X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অসত্য তথ্যে, অসম্মানের সংস্কৃতি!

গোলাম মোর্তোজা
৩০ ডিসেম্বর ২০১৫, ১২:৩৭আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫, ১২:৩৯

গোলাম মোর্তোজা ধারাটি আগে কেমন ছিল জানি না। তবে বর্তমান সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমরা জেনে-বুঝে অসত্য বলি। না জেনে অসত্য বলি। আংশিক জেনে বিজ্ঞের ভাব নিয়ে অসত্য বলি। একটি গল্প শুনেই সত্য হিসেবে ধরে নেই। সত্যতা জানার চেষ্টা করি না। রঙ লাগিয়ে সেই সব গল্প নিজের মতো করে উপস্থাপন করি।
গল্পটি যে অসত্য, তা অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে চাই না। অনেক ক্ষেত্রেই বুঝেই বলি। ভাবনায় থাকে অসত্য গল্প বলে, অন্যদের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়ানো গেল। ধারণা করি, সবাই ভেবে নিলেন যে, আমি অনেক কিছু জানি, অন্যদের চেয়ে বেশি জানি।
ব্যক্তি থেকে দেশ-জাতির জন্ম ইতিহাস নিয়ে আমরা এমন অসত্য গল্প বলছি। ফলে মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। সমাজে বাড়ছে বিভ্রান্তি। এ বিষয়ে সম্প্রতি দু’একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা।
১. বিএনপি  নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ‘নির্বোধ’ বললেন। একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা, তারা একেকজন কত বড় মানুষ-শিক্ষাবিদ, লেখক-সাংবাদিক ছিলেন—তা প্রায় সবাই জানি। একজন জিসি দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অঙ্গন দিয়ে হাঁটতেন, কথা বলতেন, ক্লাস নিতেন—ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে। সত্যি সত্যি ‘দেবতুল্য’ ছিলেন এসব মানুষ। তাদের ‘নির্বোধ’ বলছেন একজন রাজনীতিবিদ! স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে!! স্বাধীন বাংলাদেশে!!!
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের কথা আবার দলের কর্মী-সমর্থকরা অনেকে সমর্থন করছেন। কেউ একটু খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করছেন না। গয়েশ্বর কেন এমন বললেন, তাও জানার ইচ্ছে হচ্ছে না কারও। তারা ইতিহাসের এত বড় অসত্য বিশ্বাস করছেন।
২. মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব বুদ্ধিজীবী ঢাকা শহরেই ছিলেন। একটি স্বাধীনতার যুদ্ধে, সেই দেশের সব মানুষ সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন না। সরাসরি যুদ্ধ সবাই করেন না, করতে পারেন না। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন বিভিন্ন উপায়ে।
যেমন একাত্তরে ঢাকা শহরে অবস্থান করে কবিতা লিখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। তার প্রখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ একাত্তরে লেখা।

গেরিলারা তার থেকে কবিতাটি নিয়ে যায়। তা ছাপা হয় কলকাতার কাগজে। একটি গান গেয়ে কত শিল্পী অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। অথচ বিএনপির আরেক নেতা বলছেন, যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, তারা মুক্তিযোদ্ধা নন। এমন অসত্য বলতে তাদের বিবেকে একটুও বাধছে না।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এই ঢাকা শহরেই অবস্থান করেছেন একাত্তরে। সন্তান রুমি যুদ্ধে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কত রকমের সাহায্য যে করেছেন জাহানারা ইমাম! ঢাকা শহরে পনেরো বিশটি বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ঢাকা শহরে অপারেশন করে গেরিলারা এসব বাড়িতে আশ্রয় নিতেন। এসব বাড়িতে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ রাখতেন, অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন। এসব বাড়ির সবাই সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেননি। ঢাকা ছেড়ে চলেও যাননি। চলে যাননি বলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান কম বা তারা নির্বোধ ? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে অনেকভাবে সহায়তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা চাকরি করেছেন, বেতন নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। ঢাকা শহরের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা কি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার চেয়েও সাহসিকতার কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না?

৩. একাত্তরে ঢাকা শহরে লোকজন থাকা না থাকা বিষয়ক একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি সাক্ষাৎকারে গত বছর বলেছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের গেরিলা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। তার বই 'দ্য ব্রেভ অফ হার্ট '-এ বিষয়টি বিস্তারিত আছে।

দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা ছিল ঢাকাকে গোরস্থান বানিয়ে ফেলার। এ বিষয়ে খালেদ মোশাররফ ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীর কথোপকথন—

‘খালেদ মোশাররফ শাহাদত ভাইকে ডেকে বললেন, ‘শোনো শিল্পী আমি ঢাকাকে গোরস্থান বানাতে চাই। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাই।’

শাহাদত ভাই বললেন, ‘কাদের দিয়ে মিশিয়ে দেবেন?’

‘কেন তোমাদের দিয়ে, ছাত্রদের দিয়ে।’

শাহাদত ভাই বললেন, ‘ছাত্ররা কি এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন, তাদের বাবা-মাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে? তারা কি তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে এখানে এসেছেন? আপনি কি আপনার মা-মেয়েকে হত্যা করতে চান? আপনি এটি করতে পারেন না।'

খালেদ মোশাররফ থমকে দাঁড়ালেন। প্রথমবারের মতো কোনও সিভিলিয়ান খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধের তর্কে জড়ালেন।

এই তর্কের মধ্য দিয়ে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে শাহাদত চৌধুরীর সখ্য তৈরি হলো। বদলে গেল যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনা। সিদ্ধান্ত হলো, গোরস্থান নয়, ঢাকায় যারা আছেন, তারা যেন ঢাকাতেই থাকেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় যারা আছেন, তাদের কেন ঢাকা ছাড়া ঠিক হবে না—এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো শুরু হলো। শাহাদত চৌধুরী লিফলেট লিখলেন, ১৯৫৫ সালের ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ সেই লিফলেট সম্পাদনা করলেন। কেন ঢাকায় থাকা দরকার, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা দরকার, এমন দশ বারোটি পয়েন্ট দিয়ে লেখা লিফলেট ছড়িয়ে দেওয়া হলো ঢাকা শহরে যারা ছিলেন তাদের কাছে।

এই লিফলেট বিলির পর প্রতিক্রিয়া কী হলো, সে বিষয়ে হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, ‘সবার মধ্যেই এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এলো। ঢাকা শহরে থাকা মানুষ ধারণা করতে থাকল যে, পাল্টা কিছু একটা হতে যাচ্ছে।’'

এই ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, ঢাকা শহরে অনেক মানুষের থেকে যাওয়ার একটা প্রেক্ষাপট ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধার জন্যেই অনেকের ঢাকা শহরে থাকা জরুরি ছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে ঢাকা শহরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।

৪. গয়েশ্বর রায় এসব ঋষিতুল্য মানুষকে  ‘নির্বোধ’ বলছেন।  খালেদা জিয়া ‘শহীদ সংখ্যা বা গণহত্যার সংখ্যা’ নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তুলে বিতর্ক তৈরি করছেন। শহীদদের অসম্মান করছেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অনেকবার শহীদ সংখ্যা ৩০ লাখ বাণীতে উল্লেখ করেছেন খালেদা জিয়া। এখন বলছেন, ‘আজকাল বলা হয় এত লক্ষ শহীদ হয়েছেন...’ বিষয়টি যে ‘আজকালে’র নয়, ১৯৭১ সাল থেকে যে শহীদ সংখ্যা ৩০ লাখ নির্ধারিত হয়েছে, তা কি খালেদা জিয়া জানেন না? নাকি ভুলে গেছেন? না, জেনে-বুঝেই বিতর্ক তৈরি করছেন?

৫. জেনে-বুঝে অসত্য বলে অসম্মান করার ধারাটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ হিসেবে যারা পরিচিত তারাও করেন। ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, পাকিস্তানের পক্ষে আইএসআইয়ের এজেন্ট ছিলেন’—এমন অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। অনেক লেখক-ইতিহাসবিদও এমন কথা বলেন। এর পক্ষে কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তথ্য-প্রমাণ আছে জিয়াউর রহমান ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।

এই খেতাব পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের থেকে। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ আছে।

‘জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না’—এমনঅসত্য বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে আরও বড় অসত্যের আশ্রয় নেওয়া হয়। বলা হয়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি, শেখ মুজিব পাকবন্ধু, রাজাকার... ইত্যাদি কথা নির্বিকারভাবে বলেন বিএনপি নেতা তারেক রহমান। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘পাকিস্তান চলে যা’—এই মহিলা’, ‘সে’। মায়ের বয়সী মানুষকে ‘তুই’ তোকারি-করছেন অবলীলায়।

৬. একাত্তরে খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। এই বিষয়টিকে নিয়ে শালীনতার সকল সীমা অতিক্রম করে কথা বলা হয়। যা চূড়ান্তভাবে অরুচিকর, অশ্লীল। একাত্তরে এই ঢাকা শহরে এক অর্থে বন্দী অবস্থাতে ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেও। একাত্তরে ঢাকা শহরে জন্ম হয়েছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের। যুদ্ধদিনের সেসব কথা লিখে গেছেন জয়ের বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া।

একাত্তরের শেখ হাসিনার কথা একবার ভেবে দেখেন। বাবা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী। আদৌ কোনও দিন ফিরে আসবেন কি না অনিশ্চিত। ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধ করছেন। নিজের পেটে সন্তান। এত বছর পরে এসে সেই বেদনাদায়ক সময়ের প্রসঙ্গ তুলে অশালীন বক্তব্য আসছে। মানুষ হিসেবে আমাদের কতটা অধপতন হয়েছে! আমরা কোনও কিছু না ভেবে সম্পূর্ণ অসত্য বা আংশিক সত্য দিয়ে একজনকে আক্রান্ত করছি। নিজেও যে, একই প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত হব,  তা ভাবছি না। ফলে পুরো পরিবেশ হয়ে পড়ছে দূষিত।

৭. মানুষকে অসম্মান করার প্রবণতাটা দেশ-সমাজের সব পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বোচ্চ নেত্রী-নেতারা অসত্য তথ্য দিয়ে একজনকে অসম্মান করছেন। তৃণমূল পর্যন্ত কোরাস গাওয়া হচ্ছে সেই অসত্য বক্তব্যের। ‘সুদখোর’ বলে গালি যিনি দিচ্ছেন, তিনি জানেন যে, যা বলছেন তা অসত্য। তারপরও বারবার বলছেন। নেতা-কর্মীরা অসত্য বক্তব্য দিয়ে যাওয়াটা দায়িত্ব মনে করছেন।

পাল্টা আঘাত আসছে আরও জোরালোভাবে। তাও আসছে অসত্য তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই। ‘সত্য-মিথ্যা যাই হোক’—আঘাত করতে তো পারলাম, এমন নীতিতেই চলছে সব কিছু। এসব অসত্য, অশালীন বক্তব্য দেওয়ার জন্যে দু-একজন নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে।

সম্মানিত মানুষদের অসম্মান করে, একজন আরেক জনকে অসম্মান করে, সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণে, কখনও সম্পূর্ণ অসত্য বলে, কোন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন রাজনীতিকরা? অর্জনই বা করতে চাইছেন কী?

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ