X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের কোনও অস্বীকারই ধোপে টিকবে না

উদিসা ইসলাম
২৯ ডিসেম্বর ২০১৫, ১২:৩৭আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৭:২৬

উদিসা ইসলাম স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এসে পরাজিত শক্তি আবারও আস্ফালন শুরু করেছে। গণহত্যাকে অস্বীকার করলেও তারা ভুলেই গেছে বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার পরে তাদের সেনারাই নানা জবানবন্দি নানা জায়গায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই অস্বীকার তাদের বিচার থামিয়ে রাখতে পারবে না, এটা তারা ভালই জানে। এখন বাংলাদেশ কতটা এগোচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সেটা সময় বলে দেবে। কিন্তু দালিলিক ও মৌখিক প্রমাণ থেকে এটা স্পষ্ট- পাকিস্তানের আজকের সময়ের কোনও অস্বীকারই ধোপে টিকবে না।
পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকের বর্ণনায় সেই দিনের ভয়াবহতা সামনে চলে আসে। তেমনি একজন মেজর সিদ্দিক সালিক। ২৫ মার্চ ঢাকায় যখন বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর উন্মত্ততা চলছিল, তখন বি জোনের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের জনসংযোগ অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক। তিনি ২৫ মার্চের ভয়াবহতার ভেতরের ও বাইরের কথা জানিয়েছেন একাধিকবার। এই এক স্বীকারোক্তিতেই ১৯৫ জনের বিচার করা সম্ভব। এ ছাড়া হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে বেশকিছু জবানবন্দি রয়েছে।
কী বলেছেন মেজর সিদ্দিক সালিক? ‘দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে আমি তাড়াতাড়ি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলাম। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্নতর দেখলাম। শহরের হৃদয়-বিদারক ঘটনা সামরিক বাহিনীর লোকজন এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের স্নায়ুবিক অবস্থাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। তাদের অনুভূতি এই রকম- দীর্ঘদিন পর ঝড় থেমেছে এবং দিগন্তকে নির্মল করে অবশেষে বয়ে গেছে। স্বস্তির সঙ্গে গা এলিয়ে দিয়ে অফিসার্স-মেসে অফিসাররা বসে গল্প করছে। কমলা লেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বললেন, বাঙালিদের ভাল করে এবং ঠিকমত বাছাই করা হয়েছে, অন্তত এক প্রজন্মের জন্যে তো বটেই।
২৬ শে মার্চের সূর্য উদিত হবার আগেই সৈনিকরা তাদের মিশন সমাপ্তির রিপোর্ট প্রদান করলো। জেনারেল টিক্কা ভোর পাঁচটায় সোফা ছাড়লেন এবং নিজের অফিসে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর রুমালে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। ভাল করে চারদিকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘একটা মানুষও নেই!’

সালিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণকবরগুলোর বর্ণনাও দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, পাঁচ থেকে পনের ব্যাসার্ধের তিনটি গর্ত দেখতে পেলাম। সেগুলো সদ্য তোলা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কোনও অফিসারই মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাইলো না। ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের চারপাশ দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে মনে হয়েছিল, হামলার ফলে দুটি ভবন মাটির সাথে মিশে গেছে। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হল, ইকবাল হলে মাত্র দুটি এবং জগন্নাথ হলে চারটি রকেট আঘাত হেনেছে। কক্ষগুলো বেশিরভাগই পুড়ে কয়লা। কয়েক ডজন অর্ধদগ্ধ রাইফেল ও কিছু ছড়ানো ছিটনো কাগজ তখনও জ্বলছিল।

২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু করার হুকুম দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চুপিসারে ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে ক্যাম্পের বাইরের ভয়াবহতা থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি সে বর্ণনাও পাওয়া যায় তার বয়ানে। পরের দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, ২৬ মার্চ সকালে জুলফিকার আলি ভুট্টো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে হেভি মিলিটারি এসকর্ট নিয়ে বিমানবন্দরে গেলেন এবং পাকিস্তানের উদ্দেশে বিমানে ওঠার আগে সঙ্গে থাকা এসকর্ট পার্টির প্রধান ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক গড পাকিস্তান রক্ষা পেল।’

তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বলে দেয় পাকিস্তান আর রক্ষা পায়নি। রক্ষা পায়নি ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান। জুলফিকার আলি ভুট্টোকে তার নিজের নিয়োগকৃত সেনাপ্রধান জিয়াউল হকের হাতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলপত্র সপ্তম খণ্ডে এই জবানবন্দি লিপিবদ্ধ আছে। এখন বিচার করতে কেবল সরকারের আদেশ প্রয়োজন। তাহলে বর্তমান আইনে এই বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব। কেননা, যে চুক্তির মাধ্যমে তারা অপরাধীদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই অপরাধীদের বিচার করার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। এটাও একটা অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

এই বয়ানের ওপর ভিত্তি করে এবং যে দলিলপত্রাদি সংরক্ষিত আছে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা, গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে গণহত্যা, হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, ধর্ষণের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জোরপূর্বক নির্বাসন, দেশান্তর এবং জনগণকে ভিটা থেকে উৎখাতের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণ করা যায়।

ড. এম হাসানের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে ক্যাপ্টেন নিয়াজি ও তার সহযোগীদের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি পঞ্চগড় জেলায় ব্যাপক গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগ করে। পঞ্চগড় শহরে পঞ্চাশ ষাট জন নিরীহ বাঙালিকে তারা হত্যা করে। ধর্ষণ করে শহরে অবস্থানরত কিশোরী ও যুবতী নারীদের প্রায় সকলকে। এই জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে পুরানদীঘি নামে একটি বধ্যভূমি রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর জবানে বেরিয়ে আসে, এখানকার গণহত্যার সাথে যেসব পাকি আর্মি জড়িত ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন নিয়াজি। এখানে পাকি বাহিনীর সহযোগী ছিল খমির উদ্দীন চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগের সদস্যরা। এলাকাটি সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই ভারতে চলে গিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে এখানে অবস্থান করায় তাদের স্ত্রী, কন্যা ও বোনদের ওপরেই পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্যাতন চালায়। তারা পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বাড়ির মেয়েদের ধরে এনে ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করে। প্রায় শখানেক নারী এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ