X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এরশাদবচন

আমীন আল রশীদ
২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১২:৫৯আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:০১

আমীন আল রশীদ‘প্রধানমন্ত্রী চাইলেই মন্ত্রিসভা ছাড়বে জাতীয় পার্টি’-এমন মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, যিনি শুরু থেকেই সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি জাতীয় পার্টির একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সমালোচনা করেছেন। ‘সময় হলেই জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাবে’ ঘোষণা দিলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদ থেকে সরবেন কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। তবে সবশেষ ২৩ জানুয়ারি নেতাকর্মীদের সামনে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ দূত করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে এ পদ ছেড়ে দিয়ে তাকে অসম্মানিত করতে পারি না। অবশ্যই এ বিষয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।’ জাতীয় পার্টিকে আবারও বিরোধী দল দাবি করে এরশাদ বলেন, আমরা অবশ্যই এই সংসদের বিরোধী দল। আশা করি, আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদে এমন কোনও বক্তব্য রাখবেন না যাতে করে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।’
দলের মহাসচিব ও কো-চেয়ারম্যান রদবদল নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় আসেন এরশাদ। ফলে দলের ভেতরে ‘সাহেব বিবির দ্বন্দ্ব’ আবারও পরিষ্কার হয়। যদিও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ থেকেই এই বিরোধ স্পষ্ট হতে থাকে। এমনকি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না,  মন্ত্রিসভায় যোগ দেবে কি দেবে না-এসব নিয়ে নাটকের পর নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। আর এসব নাটকের কারণে এ সময় কোনও কোনও গণমাধ্যম এরশাদকে ‘মহা খলনায়ক’ বলেও উল্লেখ করে।
নির্বাচনে ইউটার্ন
নির্বাচন নিয়ে তার দফায় দফায় ইউটার্ন পুরো নির্বাচনি পরিবেশকেই ঘোলাটে করে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, দেশের মানুষের মনেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়, এরশাদের এই নাটকের ফাঁদে পা দিয়েই তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি এবং আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়লাভ করে। এরপর এরশাদকে যখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত মনোনীত করা হয়, তখন অনেকের মনেই এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, এরশাদ হয়তো বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সরকারের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করেছেন।
তবে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কখনোই তাকে মুক্তভাবে রাজনীতি করতে দেয়নি। সে কারণেই বারবার তিনি মন বদল করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এরশাদ যখনই নির্বাচনে না যাবার ঘোষণা দিয়েছেন, তখনই তাকে জেলের ভয় দেখানো হয়েছে এবং তিনি আবার ভোল পাল্টেছেন।

নির্বাচনের দুই মাস আগে, ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর এরশাদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে অংশ নিলে মানুষ থুথু দেবে।’ এর পরদিন বলেন, ‘জেলে মারা গেলেও আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে জাতীয় বেঈমান হবো না।’ ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ্ আহমদ শফির দোয়া নিতে যান এরশাদ। সেখানেও একই কথা বলেন। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই ভোল পাল্টে ফেলেন। ১৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে ঘোষণা দেন- ‘কে নির্বাচনে এলো, কে এলো না; তা দেখার সময় নেই। নির্বাচনে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি।’

নাটক এখানেই শেষ নয়। ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪৮টি আসনে জাতীয় পার্টির ২৯১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। ৩ ডিসেম্বর এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। ২৭ ঘণ্টার অজ্ঞাতবাসে থেকে দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন।

এরশাদ নির্বাচনে যাবেন কি যাবেন না- এ নিয়ে যখন ধূম্রজাল বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন ২৩ ডিসেম্বর তার দলেরই একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এরশাদের এই নাটকের শেষ পর্ব দেখতে তার শপথ গ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এরশাদ যদি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেন, তাহলে বলা যাবে- তিনি আসলেই নির্বাচন বর্জন করেছেন। কারও সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। আর যদি এরশাদ শপথ নেন, তাহলে বলতেই হবে- এখন যা চলছে, তা সবই নাটক। রওশনকে সামনে রেখে এরশাদ নিজেই এগুলো করিয়েছেন।’

১২ ডিসেম্বর এরশাদকে তার বারিধারার বাসভবন থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমইচে নিয়ে যায় র‌্যাব। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিনও সেখানে ছিলেন তিনি। যেখানে তাকে আসলে চিকিৎসার নামে বন্দি করে রাখা হয়। এ অবস্থাতেই তিনি ১০ জানুয়ারি অনেকটা গোপনে সংসদে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। শপথ নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে গেলেও ১২ জানুয়ারি প্রধানন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত হবার পর ফিরে যান নিজের বাসায়। সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি সুস্থ।

শত্রু তুমি বন্ধু তুমি

এরশাদ সম্পর্কে রাজনীতিতে যতগুলো কথা প্রচলিত, তার মধ্যে একটি এরকম যে, এরশাদ সকালে যা বলেন, বিকালে তা বদলে ফেলেন। রাতে শোনা যায় নতুন কথা। ১৯৮২ সালে তৎকালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে ‘অভিনয়’ করে খলনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু তার। রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন মাস পর এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন।

১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বরর ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েও পরের ছয় দিন পর্দার আড়াল থেকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব ধরনের চেষ্টা করেন। তার পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে কারাগারে যেতে হয় তাকে। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কারাগার থেকে মুক্তির পর বড় দুই দলের সঙ্গেই তিনি মন বদলের নাটক করেছেন।

ছিয়ানব্বই সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে ক্ষমতার শরিক হয় জাতীয় পার্টি। যদিও তিন বছরের মধ্যেই সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগকে ছেড়ে চারদলীয় জোট করেন বিএনপির সঙ্গে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো সক্রিয় হওয়ায় সেই জোট থেকে মাত্র এক বছরের মাথায় বেরিয়ে আসেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করেন।

২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় জোটের শাসনামলের পুরো সময় ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিলেন এরশাদ। সরকারের সমালোচনা কিংবা প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সখ্য কোনোটিই করেননি। ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে আবার স্বরূপে আবির্ভূত হন। বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের আশ্বাস দিয়েও যোগ দেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে।

দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে প্রধান দুই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ আরও বেশি কিছু শীর্ষ নেতা কারাগারে যান। কিন্তু বাইরে থাকেন এরশাদ। গা বাঁচাতে রাজনীতি থেকে অবসরেরও ঘোষণা দেন। দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়েন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ঠিকই ফিরে আসেন। মহাজোটের শরিক হয়ে ক্ষমতার অংশ হন।

শোনা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নিতে সরকারকে চারটি শর্ত দিয়েছিলেন এরশাদ। এক. তার বিরুদ্ধে থাকা যেসব মামলা শেষ পর্যায়ে আছে, সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা; দুই. তার নির্দেশ মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে যারা সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন, তাদেরকে ব্যাংক-বিমা-করপোরেশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া; তিন. এরশাদের ভাই জি এম কাদের, যিনি এরশাদের নির্দেশ মেনে নির্বাচনে অংশ নেননি, তাকে উপনির্বাচনে জয়ী করে সংসদে আনা; চার. জাতীয় পার্টি থেকে কাউকে মন্ত্রী না করা। তিনি এও বলেছেন, তার এ শর্তগুলো মানলে দশম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হতেও তার আপত্তি নেই। অন্যথায়, তিনি যেভাবে আছেন, প্রয়োজনে সেভাবেই থাকবেন। তবে শোনা যায়, এরশাদের প্রতি সরকারের শীর্ষ মহলের আস্থার সংকট আছে। তাই এরশাদকে কখনও চাপে, কখনও হাতে রাখার কৌশল অবলম্বন করা হয়।

মামলার ভয়

এরশাদ কেন বারবার ভোল পাল্টান? অনেকেই মনে করেন এর একমাত্র কারণ তার জেলভীতি। গণআন্দোলনের মুখে নব্বইয়ে ক্ষমতা ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিএনপি শাসনামলের পুরোটা সময় জেলে কাটান সাবেক এ সেনা প্রধান। তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা শত্রুর সঙ্গে বসবাস বইয়ের ১৫৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমি যতদিন এরশাদকে কাছ থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে জেলের চেয়ে বেশি ভয় সে আর কিছুকে পায় না। এমনকি আল্লাহর চেয়েও বেশি ভয় পায় জেলকে। শেখ হাসিনার কারণে তার দল ভেঙে গেছে, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা জাতীয় পার্টি করেছে- এ নিয়ে তার যতটা রাগ, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্রোধ জেলে নেওয়ার কারণে। একই কারণে তার রাগ দেখেছি খালেদা জিয়ার প্রতিও। জীবনে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে সে তার কারণে। অনেকবার আমাকে বলেছে সে এই কথা। সেই সঙ্গে জানিয়েছে তার একটি প্রতিজ্ঞার কথা। বলেছে, জীবনে যদি একদিনের জন্যও সুযোগ পাই, এর প্রতিশোধ আমি নেব। দুই মহিলার যাকেই আগে বাগে পাবো, চরম শিক্ষা দেব। আর আমার জীবনের কোনও ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকেনি। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু সুযোগ আমি পাবোই।’

এরশাদের এই জেলভীতিকে কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দু দলই। অর্থাৎ এরশাদ যখনই বেঁকে বসেছেন তখনই তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো চাঙ্গা করা হয়েছে। আবার এরশাদ যখন বাগে এসেছেন, তখন মামলার ফাইল চাপা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এরশাদকে বশ করতে এই মামলা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হলেও বর্তমানে যে দুটি মামলা চলমান, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মঞ্জুর হত্যা মামলা। এই মামলায় এরশাদসহ মোট পাঁচজনের বিচার চলছে। এর মধ্যে এরশাদ অভিযোগপত্রভুক্ত প্রধান আসামি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে এরশাদের নির্দেশে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

ফলে দেশের মানুষের কাছে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে প্রমাণের জন্য এরশাদ কদাচিৎ সরকারের সমালোচনা করলেও পরক্ষণেই তার মনে মামলার ভীতি জাগ্রত হয়। সুতরাং জাতীয় পার্টি যত হম্বিতম্বিই করুক, তারা যে শেষ অবধি সরকারের অংশ হয়েই থাকবে- তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।  

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ