X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাহলে বিএনপি করবেটা কী?

প্রভাষ আমিন
০৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১২:৫৬আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:৫৫

প্রভাষ আমিন বিএনপি পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও আমার শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে থাকবে তো, নাকি আগের রাতে বা নির্বাচনের দিন দুপুরে বয়কট করবে? আমার ধারণা ছিল বিএনপি এখনও গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরেনি। তারা হয়তো এখনও আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু আগে পরে অনিয়মের অনেক অভিযোগ সত্ত্বেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিল। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও তাতে জোর ছিল না। বরং মাত্র ১৯টি পৌরসভা আর ২৮% ভোট নিয়েও বিএনপির মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি দেখা যাচ্ছে। বিএনপির এই সন্তুষ্টি আমাদের মধ্যেও স্বস্তি এনেছে।
যাক জনগণের দল বিএনপি তাহলে সত্যিই গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুপুরেই প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি যে ভুল করেছিল, তার চরম খেসারত তাদের দিতে হয়েছে, হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আর তার বর্ষপূর্তিতে বিএনপি আন্দোলনের নামে যা করেছে, তা কোনওভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কাজ হতে পারে না। আর এই নাশকতা, সহিংসতার মামলায় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী হয় কারাগারে, নয় পালিয়ে ছিল এবং আছে। বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের এই আইনগত বৈধ সুযোগটি বিএনপিই সরকারকে করে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে বিএনপি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল বিএনপি এবং তারা চমৎকারভাবে তা কাজে লাগিয়েছে। ১৯ জন মেয়র আর ২৮% ভোট দিয়ে তাদের অর্জন মাপা যাবে না। বিএনপির আসল প্রাপ্তি, দীর্ঘদিন পর নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পেরেছে, তারা চাঙা হয়ে নির্বাচনের কাজ করতে পেরেছে। বিএনপিকে আংশিক ধন্যবাদ তারা আবার গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে বলে। পুরো ধন্যবাদ দেবো সেদিনই, যেদিন জামায়াতকে ছেড়ে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে তারা।
বিএনপিকে ধন্যবাদ জানালেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে পারছি না। বিএনপি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরলেও আওয়ামী লীগ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি স্বাগত জানালেও তার দল এবং সরকার গণতান্ত্রিক ধারায় বিএনপিকে স্বাগত জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। পৌর নির্বাচন সূত্রে হঠাৎ পাওয়া আত্মবিশ্বাসকে ধরে রাখতে বিএনপি আবারও মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর রাতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন তারা সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করে। সে বৈঠকে এও সিদ্ধান্ত হয়, গতবছরের মতো এবার তারা ৫ জানুয়ারিতে কোনও সহিংস কর্মসূচি নেবে না। এমনকি সমাবেশের অনুমতি না দিলেও না। বিএনপি বরং পৌরসভা নির্বাচনের সূত্রে পাওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগুতে চায়।

তখন পত্রিকায় দেখেছি আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নয়, বরং ১২ জানুয়ারি সরকারের দুইবছর পূর্তি উদযাপন করবে। তাহলে তো কোনও ঝামেলাই নেই। বিএনপি পালন করবে ৫ জানুয়ারি, আওয়ামী লীগ করবে ১২ জানুয়ারি- ল্যাঠা চুকে গেল। কিন্তু না আওয়ামী লীগ সে গণতান্ত্রিক উদারতা ও সহনশীলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ হঠাৎ ৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রাজধানীর ১৭টি স্থানে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এখন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, তারা ৩১ ডিসেম্বরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। কী আশ্চর্য! কর্মসূচি ঘোষণা হলো ২ জানুয়ারি আর অনুমতি চাইলো ৩১ ডিসেম্বর! আওয়ামী লীগ মুখে যাই বলুক, মানুষের সত্যিটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। একে বলে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা। আর কৌশলটা অনেক পুরনো। কারও সমাবেশ ভণ্ডুল করতে চাইলে, একইস্থানে সমাবেশ ডাকলেই প্রশাসন কাউকেই অনুমতি দেবে না বা ১৪৪ ধারা জারি করবে। কিন্তু এটা তো হওয়া উচিত নয়। যারা আগে অনুমতি চেয়েছে, তাদেরই অনুমতি দেওয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের। এখন পত্রিকায় দেখছি ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কোথাও নামতেই দেবে না। এটা কি কোনও গণতান্ত্রিক দলের আচরণ হতে পারে, এটা কি কোনও গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের আচরণ হতে পারে?

মানলাম গত দুই বছর ৫ জানুয়ারিতে বিএনপি যা করেছে, তা অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সে জন্য তো বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের অনেকে এখনও কারাগারে। মির্জা ফখরুল কখন ভেতরে থাকেন, কখন বাইরে থাকেন, বোঝা মুশকিল। কিন্তু গতবছরের অপরাধের দায়ে তাদেরকে আর কোনওদিনই রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না, এ কেমন কথা। এ অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়। আপনি পছন্দ করুন আর নাই করুন বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। কমপক্ষে ৩০% নিশ্চিত ভোটব্যাংক আছে তাদের। বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে বিএনপি। ইদানীং জামায়াতের খপ্পরে পড়ে লাইনচ্যুত হলেও বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। কিন্তু আপনি যদি বছরের পর বছর এই দলটিকে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না দেন, তাহলে তারা কই যাবে? এভাবে তাদের উস্কানি দিয়ে অগণতান্ত্রিক পথে ঠেলে দিয়ে পরে সবাই তাদের গালিগালাজ করাটা ঠিক নয়। গতবছরও বেগম জিয়া গুলশানের অফিস থেকে বেরুতে না পেরেই রাগের মাথায় অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ৯২ দিনের প্রাণঘাতী সে অবরোধ পরে প্রত্যাহারের সুযোগ পাননি বেগম জিয়া। আমরা চাই না বাংলাদেশে আর কখনও তেমন দুঃস্বপ্নের কাল ফিরে আসুক। বিএনপিও তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আওয়ামী বুঝলেই হয়। গণতন্ত্রের জন্য স্পেস দরকার। আওয়ামী লীগকে তা দিতে হবে। যতক্ষণ বিএনপি সহিংস কিছু না করছে, ততক্ষণ তো পুলিশ তাদের বাধা দিতে পারে না। বিএনপি অগণতান্ত্রিক, সহিংস কর্মসূচি পালন করলে আমরা সবাই মিলে তাদের নিন্দা করবো, তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেবো। আবার গণতান্ত্রিক সমাবেশ-মিছিল করতে চাইলে সরকার অনুমতি দেবে না, আওয়ামী লীগ রাজপথে নামতে দেবে না। তাহলে বিএনপি যাবেটা কোথায়, করবেটা কী?

দুই বছর আগে ৫ জানুয়ারি কী হয়েছিল, সেটা সবাই জানে। আওয়ামী লীগ দিবসটি পালন করে 'গণতন্ত্র রক্ষা দিবস' হিসেবে আর বিএনপি 'গণতন্ত্র হত্যা দিবস' হিসেবে। ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে একটি শুদ্ধ নির্বাচন হয়েছে বটে; তবে চেতনাগতভাবে গণতন্ত্র সেদিন ঊর্ধ্বে ছিল না। বাংলাদেশে আগে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে, ৫ জানুয়ারি হয়েছে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন। যে নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায়, তাকে আর যাই হোক গণতন্ত্র রক্ষার ভালো উদাহরণ হিসেবে পালন করা যায় না। সর্বোচ্চ আদালত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বৈধ বলে রায় দিয়েছে। আইনগত বৈধতার কোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তু নৈতিক বৈধতার প্রশ্নটি রয়েই গেছে। ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা না হলেও লাইফ সাপোর্টে গেছে। তাই আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছ থেকে ৫ জানুয়ারি হইচই করে পালন করা কাম্য নয়। পরিস্থিতির কারণে নির্বাচনটি করতে হয়েছিল বটে, এখন আওয়ামী লীগের উচিত ৫ জানুয়ারি নিয়ে যথাসম্ভব কম কথা বলা।

আমরা চাই না বাংলাদেশে আর কখনও ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন হোক। আমরা চাই না ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকাতে বা এর বর্ষপূর্তিতে আন্দোলনের নামে যা হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি হোক। আমরা চাই একটি উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সবার মত প্রকাশের অধিকার থাকবে, সব দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ থাকবে। এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকেই- বিএনপিকেও, আওয়ামী লীগকেও। তবে আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায়, তাই তাদের দায়িত্ব বেশি, তাদের ছাড় দিতে হবে বেশি।

পুনশ্চ: শেষ পর্যন্ত দুই দলই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। বিএনপি বলেছে, পুলিশ অনুমতি দিলে তারা নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে প্রস্তুত। আওয়ামী লীগও প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। এখানে ছাড়টা আসলে বিএনপি দিয়েছে। তারা আগে চেয়েও আওয়ামী লীগের বাগড়ার কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। তবুও বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই দলকেই ধন্যবাদ, অন্তত মুখোমুখি অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য।

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 ইমেল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ