শুনিয়েছেন।  

শিকদার সাহেব যেদিন মারা গিয়েছিলেন, সেদিন তিনি ঘুম থেকে উঠেছিলেন বুকের মধ্যে একটা অস্থির ব্যথা নিয়ে। তার পক্ষে ঘুম থেকে ওঠার কাজটা মোটেও সহজ কিছু ছিল না। হাতের চেটো দিয়ে তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার বুক ডলে নিয়েছিলেন। যতক্ষণ না তার শ্বাসপ্রশ্বাস বেশ নিয়মিত হয়ে আসে, ততক্ষণ তিনি উঠেই বসেননি।

শোবার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়েই তিনি দাড়ি কামিয়ে নিয়েছিলেন। জানালা থেকে বড় রাস্তা দেখা যায়, জামশেদপুরে সেটাই একমাত্র বাঁধানো রাস্তা। বাকি সবই হয় খোয়া বিছানো, নয়তো কাঁচা রাস্তা। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, আর মঙ্গলবারগুলোতেই শুধু দোকানিদের ওই বড় সড়কে পসরা বিছিয়ে বসতে দেয়া হতো-অন্য সময়ে তারা বসত শহরের বাইরে হাটেবাজারে। শিকদার সাহেবের বাড়ির ঠিক সামনেই বড় সড়কটাকে দখল করে নিয়েছিল মাছওয়ালারা। কেনাবেচার শব্দ আর পচা মাছের দুঃসহ গন্ধ শিকদার সাহেবের জানালা দিয়ে এসে নাকের ভেতরে ঢুকে পড়ত। রাস্তার অন্য পাশে বসত কসাইরা। চামড়া ছাড়ানো সব খাসি আর পাঁঠা লোহার আংটায় ঝুলত। শিকদার সাহেবের বাড়ির কাছটায় বসত হাঁস-মুরগিওয়ালারা, সবজি আর ফলমূলের দোকান। শিকদার সাহেব দেখছিলেন একটা টানাগাড়ির ওপর ঢিবি করে রাখা পাকা পাকা লাল রঙের আম, আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ইয়াকুব মোল্লা। মোল্লার গায়ে একটা ঢিলেঢালা লম্বা সবুজ কুর্তা, একেবারে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, তিনি হাত নেড়ে কিছু একটা বলে যাচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি আমের কম দাম শুনেই বেজায় রেগে গিয়েছেন। বেশি ভিড়ের ব্যস্তসমস্ত রাস্তাটা দেখতে দেখতে শিকদার সাহেব শরীরের কথাটা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন, নিজেকে তার বেশ হালকা লাগছিল।

এভাবেই এই উপন্যাসের সূচনা করেছেন কাজী আনিস আহমেদ। তারপর ধীরে ধীরে তিনি চমকপ্রদ কাহিনির ভেতরে প্রবেশ করেছেন। যে কাহিনি এবং ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে অনেক পাঠকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা কম বলে মনে হয় আমাদের।

শিকদার সাহেব শহরে গিয়েছিলেন যৌবনে তার আব্বাজানের নির্দেশেই। কোনো একটা ব্যবহারিক কাজ শিখতে হবে। তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন দাঁতের ডাক্তার হবেন বলে। জামশেদপুরের মানুষের দাঁত খুব খারাপ, তাই শহরের একমাত্র দাঁতের ডাক্তার হিসেবে একটা রমরমা পশার হবে, এটা ভেবেই। সারা দিন তিনি যে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল কথাই শিখতেন তা নয়, হেকিমি দাওয়াইয়ের সূত্রগুলো শেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তার নিজের পঠনপাঠনে মনোযোগ ছিল কম, তার মন পড়ে থাকত পাশের ললিতকলা বিদ্যালয়ের সমবয়সী ছাত্রদের ক্রিয়াকলাপে। এক চারুকলা শিক্ষার্থী তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল, আর শিকদার সাহেব তার সঙ্গে সন্ধেগুলো কাটাতে শুরু করে দিয়েছিলেন ছাত্রদের হোস্টেলে ডসনের ঘরে, ডসন তার ঘরটাকে একটা স্টুডিওই বানিয়ে তুলেছিলেন। ডসনের বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক আমলা, দেশ স্বধীন হওয়ার পরও তিনি এ দেশ ছেড়ে চলে যাননি; এ দেশের লোক হয়ে উঠেছিলেন। ডসনের গায়ের রংটাও রোদে পুড়ে পুড়ে এমন তামাটে হয়ে গিয়েছিল যে যদি তার সোনালি চুল না থাকত, তো সত্যিই দেশি লোক বলেই নিজেকে চালিয়ে দিতে পারতেন।

শিল্পী হিসেবে ডসন বস্তু বা মানুষ যা-ই হোন না কেন, তার ক্যানভাসে জ্যান্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তাতে শিকদার সাহেব মুগ্ধ আর তাজ্জব বনে যেতেন। ডসন কিন্তু সব সময় তার শিল্পকর্মের জন্য কোনো কিছু সরাসরি দেখে নেয়ার ওপর নির্ভর করতেন না, মাঝে মাঝে সে কিন্তু তার স্মৃতি কিংবা তার কল্পনা থেকেও কিছু এঁকে ফেলতেন। মাঝে মাঝেই তার নকশা কিংবা ছবির সঙ্গে কোনো বাস্তব বিষয়ের খুব একটা সম্পর্ক থাকত না-না বাস্তব কোনো কিছুর সঙ্গে মিল, না-বা সত্যিকার কোনো পটভূমির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তাদের তিনি বলতেন ‘নির্বস্তুক’। তার সব নির্বস্তুক যে অবোধ হতো তা নয়: অনেক রঙের মধ্যে ফুটে উঠত কোনো ভাঙা টেবিলের কিংবা কোনো তরমুজের ফালির কিংবা কোনো নগ্ন নারী শরীরের আদল-অ্যাবস্ট্রাকশনের মধ্যেও এসব চিনে নেয়া যেত। গোড়ায় শিকদার এসব তথাকথিত বিমূর্ত ছবিকে খুব একটা পাত্তা দেননি, কিন্তু তবু সে এসব নিয়ে কেমন যেন মজে গিয়েছিলেন। শুধু যে আঁকা ব্যাপারগুলোই তাকে ধাঁধায় ফেলে দিত তা নয়, এই ছবি আঁকার ব্যাপারটার ভেতরকার বিষয়ও তার কৌতূহলকে উসকে দিত। তারই বয়সী এক চালাক-চতুর ছোকরা কিনা পেশা হিসেবে আঁকাজোকা বেছে নিয়েছে। জামশেদপুরের লোকেরা তো আঁকাজোকা বা রঙের কাজকে বাচ্চাদের মজার কাজ বলেই ভাবত। কিন্তু এ তো আর নিছক মজা নয়, কারও কাছে এটাই সিরিয়াস কাজ, এমনকি জীবিকারও উপায় সম্ভবত-আর এটাই শিকদাকে বিচলিত করে ফেলত। তিনি নিজে অবশ্য এই হবু শিল্পী ছাত্রদের হেনস্তার চোখে দেখতেন না। বরং তাদের দিকে কেমন একটা সচকিত সম্ভ্রমের চোখেই তাকাতেন। আস্তে আস্তে, যতই ডসন তার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠলেন, শিকদার এই শিল্পীদের সান্নিধ্যে দিব্যি অনায়াসে আড্ডা দিতে শিখলেন: তিনি তো শহরে নতুন এসেছেন, কাউকেই ঠিক চেনেন না। ডসন আর তিনি অনেক রাত অব্দি চা খেয়েই কাটিয়ে দিতেন: ডসন অবশ্য কাজ করতেন, আর এই একরত্তি ম্যাড়মেড়ে ঘরটার মেঝে রঙের ফোঁটায় আর ছিটেয় ভরে উঠত।

ডসন যে শিকদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তা নয়, তার গুরুও হয়ে উঠেছিলেন। শিকদারকে অন্তত দুটি বিষয়ে তালিম দেয়ার ভার ডসন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন: শহর আর শিল্পকর্ম। যখনই ডসন বাইরে যেতেন শিকদারও তার সঙ্গে সঙ্গে যেতেন। তারা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, ডসন ছবি আঁকতেন কেমন করে পৃথুলা রমণীরা রিকশায় চেপে যাচ্ছে। চায়ের দোকানে বসে কীভাবে চা খাচ্ছে বুড়ো মানুষেরা, তাদের ছবি আঁকতেন লাল পেনসিলে। তবে শিকদারের কাছে এসব শহুরে নকশা কিন্তু ডসনের ল্যান্ডস্কেপগুলোর মতো আকর্ষণীয় মনে হতো না। ডসনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের আঁকা ছবিগুলো শিকদারকে তার জামশেদপুরের কথা মনে করিয়ে দিত। গরমে খরায় ফেটে যাওয়া মাটি আর নির্মেঘ নীল আকাশ। শীতকালে ঘন কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে লন্ঠনের হলুদ আলো। আর বর্ষার নানান রূপ নানান স্তর, দূরে জমা হতে থাকা কালচে মেঘ, বৃষ্টির পর্দা ঝাপসা করে দেয় দৃশ্যগুলোকে, ন্যাংটো ছেলেমেয়েরা গুটিসুটি মেরে জড়ো হয়ে আছে আমের বাগানে, ঝোড়ো ঘূর্ণি হাওয়ায় নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়গুলো, ভাঙা ডালপালা, ডাঁশা কাঁচা ফল আর মরা কাক পড়ে আছে কাদাপানিতে। ডসনের ক্যানভাসে যদি একটু হলেও এসব কিছুর আদল পাওয়া যেত শিকদারের স্মৃতির জামশেদপুরের, তাহলে নস্টালজিয়ায় তার মনটাও কেমন করে উঠত।

প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বেশ কিছু বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম ছিল ডসনের সংগ্রহে। গোইয়া আর গগ্যাঁর আঁকা ছবির বইয়ে মেয়েদের যেভাবে এঁকে দেখানো হয়েছে, গোড়ার দিকে তা দেখে শিকদার খুব অস্বস্তি বোধ করতেন। তার যে এদের শুধু অসংগতই মনে হয়েছিল তা নয়, মনে হতো অপ্রয়োজনীয়ও। শিকদার অবশ্য তার এই বোহিমিয়ান চালচলন খুব বেশি দিন বজায় রাখতে পারেননি, ঠিক যে কারণে তার ডাক্তারি পড়াও শেষ অব্দি শেষ করে উঠতে পারেননি। হঠাৎ তার আব্বাজান মারা গেলে তাকে জামশেদপুরে ফিরে আসতে হয়েছিল। শিকদারের পিতা যে ওষুধের দোকান সামলাতেন, তার সবকিছু দেখাশোনার ভার গিয়ে পড়ল তার ওপর। তখন তার স্মৃতির মধ্যে তার ছাত্রজীবনের দিনগুলো একরকমের ঝলমলেই থেকে গেল। শহর থেকে ফেরার পর শিকদার তার পরিচিতজনদের কাছে শহরের গল্প করতেন, শহরে নাচ-গান হয়, তিনি তাদের এ-ও শোনাতেন যে, ভদ্রঘরের মেয়েরা পর্যন্ত এসব কাজে ছেলেদের সঙ্গে যোগ দিত। কিছু কিছু হিন্দু মেয়ে তো মঞ্চেই নাচত, হোক না ধ্রুপদি নৃত্য, তবু তো নাচই। জামশেদপুরিদের কারও হয়তো ভেতরে-ভেতরে হিংসেই হতো কারও-বা আবার বেজায় আপত্তিকর বলেও মনে হতো, তবু তাদের তিনি শোনাতে ছাড়তেন না। ছেলে-ছোকরারা মদ খায়, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায়, তবে তিনি বলতেন বেশির ভাগ জিনিসই গোপনে হয়, এতে তেমন দোষের কিছু নেই। তবে এটাও তিনি যোগ করে দিতেন ‘যস্মিন দেশে যদাচার’-তবে এসব কাজে তিনি কতটা জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটা অবশ্য তিনি খুলে বলতেন না। জামশেদপুরে যে সংস্কৃতির কোনো আবহাওয়াই নেই, সেটা নিয়ে তার বেশ জেদ ছিল, তবে ক্রমেই এলাকার দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবন তার সয়ে গিয়েছিল।

শিকদার সাহেবের আব্বার একতলা বাড়িতেই তার দাওয়াখানা, প্রতিদিন সকাল হলেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে গরিব রোগীরা। মোগলযুগে জামশেদপুর শহরের অবস্থা বেশ ভালো ছিল, এখনো মানুষ সে যুগের কথা বলে গর্ব করে। তারপর ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও তারা তাদের কিছু অনুসারীর মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিতে নানান চিন্তাভাবনাকে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছে। একটা সময়ে জামশেদপুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হলে দেখা গেল ছয়জন প্রত্নতাত্ত্বিকের সঙ্গে একজন সাদা চামড়ার সাহেবও আছে তাদের সঙ্গে, তিনি আর কেউ নন শিকদার সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডসন। জামশেদপুরে একটা মস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হতে যাচ্ছে দেখে শিকদার সাহেব বেশ উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বড় রাস্তার পাশে গিয়েছিল চাঁদ-তারাখচিত সুন্দর এক মসজিদ দেখতে, কিন্তু তারা আবিষ্কার করলেন মসজিদের ভিতের কাছে নর্তকীর ছবি। ফলে তারা বুঝে ফেলেন এই মসজিদ কোনো হিন্দু মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠেছে। এরপর তো শহরে কসাইরা আর হিন্দুরা এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিল, দুই পক্ষের অনেক মানুষ মৃত্যুররণ করল।

ডসন জামশেদপুরেই থেকে গেল। সে একটা আসবাবের দোকান দিল। আর শিকদার সাহেব তার দাওয়াখানায় প্রসূতিদের চিকিৎসা শুরু করলেন। শিকদার সাহেব নূরজাহানকে দেখেছিলেন এক মেলায়। নূরজাহান অনন্যা সুন্দরী। মেলার পরপরই নূরজাহানের বাড়িতে প্রণয়প্রার্থীদের ভিড় লেগে যায়। নূরজাহানের পিতার দৃষ্টিতে শিকদার একজন সংস্কৃতিমনা যুবক বলে পরের বসন্তে শিকদারের সঙ্গে তার শাদি হয়ে যায়।

শিকদারের বিয়ের পর ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসটিতে নতুন মাত্রা যোগ করলেন লেখক-বিয়ের রাতে, অর্থাৎ বাসর রাতে শিকদার নূরজাহানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে গগ্যাঁর নাম শুনেছে কি না, বেটোফেনের নাম জানে কিনা, শিকদার যে বড়লাটকে কাছ থেকে দেখেছেন, সেটাও বলতে ছাড়লেন না, এসব কথা বলতে বলতে একসময় দেখলেন তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের সাত দিন পর তারা চুমু খান এবং সংগম করেন। এরপর থেকে শিকদার খেয়াল করলেন নূরজাহান খুব কামপটু নারী। ছাত্র থাকাকালীন শিকদার একবার বাৎসায়নের কামসূত্রটি পড়েছিলেন, রাত্রে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবার পর শিকদার টের পেলেন তার বউ যেসব কামকলা করে, তাতে মনে হয় সে কামসূত্র পড়েছে। ডসন অসুস্থ হয়ে পুরোনো বন্ধু শিকদারের কাছে চিকিৎসা নিতে এলে শিকদার তার চিকিৎসা শুরু করলেন। কিন্তু জানালেন তার দাওয়াখানাতে যে ওষুধ রয়েছে, তা দিয়ে বন্ধু ডসনের চিকিৎসা সম্ভব নয়। এর মধ্যে নূরজাহান ইংরেজি শেখার আগ্রহ দেখালে ডসনই তাকে ইংরেজি শেখাতে শুরু করলেন। শিকদার ওষুধ আনতে গেলেন রাজধানীতে। শিকদার এক অন্ধ দাই রেখে গেলেন ডসনের সেবার জন্য। কিন্তু শিকদার চলে যাবার পর সেই দাইও চলে গেল। সমস্ত বাড়িতে ওই ইংরেজ আর নূরজাহান। হ্যাঁ, ডসন তার বন্ধুপত্নীকে শুধু ইংরেজিই শিক্ষা দেননি অনেক কিছুই শিখিয়েছিলেন। শিকদার যেমন বাসর রাতে গগ্যাঁ, বেটোফেন বা বড়লাটকে দেখার গল্প শুনিয়েছিলেন ডসন তা করেননি। সে নূরজাহানকে তার যৌবনের নানা কীর্তি শুনিয়েছিলেন, আর নূরজাহানের ব্যক্তিগত নানান কথা জানতে চেয়েছিলেন। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী তারা পরস্পরের প্রেমে মজে যান। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ইয়াকুব মোল্লা এসে ডসন সাহেবকে বললেন-সাহেব, আপনার জন্যে একটা বাড়ি আর একজন চাকরের ব্যবস্থা করেছি, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। ডসন চলে গেলে শিকদার মনে মনে বললেন, ভালোই হলো, মোল্লা সঠিক সময়েই সঠিক কাজটা করেছেন। নূরজাহানকে শিকদার যখন বললেন, আমি মোল্লাকে কিছু বলিনি, মোল্লা নিজেই ডসনকে নিয়ে গেছেন। কিন্তু শিকদারের এই কথা শুনে ভীষণ রেগে যায় নূরজাহান, সে বলে, একজন সম্মানিত অতিথিকে তোমার এভাবে তাড়িয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। শিকদার কিছু বলতে গেলে রেগে যায় সেই মুখরা রমণী, বোঝাতে চায় শিকদার উঁচু মানের কালচারের কিছুই জানেন না।

এরপর নূরজাহান অন্তঃসত্ত্বা হলে তারা দুজন সিদ্ধান্ত নেন তারা একেবারে হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে একটা টি-পার্টি দেবেন বাড়িতেই এবং সবাইকে সুখবরটা জানাবেন। শিকদার আর নূরজাহান আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে ডসনকেও ওই টি-পর্টিতে দাওয়াত করেন। চটপটি, শিঙাড়া তৈরি হয়, একটু নাচ-গানেরও ব্যবস্থা হয়। কেউ কেউ গান গায়, ডসন নিজে ইংলিশ ড্যান্স করেন, তিনি ওই নাচের ব্যাখ্যাও দেন সবার সামনে।

দিনগুলো সামনে এগিয়ে যায়। এক রাতে শিকদারের স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হলে তাদের অন্ধ দাইকে আনা হয়। গভীর রাতে নূরজাহান একটা কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। তারপর যে কাহিনি লেখক বলেছেন, তা কিছুটা ঝাপসা লাগে পাঠকের কাছে। হতে পারে এটি লেখকের উঁচু মাপের শিল্পশৈলী, যা পাঠককে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে যাবার কৌশল। জামশেদপুরের সাধারণ মানুষ নানান কথা ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। কেউ বলে শিকদারের স্ত্রী একটি মৃত কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছিল, যার প্রমাণ শিকদারের বাড়ির উঠোনের একপাশে মাটিচাপা, মানে ওখানেই কবর দেয়া হয়েছিল মৃত সন্তানটিকে, সে জন্যই এক জায়গাতে উঁচু মাটির ঢিবি। কেনই-বা কাউকে কিছু না জানিয়ে দ্রুত মৃত বাচ্চাটিকে তাড়াহুড়ো করে কবর দেয়া হলো, এটা জামশেদপুরবাসীর কিছু মানুষের কাছে প্রশ্ন! ডসনকে খবর দেয়া হয়েছিল, তিনি তার সমবেদনা জানিয়েছেন, তবে কী একটা ভীষণ জরুরি কাজে তাকে তক্ষুনি শহরে চলে যেতে হয়েছিল।

কয়েক বছরের মধ্যেই জামশেদপুরের প্রতিটি লোক জেনে যাবে যে শহরে ডসন সাহেব এক নারী পুষেছিলেন, আর তার এক বাচ্চা হয়েছে। হাটের দিনে লোকে রাস্তার পাশে বসে আড্ডা দেবে আর দেখতে পাবে ডসন তার মোটরগাড়ি চালিয়ে শহরে যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই তার সেই তথাকথিত বংশধরকে দেখতে।

জামশেদপুরে সব কাহিনিরই দুটো ভাষ্য থাকে। একটা ছড়িয়ে পড়ে লোকজনের মুখে মুখে, অন্যগুলো বয়ে নিয়ে যায় চিমনির ধোঁয়া। দুপুরের দিকে জামশেদপুরের চিমনিগুলো এসব মজার খুঁটিনাটি উগরে দিতে লাগল, আর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া কাহিনিটা রঙের পর রং ছড়াতে লাগল। ফিসফিস গুঞ্জন, আড়চোখের চাহনি, জল্পনাকল্পনা, রান্নাঘরের মেয়েলি অশ্রাব্য সব কটুকথা আকাশের মেঘগুলোকেও কালো নোংরা করে দিল।

সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল জামশেদপুরে। সকালে একটু পরিষ্কার হলে সবাই শিকদার সাহেবের লাশটা গোরস্থানে নিয়ে গেল। এই মৃত্যুর কথা শুনে ডসন সাহেব ছুটে এসেছিলেন শিকদার সাহেবের বাড়ি। ততক্ষণে শব নিয়ে গোরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েছে। শিকদারের স্ত্রীর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডসন সাহেব সালাম জানালেন, বললেন-ইউ ক্যান নেভার টেল হোয়েন সাম থিংস উইল হ্যাপেন, কখন যে কী ঘটবে, আগে থেকে তুমি জানোই না তো কী বলবে। বেগম শিকদার কোনো কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেল।

ফেরেশতারা আসবে কি না, সে সম্বন্ধে শিকদারের গভীর সন্দেহ আছে। শুধু যেটা তিনি জানতে পারবেন কাঠের ওই পাদুকা কয় কদম যায়। কাঠের জুতোর তলির খটখট শব্দ ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে, তবে তা তাকে গুনে গুনে হিসাব করা থেকে কিন্তু আটকাতে পারেনি : ছত্রিশ...সাঁইত্রিশ...

‘চল্লিশ কদম’ একটি উপন্যাসিকা, অবয়ব বেশি বড় নয়, বরঞ্চ ছোটই বলা যেতে পারে, চার ফর্মার বই। কিন্তু এর ক্যানভাসটা বিশাল। কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট যোসেফ ও নটর ডেম কলেজে। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা নেন আমেরিকাতে-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করে থাকেন। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউতে ২০০০ সালে। এ ছাড়া তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ও ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ গ্রন্থ দুটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আমেরিকা ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

কাজী আনিস আহমেদ উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই আমেরিকাতে পাড়ি জমান সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য এবং সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি তাঁর ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে লেখাপড়ার সূত্রে তিনি ইউরোপ, আমেরিকার সাহিত্যভাবনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং ঋদ্ধ হয়েছেন বলা যায়। কিন্তু ‘চল্লিশ কদম’-এ তিনি যে ভূগোল, ইতিহাস ও জীবনের কথা তুলে এনেছেন, তা উপমহাদেশীয় গল্প। তাই বলে তিনি যে শিল্পভাবনার প্রয়োগ দেখিয়েছেন, তা কিন্তু প্রচলিত ধারার বাইরে এবং অসম্ভব সাহসী। শুধু শিল্প আর ধর্ম বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইংরেজ ডসনের মুখ দিয়ে কিছু কথা উচ্চারণ করিয়েছেন। উপন্যাসে বলা হয়েছে, ভারত স্বাধীন হলেও ডসন সাহেব কিন্তু জামশেদপুরেই থেকে গিয়েছেন। শিকদার যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়তে গেলেন, তখন ডসন ছবি আঁকতেন। শিকদারের সঙ্গে বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হলে ডসন তাকে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম দেখাতেন এবং তাকে বোঝাতেন কেন এখানে এই রং ব্যবহৃত হয়েছে। আসলে ওগুলো ছিল বিমূর্ত চিত্র। শিকদার বুঝুন অথবা না বুঝুন, তিনি মাথা নাড়তেন। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বেশ কিছু বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম ডসনের সংগ্রহে ছিল। গোইয়া আর গগ্যাঁর আঁকা ছবির বইয়ে মেয়েদের শরীর যেভাবে এঁকে দেখানো হয়েছে, গোড়ার দিকে তা দেখে শিকদার খুব অস্বস্তি বোধ করতেন। ওই বিমূর্ত ছবিগুলোর মধ্যেও শিকদার নারী শরীরের বিশেষ অঙ্গপ্রতঙ্গ আবিষ্কার করেছেন। তার কাছে এদের শুধু অসংগতই মনে হয়েছিল, তা নয়, মনে হতো অপ্রয়োজনীয়ও। ‘আমি জানি যে এসব মহৎ শিল্পকর্ম, কিন্তু এই শিল্পকর্মগুলো আমাদের জন্য নয়,’ ডসনকে তিনি বলেছিলেন, ‘তাছাড়া তোমার জানা উচিত, ইসলামে কারও ছবি আঁকা নিষিদ্ধ।’ এই কথার পর ডসন খুব নরম স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি যে মুসলমান নই, সেজন্য আমার খুশিই লাগছে।’ তার ধর্মভীরু মনের সব সংশয় সত্তে¡ও শিকদার অবশ্য শিল্পকলায় তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেননি। এইখানে লেখক শিল্পভাবনার ক্ষেত্রে ইউরোপ তথা খ্রিষ্টানদের এবং মুসলমানদের ভাবনাটি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন।    

উপমহাদেশে মসজিদ-মন্দির নিয়ে লেগে থাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাও উঠে এসেছে বইটিতে। জামশেদপুরে যখন প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা দল এল একটি মসজিদ দেখতে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের দলে ডসনও ছিলেন। শিকদার ভাবলেন তার বন্ধুও রয়েছেন ওই দলে, তিনি কিছুটা গর্বও বোধ করলেন, এবার হয়তো মসজিদটি নিয়ে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি গবেষণা চলবে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুব দ্রুতই দেখতে পেলেন মসজিদের একটি পিলারে নারী নর্তকীর ছবি। তখন তাদের বুঝতে কষ্ট হলো না এই মসজিদটি কোনো এক সময়ে মন্দির ছিল। এই কথা জানাজানি হয়ে গেলে হিন্দুরা এক গরিব মুসলমান মুচিকে খুন করে, সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান কসাইরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।

ইয়াকুব মোল্লা মধ্যযুগীয় ধর্মীয় পুস্তক ঘেঁটে শিকদার সাহেবকে বুঝিয়েছেন, মৃত্যুর পর অবশ্যই কবরে আসবে দুজন ফেরেশতা, যখন মানুষ কবর থেকে চল্লিশ কদম দূরে যাবে, তখনই ওই ফেরেশতা দুজন আসবে, তাদের একজন মৃত ব্যক্তির ভালো কাজের হিসাব নেবে, অন্যজন খারাপ কাজের হিসাব নেবে। তখন থেকেই শিকদার সাহেবের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমত প্রতিদিন এত মানুষ মরছে, কী করে এত মানুষকে জেরা করতে পারবে তারা। আর চল্লিশ কদমই-বা যেতে হবে কেন? তারা তো উনচল্লিশ কদমও যেতে পারে! আর চল্লিশ অঙ্কটিকেই-বা এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কেন? 

কাজী আনিস আহমেদ তাঁর ‘চল্লিশ কদম’-এ এসব তুলে এনেছেন, কারণ তিনি একটি গোঁড়ামিমুক্ত উদার জ্ঞানচর্চানির্ভর সমাজের প্রতিষ্ঠা চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমাদের, শিল্পচর্চার আবহে লালিত একটি আধুনিক সমাজ, যেখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। মানুষ হবে প্রগতিশীল, মুক্ত, উদার মনের অধিকারী। ‘চল্লিশ কদম’ নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে না তাদের।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সংরক্ষিত আসনের ১৬ শতাংশ এমপির পেশা রাজনীতি
সংরক্ষিত আসনের ১৬ শতাংশ এমপির পেশা রাজনীতি
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ