X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

একটি ন্যায়বিচার, যা আশাবাদী করে

সাইফুর মিশু
০৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১২:৩৩আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৪:১১

সাইফুর মিশু আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার বেশ বড় ধরনের দুর্নাম আছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন তাদের জীবদ্দশায়। আর এ কারণে যেকোনও বিষয়ে আদালতের বাইরে দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেওয়ার একটি অলিখিত রীতি চালু হয়ে গেছে। আদালতের বাইরে সমঝোতায় ন্যায় বিচারের সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী পক্ষের কাছে অনেকটা নতি স্বীকার করতে হয় দুর্বল পক্ষকে।
আমি আইনের মানুষ নই, একাধিক অভিজ্ঞতা থেকেই উপরের কথাগুলো। বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতায় শুধু নয় আরও অনেক কারণে দীর্ঘ ৪৪টি বছর আমাদের দেশের একটি বড় বিচার ঝুলে ছিল। যে বিচারের এক পক্ষে দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ, অপর পক্ষে ছিল কতিপয় ঘৃণ্য খুনী যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ খুন করে উল্লাসে মেতেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এটুকু কোনও অপরাধ নয়। এই মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে ভয়ংকর আলবদর বাহিনী। আলবদর বাহিনীর ইতিহাস নতুন করে বর্ণনা করার কিছু নেই। দেশের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মাত্রই জানে কি ছিল একাত্তরে তাদের ভূমিকা। তবে একথা সত্যি যে রাজনৈতিক লেনদেনের হিসেব করে অনেকে তা স্বীকার করে, অনেকে করে না। তাই বলে দিবালোকের মত্য সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
একাত্তরের পরবর্তীতে যাদের রাজনীতি ছিলো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, যাদের বেশির ভাগেরই বিচার চলমান ছিল, কিংবা যারা প্রকাশ্যে বের হতে পারতো না, সেই ভয়ংকর ঠাণ্ডা মাথার খুনীদের বিচার শুধু বন্ধ হয়নি, তারা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা লেগেছে তাদের গাড়িতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে পর্যন্ত তাদের বসানো হয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা চেয়ে চেয়ে দেখেছি। অনুভব করেছি আমাদের পরিবারের সদস্যদের এবং মুক্তিযোদ্ধা বাবা-চাচাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।
শুধু তাই নয়, যে ইচ্ছে নিয়ে আমাদের বাবা-চাচারা নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধের যেই মূলমন্ত্র তাকে করেছে ভূলুণ্ঠিত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে বোনা হয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বীজ। তার ফল আমরা বর্তমানে দেখতে পাই আমাদের চারপাশে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক যেভাবে আমাদের মুক্তিকামী জনগণকে বলা হয়েছে ভারতের দালাল কিংবা ইসলামের শত্রু, সেই একইভাবে এখনও তারা সমাজে যারা অসাম্প্রদায়িক মন মানসিকতা ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়।


কি করে তারা এতটা শক্তিশালী আজ? তা জানা উচিত সবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে একে একে পাকিস্তানের দেখানো পথেই চলতে লাগলো দেশ। রাতারাতি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়ে গেল ইসলামিক রিপাবলিক। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার খুশি হয়ে পাঠালো উপহার। এরপর জাতীয় নেতৃবৃন্দকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করে পুরোপুরি জাতির অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হলো।

পরবর্তীকালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হলো প্রত্যক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চালিয়ে যাওয়া নির্যাতনের অংশীদার দলকে। পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা হলো তাদের রাজনীতির মাঠে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে। পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে দেশে এসে জামায়াতের ইসলামীর দলীয় প্রধান হয়ে এই দেশে রাজনীতি করলো সে, এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুঝে ছুরি বসিয়ে আত্মস্বীকৃত রাজাকারকে দেওয়া হলো নাগরিকত্ব। সেই গোলাম আযমেরই উত্তরসূরী হয়ে পরবর্তীতে দলীয় প্রধান হলো মতিউর রহমান নিজামী। এরপর মন্ত্রী, যে কিনা রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশের ভয়ংকর জঙ্গী গ্রুপকে সরাসরি অস্বীকার করে বলেছিল সেসব মিডিয়ার সৃষ্টি।
এত কিছুর পরেও দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে জাতি একের পর এক পাচ্ছে ন্যায়বিচার। মতিউর রহমান নিজামী, যে কিনা নিজ তত্ত্বাবধানে গঠন করেছিলেন আলবদর বাহিনী, যে কিনা আজ পর্যন্ত কখনওই তার এবং সেসময়ে তার দলের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হয়নি বরং দাম্ভিকতা দেখিয়েছে, সেই নম্র ভদ্র মুখোশের আড়ালের খুনীর যখন সাজা হয়, তখন বিশ্বের কোন এক কোনায় পড়ে থাকা আমার মতন একজন নগণ্য বাঙ্গালী মনে আশার সঞ্চার হয় ন্যায়বিচার পাবার। আমার মতন দেশের ন্যায়বিচার প্রত্যাশী প্রতিটি মানুষ মনে মনে সাহসী হয়ে ওঠে, তারা আশায় বুক বাধে এই ভেবে যে অন্তত এই দেশের এমন সরকার আছে যাদের কাছে আজ  হোক কিংবা কাল হোক ন্যায়বিচার আশা করা যায়। শুধু জীবিত মানুষগুলোই নয়, ত্রিশ লক্ষ আত্মা আশীর্বাদ করে এই দেশটিকে, নির্যাতিত সেই লক্ষ লক্ষ মায়েরা নিজেদের চোখ মুছে নেন শাড়ির আঁচলে, আজ জন্ম নেয়া শিশুটি মুখের দিকে আমরা সাহস নিয়ে তাকাতে পারি এ কারণে যে আমরা বিচার করেছি।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রকৌশলী, সুইডেন।
ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক