X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইরান-সৌদি বিরোধ ও বিশ্ব নিরাপত্তা

আনিস আলমগীর
০৭ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:০৮আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:৪৯

আনিস আলমগীর সর্বব্যাপী নৈরাশ্যের মধ্যেও ক্ষীণ আলোকে মনে হয় উদীয়মান সূর্য। মধ্যপ্রাচ্যে জার্মানির উপস্থিতিতে তাই মনে হচ্ছে। জার্মানি সুযোগসন্ধানী মনোবৃত্তি নিয়ে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে না। ইউক্রেনে জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মারকেল সক্রিয় ও আন্তরিক সহযোগিতা না করলে মধ্যপ্রাচ্যের মতো সমস্যার গিঁট লেগে যেত। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি এঙ্গেলা মারকেলের জন্য। রাশিয়া-ইউক্রেনের বিরোধ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি শেষ পর্যন্ত।
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন আর ফ্রান্স দীর্ঘদিনব্যাপী সমস্যা সমাধানে সক্রিয়। কিন্তু প্রত্যেকে চায় তাদের অনুকূলে সমস্যার সমাধান হোক। যে কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি। পশ্চিমাদেশগুলোর জ্বালানির প্রয়োজন। দুনিয়ার যত জ্বালানির প্রয়োজন তার প্রায় ২৫% জ্বালানির প্রয়োজন হয় আমেরিকার অথচ তার নিজ তহবিল থেকে আসে মাত্র ৩% জ্বালানি। অবশিষ্ঠ ২২%-এর জন্য নির্ভর করতে হয় মধ্যপ্রাচ্য, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোর ওপর।

দৈনিক ৮০ কোটি ডলারের জ্বালানি কিনে যুক্তরাষ্ট্র। জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিলে তাদের জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশেই কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের কোনওখানেই কোনও সুস্থ অবস্থা বিরাজমান নেই। সব অসুস্থতার মূল অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে পশ্চিমা দেশগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবখানেই হাজির।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর (২০১৫) রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিত হয়েছে। এখন উপস্থিত হলো জার্মানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে জার্মানিই সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ এবং সর্বত্র গঠনমূলক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে। বিংশ শতাব্দীর দুটো বিশ্বযুদ্ধের একপক্ষের নেতা ছিল জার্মানি- যুদ্ধে যুদ্ধে কাটিয়েছে দীর্ঘ এক দশক। যুদ্ধের তীক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশটির। সম্ভবত তাই এখন জার্মানির ভূমিকা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে।

ইরাকে যে সব এলাকা আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত হচ্ছে সে সব এলাকায় পুনঃগঠনের কাজে সহায়তা করছে জার্মানি। তিকরিত শহর মুক্ত হওয়ার পর দেড় লাখ লোককে সেখানে পুনর্বাসনে সহায়তা করেছে দেশটি। পুলিশ বাহিনী, বিদ্যুৎ লাইন, গ্রিড, স্কুল-কলেজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগিতা দিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় আগে থেকেই সেকুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল। শিয়া ও সুন্নিপন্থীদের উগ্রতা থেকে মানুষের জান-মাল রক্ষার জন্য সেকুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোনও পথ আছে বলে মনে হয় না।

জার্মানি কুর্দিদেরকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। কুর্দিরা এখন সিনজার শহরটি আইএস এর কবল থেকে মুক্ত করেছে। এ সিনজার শহর দখল করার পর ইয়াজিদি সম্প্রদায়কে ইসলামিক স্টেট-এর লোকেরা নির্বিচারে কচুকাটা করেছে। মিডিয়ার কেউ কেউ ইয়াজিদি সম্প্রদায়কে খ্রিস্টান বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদিরা শিয়া মুসলমানদের একটা ক্ষুদ্র সেক্ট।

গত ডিসেম্বরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর এক বৈঠক হয়েছিল ভিয়েনায়। সিরিয়ার অস্ত্রবিরতি এবং একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে সবপক্ষই একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। আমেরিকা ও রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার। তারাও ভিয়েনায় ন্যূনতম মতৈক্যের কথা বলেছেন। ভিয়েনা বৈঠকের পর মনে হচ্ছে যে আমেরিকা তার ভূমিকা শীতল করার চেষ্টা করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার এজেন্ট-স্টেট তুরস্ক এবং সৌদি আরবকে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সামনে আসার জন্য উৎসাহিত করছে।

সৌদি আরব এরই মধ্যে ৩৪টি সুন্নি রাষ্ট্রের টেলিফোনে সম্মতি নিয়ে একটা জোট গঠনের কথা ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়া ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার মাঝে একটি সমঝোতা রয়েছে। ইরান-ইরাক-সিরিয়া শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। সৌদি আরবকে দিয়ে আমেরিকা সুন্নিপন্থীদের বৃহত্তম জোট উৎপত্তি করার চেষ্টা করলো কিনা কে জানে। হয়তো শেষমেষ যার নেতৃত্ব দেবে আমেরিকা।

সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য শিয়া সুন্নি বিরোধের কারণে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মাঝে রয়েছে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলো সবাই এখন মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিত। সবাই চেষ্টা করছে অশান্তির মূল কারণ ইসলামিক স্টেটকে উচ্ছেদ করে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলোর মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এমন একটি পরিস্থিতে সৌদি আরবের শিয়া নেতা শেখ নিমর আল নিমবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলো সৌদি সরকার। সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যা ২০% শিয়া, শেখ নিমর আল নিমর সৌদি শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা।

২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় নিমর আল নিমর সৌদি রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। সুন্নিরাও শেখ নিমরকে শীতল সমর্থন দিয়েছিল। সে আন্দোলন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব উৎসাহিত করে কোনওরকমে সামাল দিলেও শেখ নিমরের বিরুদ্ধে সৌদি রাজার ক্ষোভ কখনও কমেনি। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের অভিযান সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সৌদি আরবের অভিযোগ ইয়েমেনে ইরান অব্যাহতভাবে শিয়াদের সাহায্য করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতিটাকে আরও অস্থিতিশীল করা দরকার মনে করেই সম্ভবত সৌদি সরকার শেখ নিমরকে বলির পাঁঠা বানালো। শিয়া-সুন্নি সংঘাতটাকে দীর্ঘায়িত করতে পারলে সৌদি রাজার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সৌদিরা মনে করে তারা শুধু সৌদি আরবের রাজা নন, তারা সুন্নি পক্ষেরও রাজা। সৌদি রাজতন্ত্রের নেতারা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছেন। একটা পরিবারের শাসন অব্যাহত রাখার জন্য বিশ্বের সমৃদ্ধ একটা এলাকাকে এভাবে নষ্ট করার সৌদি রাজ পরিবারের ভ্রান্তনীতিকে কোনওভাবে সমর্থন করা যায় না।

শেখ নিমর হত্যার প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি দূতাবাস আক্রমণ করেছে ইরানি শিয়ারা। তার প্রতিবাদে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। সৌদি আরব জাতিসংঘে অভিযোগ করেছে তার কূটনীতিকদের রক্ষার ব্যাপারে তেহরানের ব্যর্থতার অভিযোগ এনে। জবাবে তেহরান বলেছে, তারা ব্যর্থ নয়, কারণ কোনও কূটনীতিক আহত হননি বা তারা তখন সেখানে ছিলেন না। সৌদি আরবকে অনুসরণ করে কুয়েত, বাহরাইন আর আফ্রিকান রাষ্ট্র সুদানও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করলো। আরব আমিরাত তার জনবল কমিয়ে এনেছে তেহরানে, অর্থাৎ ডাউনগ্রেড করেছে কূটনৈতিক সম্পর্ক।

ধর্মীয় দিক থেকে সৌদি আরব এবং ইরান একে অন্যকে শত্রুরাষ্ট্র মনে করে। সৌদি আরব নিজেদেরকে সুন্নি ও ইরান নিজেদেরকে শিয়া সম্প্রদায়ের স্বঘোষিত হেফাজতকারী মনে করে আসছে। তাত্ত্বিক দিক থেকে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে খুব বড় ব্যবধান না থাকলেও, সৌদিপন্থী সুন্নিরা অনেকে শিয়াদের মুসলমান মনে করে না। এরা আহলে হাদিস, সালাফি, ওয়াহাবি- নানা নামে এক ও অভিন্ন সৌদিপন্থী সুন্নি। অন্যদিকে শিয়ারা মূলত সুফিবাদ ও আত্মদর্শনে বিশ্বাসী, তাসাউফে বিশ্বাসী ধারার মুসলিম, যাদের সঙ্গে আবার উপমহাদেশের সুন্নিদের অনেক মিল রয়েছে। শিয়ারা মূলত জাফরি ফেরকার অনুসারী এবং উপমহাদেশের মুসলিমরা হানাফি ফেরকার অনুসারী। হানাফি ফেরকার অনেক কিছু আবার জাফরি ফেরকা থেকে নেওয়া।

তত্ত্বের বাইরে আবার সৌদি আরব ও ইরান মুসলিম বিশ্বের তেল উৎপাদনকারী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র। এখন মনযোগ পাওয়ার জন্য তারা স্ব স্ব শিবিরে নিজেদেরকে ‘শিকার’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আর এই দুই শিবিরের পেছনে নেপথ্য প্রতিরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করছে আমেরিকা ও রাশিয়া।

অবশ্য সুন্নি শিবিরে সৌদি আরবের মাতব্বরী অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে কারণ দেশে দেশে ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠী সৌদি মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সন্ত্রাস করছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত আইএস গোষ্ঠীও সৌদি ওয়াহাবি মতের অনুসারী। সৌদিদের কট্টরপন্থা এতই বাড়ছে কোনদিন তারা হানাফি এবং অন্যান্য মতানুসারী সুন্নিদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে- সেটাও আতংকের বিষয় অনেকের কাছে।

সৌদি আরব শেখ নিমরকে হত্যা করে যেভাবে শিয়া-সুন্নি বিরোধ উস্কে দিলো শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই মুশকিল হবে। এ সমস্যাটার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন আমেরিকা জার্মানি আর রাশিয়া দ্রুত ইরান-সৌদির বিরোধ হস্তক্ষেপ না করলে গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে পড়বে।

 লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ