X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাশকাটা ঘরেও নারী নিরাপদ নয়?

মনিরা নাজমী জাহান
২৯ নভেম্বর ২০২০, ১৬:১০আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২০, ১৬:১১

মনিরা নাজমী জাহান ‘লাশকাটা ঘর’ শব্দটা শুনলে ভয়ে শিউরে ওঠে না বা গা ছম ছম করে ওঠে না ওমন লোক হয়তো কম। এই লাশকাটা ঘর অনেকের কাছে ‘ডোম ঘর’ বা মর্গ নামেও পরিচিত। যারা অস্বাভাবিকভাবে  মৃত্যুবরণ করেন তাদের  লাশ কাটাকাটি করে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মৃত্যুরহস্য উন্মোচন করা হয় এই লাশকাটা ঘরে। লাশকাটা ঘরে ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকদের সহকারীরা ডোম নামে পরিচিত।
সম্প্রতি এই লাশকাটা ঘরেই এমন একটি বীভৎস ঘটনা ঘটেছে, যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। মানুষ হয়তো কল্পনাতেও এত বীভৎস ঘটনা চিন্তা করতে পারে না।
ডোম জতন কুমার লালের ভাগিনা মুন্না ভগত। সে মামার সঙ্গেই ওই হাসপাতাল মর্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না মর্গে থাকা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে আসছিল। এ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) তাকে আটক করে সিআইডি। একটি মানুষের মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে এই ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটাতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই মানসিক রোগটির নাম ‘নেক্রোফিলিয়া’। পৃথিবীতে এই ধরনের রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এই ধরনের রোগীর সন্ধান এই প্রথম পাওয়া গেলো।   

আবার আসুন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি ‘নেক্রোফিলিয়া’ কী? নেক্রোফিলিয়া শব্দের শুরুটা এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। নেক্রোস অর্থাৎ মৃত (nekros; dead) এবং (philia; love) ফিলিয়া অর্থাৎ ভালোবাসা বা আসক্তি। তার মানে মৃতদেহের প্রতি যারা শারীরিক আসক্তি অনুভব করে তারা এই বিরল রোগে ভুগে থাকে। নেক্রোফিলিয়া একটি অন্যতম প্রচলিত প্যারাফিলিয়া (Paraphilia) বা বিকৃত যৌনাচার। নেক্রোফিলিকরা মৃতদেহের সঙ্গে যৌনকার্যে লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য কর্মটি করে থাকে পুরুষরা এবং এর শিকার হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর মৃতদেহ। যৌনতার ধরনের ওপর ভিত্তি করে নেক্রোফিলিকদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়–

১. Necrophilic homicide: এক্ষেত্রে নেক্রোফিলিকরা যৌনকার্য করার উদ্দেশ্যে খুন করে থাকে।

২. Regular necrophilia: এ ধরনের নেক্রোফিলিকরা মৃতদেহ খুঁজে বের করে বা সংগ্রহ করে যৌনকার্য করে থাকে।

৩. Necrophilic fantasy: এ ধরনের নেক্রোফিলিকরা মৃতদেহের সঙ্গে যৌনকার্য কল্পনা করে মাত্র।

একজন নারী তার জীবন দশায় তো নয়-ই এমনকি মৃত্যুর পরও তার নিথর দেহটি ধর্ষকের করাল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। যদিও এই ধরনের অপরাধের পৃথক কোনও সংজ্ঞা বা শাস্তি আমাদের প্রচলিত আইনে নেই। তবে পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী  অস্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষার আওতায় এই ধরনের অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত সম্ভব। কিন্তু সবকিছুর পরে যে প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে নারী আসলে কোথায় নিরাপদ?

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরইমধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১ জন। সংস্থাটির দেওয়া এ পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী।

আমরা দেখে নেই নারীর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ৩টি জায়গা তথা আবাসস্থল, পরিবহন এবং তার কর্মস্থলে নারী কতটুকু নিরাপদ। তাহলে আমরা নারীর নিরাপত্তা বিষয়ক একটি চিত্র পেয়ে যাবো। 

নারীর আবাসস্থলে নারী কতটুকু শান্তি পেয়ে থাকেন এই বিষয়টি নিয়ে আসুন একটু জানার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফল বলছে, দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনও না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। এমনকি এই লকডাউনের মধ্যেও এই নির্যাতনের হার তো কমেইনি বরং আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর মতে, বর্তমান করোনাকালে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের হার বেড়েছে শতকরা ৩১ ভাগ।

সম্প্রতি একটি ঘটনা নারী নির্যাতনের ঘটনা সকল বীভৎসতার মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্ত্রীর যোনি ও পায়ুপথসহ পুরো নিম্নাঙ্গে পেট্রোল ঢেলে আগুন পুড়িয়ে চামড়া খুলে নেয় স্বামী। নারীর আবাসস্থলে নারীর প্রতি এই ধরনের বীভৎসতা মধ্যযুগীয় যেকোনও ধরনের বর্বর নির্যাতনকেও হার মানায়। যেখানে আবাসস্থল সবচেয়ে নিরাপদ হওয়া উচিত ছিল সেখানে আবাসস্থলে চলে নারীর প্রতি বর্বর নির্যাতন। 

এবার আসা যাক নারীরা যেই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন সেইখানে তারা কতটুকু নিরাপদ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়কপথে ৪৪টি, রেলপথে ৪টি ও নৌপথে  ৪টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ দেখে নেই নারী কর্মস্থলে কতটুকু নিরাপদ। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম কর্তৃক পরিচালনা করা একটি জরিপ অনুযায়ী প্রায় সব নারী কর্মস্থলে কোনও না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন।

তবে সমাজের এমন ভয়াবহ ও বীভৎস রূপ কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মন গলাতে পারেনি বরং আমরা দেখতে পাই এদের হয়ে দালালি এবং গলাবাজি করে যাচ্ছে বিভিন্ন কথা বলে। কখনও বলা হচ্ছে পর্দা না করার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে, কখনও বলা হচ্ছে নারীর একা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে, কখনও বলা হচ্ছে নারীর রাতের বেলা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। তার ওপর এখন শুরু হয়েছে আরেক নারীর প্রতি আরেক নির্যাতন যেখানে ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারীর জীবন নিয়ে কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা!  এদের কুৎসিত ও নোংরা কথা শুনলে এবং কাজ দেখলে মনে হবে নারী হয়ে জন্মানোটাই যেন নারীর আজন্ম পাপ।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়  নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবার ক্ষেত্রে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেন এক প্রকার স্বর্গসুখ অনুভব করে। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানির স্বীকার হতে হয় না। নারীর জীবনে এমন কোনও সম্পর্ক বোধহয় পাওয়া দুষ্কর যার দ্বারা নারীর জীবনে নিগৃহীত হওয়ার উদাহরণ নেই। একটি সমাজ ব্যবস্থা কতটুকু বর্বর হলে একটি নারীর মৃতদেহ সেই সমাজে নিরাপদ না। মৃতদেহ রক্ষা পায় না ধর্ষকের করাল গ্রাস থেকে।

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার, যে সমাজ ব্যবস্থা নারীকে জীবিত অবস্থায় তো বটেই এমনকি মৃত্যুর পরও নারীর মৃতদেহকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সেই সমাজ আসলে কতটুকু সভ্য সমাজ? তাহলে কি আমরা সভ্যতার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছি? ফিরে যাচ্ছি আদিম বর্বর সমাজে? নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা এখন আমাদের জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।   

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ