X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি ও সমঝোতার পথে রাজনীতি!

বিভুরঞ্জন সরকার
১১ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:৫৮আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:৩৪

বিভুরঞ্জন সরকার ৫ জানুয়ারি পালনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্ব শুভবুদ্ধির পরিচয় দেওয়ায় তা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। এক ধরনের অঘোষিত সমঝোতার ভিত্তিতে ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ঢাকায় দুটি এবং বিএনপি একটি সমাবেশ করেছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পৃথক পৃথক সমাবেশ করেছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর সতর্কতামূলক অবস্থানে থাকার কারণেই শুধু সংঘাত হয়নি, তা নয়। উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চেয়েছেন বলেই ৫ জানুয়ারি দিনটি শান্তিতে কেটেছে। নতুন বছরের রাজনীতি সংঘাতমুক্ত হবে- এই আশাবাদ মানুষের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নিশ্চয়ই এতদিনে ঠেকে শিখেছে। সরকার এবং আওয়ামী লীগের শক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা হয়েছে। সহসাই তারা আর কোনও হঠকারিতার পরিচয় দেবে না বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। ৫ জানুয়ারি উভয় পক্ষ শান্তি ও সমঝোতার অনুকূলেই কথা বলেছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি এবং তার সমর্থকরা সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, জামায়াতে ইসলামের ফাঁদে পা দিয়েই বিএনপি নির্বাচন বর্জনের নির্বুদ্ধিতার দিকে গিয়েছে। এখন যারা বলছেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচনমুখি দল, তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে অযৌক্তিক মনে করেননি। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়- এই নাছোড়বান্দা জেদ ধরে বিএনপি কোন গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে, সে প্রশ্নটা গণতন্ত্রের জন্য ব্যাকুলপ্রবণ নাগরিক সমাজের অনেক প্রতিনিধিকেই তুলতে দেখা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী পাকিস্তানি বর্বর ঘাতক সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। তাই তারা চায়নি বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নিক। একে তো নাচুনি বুড়ি, তাতে আবার ঢাকের বাড়ি। নির্বাচন বর্জনের নাচনকোদন বিএনপির জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
বিএনপি-জামায়াত নিজেরা শুধু নির্বাচনে অংশ না নিয়ে চুপচাপ থাকেনি। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পদের যে অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করেছে, তা একেবারেই নজিরবিহীন। তারা সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়, গোটা দেশের বিরুদ্ধেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশ আন্দোলনের দেশ। বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামী মানুষ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস তৈরি হয়েছে। কিন্তু অতীতে কখনওই আন্দোলনকারীরা নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে কিংবা জিম্মি করে, রাষ্ট্রের এবং সাধারণ মানুষের সম্পদ ধ্বংস করে কোনো আন্দোলন করেনি। আন্দোলন দমন করার জন্যই অতীতে শক্তি প্রয়োগ হয়েছে, সম্পদ ও জীবননাশ হয়েছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ, নাশকতা, সন্ত্রাসের নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। বিএনপির দাবির প্রতি যাদের সহানুভূতি ছিল, তারাও তাদের আন্দোলনের কৌশলের সাথে একমত হতে পারেনি। তাই বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন পরিণত হয়েছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এবং স্বাভাবিকভাবে হয়ে পড়েছিল গণবিচ্ছিন্ন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে বিএনপি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তার জন্য শতভাগ দায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট। এরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণই হতো। যারা মনে করেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ‘শুদ্ধতা’ রক্ষিত থাকেনি, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়াকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় না। প্রকৃত নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকতে হবে এবং ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের স্বাধীনতা থাকতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তা না হওয়ায় ওই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। গ্রহণযোগ্যতা কিংবা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট থাকলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কোনওভাবেই অবৈধ বা অসাংবিধানিক বলা যাবে না। সরকার পক্ষও ওই নির্বাচনকে আদর্শ নির্বাচন না বলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় নির্বাচন বলেই দাবি করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যদি পুরোপুরি মান্য না-ও করে থাকে, তারপরও এটাই সত্য যে, ওই নির্বাচনই গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছে। যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে নানা কূটতর্ক করেন, তারা কিন্তু একবারও বলেন না যে, ওই নির্বাচনটি না হলে কি হতো? তখন দেশে গণতন্ত্র থাকতো? সংবিধান থাকতো? এ-সব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে তো বলতেই হবে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনই দেশে গণতন্ত্র রক্ষা করেছে। ওই নির্বাচন না হলেই গণতন্ত্র ‘হত্যা’ হতো।

যে নির্বাচন গণতন্ত্র রক্ষা করলো সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। গত বছর ৫ জানুয়ারির গণতন্ত্র ‘হত্যা’ দিবস পালন করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত যে সহিংসতা চালিয়েছে, তা এক কথায় গণতন্ত্রের পাঁজরে ছুরি চালানোর শামিল। পেট্রল বোমা, আগুন সন্ত্রাস ছড়িয়ে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। প্রায় দেড়শ’ মানুষ হত্যা করে, নানা উপায়ে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না।

আওয়ামী লীগের ওপর, সরকারের ওপর বিএনপি-জামায়াতের প্রচণ্ড রাগ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপি-জামায়াতের বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় চালিত করার যে নকশা বাস্তবায়ন করে চলছিল তারা, আওয়ামী লীগ তাতে বাধ সেধেছে। শুধু তাই নয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা সংঘটিত করেছিল, জিয়াউর রহমানের আনুকূল্য ও বদান্যতায় যারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার  সুযোগ পেয়েছিল, জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া যাদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার বানিয়েছিলেন, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি দেয়ার স্পর্ধাও এই সরকার দেখিয়েছে। কাজেই এই সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নেমে তাদের আর উপায় কি?

কিন্তু সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে চিনতে ভুল করেছে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী। শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। শেখ মুজিবকে যেমন কেউ ভয়ভীতি দেখিয়ে নত করতে পারেনি, ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করেও বিচলিত করতে পারেনি, তেমনি শেখ হাসিনাকেও তার প্রতিজ্ঞা থেকে, অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত করার শক্তি যে কারো নেই গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে গত দুই বছরে তা প্রমাণ হয়েছে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার মুখে মানুষ পুড়িয়ে মারার অসহনীয় অবস্থা দেখে শেখ হাসিনা হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বেন। তিনি হয়তো নমনীয়তা দেখাবেন। কিন্তু না, শেখ হাসিনার  ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত বহমান। তাই কবি গুরুর অমর বাণী ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ হৃদয়ে ধারণ করে সব ভয়ভীতিকে জয় করে আগুন সন্ত্রাসীদের দৃঢ়হাতে মোকাবেলা করেছেন। যারা আশা করেছিল, ৫ জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা যে সরকার গঠন করেছেন, তা হবে অত্যন্ত স্বল্পায়ু, তারা হতাশ হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়া যে সরকার গঠন করেছিলেন তা মাসাধিক কাল স্থায়ী হয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে যারা গোঁফে তেল দিতে শুরু করেছিলেন তাদের আশার গুড়ে বালি দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বর্তমান মেয়াদের দুই বছর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণ করলো। প্রমাণ হলো, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।

আমাদের দেশে একশ্রেণীর বুদ্ধিবাজ আছেন যারা আওয়ামী লীগের দোষ-ত্রুটি ধরার জন্য সারাক্ষণ দূরবীন হাতে ঘুরে বেড়ান। তারা আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক বলে মনে করেন না। তাদের বিবেচনায় বিএনপি হল গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মাখামাখিও তাদের কাছে দোষের বলে মনে হয় না। জঙ্গিবাদী জামায়াতের ঘাতকচরিত্র আড়াল করা বা লঘু করে দেখা তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। জামায়াতের ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর জন্য যদি সাময়িকভাবে আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রবিরোধী কোনও পদক্ষেপও নিতে হয় তাহলে সেটাও সাময়িকভাবে সমর্থন করাই গণতন্ত্র বিকশিত করার পথ। বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি বিপজ্জনক এবং বিকৃত। জামায়াতকে বাদ দিয়ে এবং সহিংসতা পরিহার করে বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনীতির পথে হাঁটতে পারে তাহলে তারা নিশ্চয়ই রাজনীতি করার স্পেস পাবে। পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থেকে বিএনপি নিজেদের বদলানোর সাক্ষ্য রেখেছে বলেই ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে পেরেছে। এখন ‘এই সরকারের দ্রুত পতন হবে’ এই অবাস্তব খোয়াব দেখা বন্ধ করে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিলেই সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলে পরিণত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পাবে বিএনপি। ৫ জানুয়ারির সমাবেশে আলোচনা করে সমাধান বের করার যে কথা বেগম জিয়া বলেছেন, তা অনেকের মনেই আশা জাগিয়ে তুলছে। স্বস্তিবোধ করছেন এই ভেবে যে, বেগম জিয়ার মনেও হয়তো যুক্তিবোধ জেগে উঠছে!

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ