X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দরকার নেই এমন পুলিশের

চিররঞ্জন সরকার
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৬আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০৩

চিররঞ্জন সরকার পুলিশ নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের সীমা নেই। পুলিশ খারাপ। পুলিশ অপরাধ দমন ও অপরাধীদের ধরতে পারে না। পুলিশ ঘুষ খায়, চাঁদাবাজি করে। ছিনতাইও করে। নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে। মামলা নিতে চায় না। মামলা নিলেও তদন্ত ঠিকমত করে না। পুলিশ আর অপরাধ সমার্থক হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের কাছে গেলে কোনও ঘটনার প্রতিকার পাওয়া যায় না, উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। ছিনতাইয়ের মামলা দিতে গেলে ওরা নেয় হারানোর এজাহার। এমনি অসংখ্য অসংখ্য অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। এতোদিন ধরে বলা হতো, পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু এখন পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রায়ই তারই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। কিন্তু ঘটনার প্রতিকার হচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, পুলিশ  এ রকম উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?
গত বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুরের গুদারা ঘাট এলাকায় চা দোকানি বাবুল তার দোকানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বাবুলের পরিবারের অভিযোগ, চাঁদা না পেয়ে পুলিশ বাবুলের দোকানের কেরোসিনের চুলায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। এতে কেরোসিন ছিটকে বাবুলের গায়ে আগুন ধরে যায়।
অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে শাহআলী থানা থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ নয়, সোর্স দেখে পালাতে গিয়ে বাবুল দগ্ধ হন। আর বাবুল নিজেও মাদক বিক্রেতা ছিলেন।
আমাদের দেশে কেউ যদি কোনও দোষ বা অপরাধ করে, তবে তা স্বীকার করে না বা স্বীকার করতে চায় না। পুলিশ হলে তো আরও না। পুলিশের বিরুদ্ধে যখনই কোনও বড় অভিযোগ সামনে চলে আসে তখনই তারা তাড়াহুড়ো করে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে সব দায় চাপিয়ে নিজেদের মহৎ প্রমাণের চেষ্টা করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুলিশের বদৌলতে চা-বিক্রেতা বাবুলকে আগুনে পুড়ে মরতে হলো। বাড়তি হিসেবে জুটল মাদকব্যবসায়ীর কলঙ্ক!
পুলিশ একের পর এক বেআইনি সব কাণ্ড করেই চলেছে। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি আদাবরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হেনস্থা করে আদাবর থানার এক এসআই। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বী এবং সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তাকে নির্যাতন করার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিরাজ করছে। চুলার ছিটকে পড়া তেলের আগুনে দগ্ধ হয়ে চা বিক্রেতা বাবুলের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর শাহআলী থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এটাও এক আজব ব্যবস্থা। কোনও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও কিছু ঘটলেই তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের ‘ক্লোজড’, ‘সাময়িক বরখাস্ত’, ‘বদলি’, ‘বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ’ ইত্যাদির কথা শোনা যায়। এতে আসলে তাদের কী হয়, সেটা জানা যায় না। আমরা বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিতদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাবাস, অর্থদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি হতে দেখি। কিন্তু অপরাধী পুলিশের কী হয়? আদৌ কি কিছু হয়? ‘ক্লোজড’, ‘সাময়িক বরখাস্ত’, ‘বদলি’, ‘বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ ইত্যাদি কি আসলে আইওয়াশ?
পুলিশের খারাপ কাজের প্রসঙ্গ এলেই বলা হয়, তাদের বেতন কম, সুযোগ-সুবিধা কম, ছুটি নেই, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই, অতিরিক্ত সময় ধরে ডিউডি করতে হয়। বলা হয়, সরকার যেহেতু পুলিশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তাই পুলিশ সরকারের কথা শোনে না। এমন কথাও বলা হয়, একটি বিশেষ জেলার লোককে পুলিশে ঢোকানে হচ্ছে, পুলিশে ঢুকতে হলে এখন কমপক্ষে ৮-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, তাই তারা এই টাকা তুলে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া ঘুষ-দুর্নীতি-ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়। অনেকে আবার সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের দোহাই দেন। বলেন, যেখানে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ অসৎ, দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, সেখানে পুলিশ ভালো থাকে কী ভাবে? এসব কথার মধ্যে যুক্তি আছে অবশ্যই। কিন্তু এসব কথা পুলিশের যাবতীয় অপকর্মকে এক ধরনের দায়মুক্তিও দেয়। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত এক-আধটা ছোট-খাট অপরাধমূলক তৎপরতায় পুলিশ বাহিনীর কোনও কোনও সদস্য জড়িত থাকতেই পারে, কিন্তু একটা পুরো বাহিনীর ইমেজ যখন অপরাধের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়, জাতীয় ভাবে একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে তখন সেটা অবশ্যই বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের হাতে অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভার, তারাই যদি অপরাধী ও বিশৃঙ্খল, বেপরোয়া হয়ে যায়, তখন আমাদের আর ভরসার জায়গা থাকে কোথায়?

সেবাই পুলিশের ধর্ম এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করা হয় সকল পুলিশ সদস্যকে। জনগণের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব তাদের। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা কম। বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশ সদস্য বাড়ানোর কথা মাঝে মাঝে উঠে আসে। নিয়মানুসারে পুলিশ জনগণের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। পুলিশকে বন্ধু ভাবা তো দূরে থাক শত্রু ভাবতেও আমাদের দেশের মানুষ ইচ্ছুক নন। এর পেছনের কারণটা হলো কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের বিপথগামিতা। এই পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধকর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন। মামলা তদন্তে ঘুষ নেওয়া, গ্রেফতার বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার পাশাপাশি ছিনতাই-ডাকাতি, মাদক কেনাবেচা, ধর্ষণসহ বড় ধরনের অপরাধে পুলিশের জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে পুলিশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। বাংলায় তো প্রবাদতুল্য কথাই আছে, ‘বাঘে ছুলে দশ ঘা, পুলিশে ধরলে আঠারো ঘা’! সুতরাং পুলিশ হইতে সাবধান! শিশু কথা শুনছে না, সময়মতো খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না? বলা হচ্ছে, ‘পুলিশ ডাকবো কিন্তু!’ এই হলো আমাদের দেশে পুলিশের ভাবমূর্তি! শৈশব থেকেই সবাই জানে, পুলিশ ভীতিকর, ‘জনগণের বন্ধু' বললেও খুব না ঠেকলে কেউ তাঁকে বন্ধু ভাবে না। অথচ ছোট-বড় যে কোনও সমস্যায় পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয় সবাইকেই। সবসময়  সবাইকে আশাহত হয়েই ফিরতে হলে একটা দেশের হাল যে কী হবে তা কল্পনা করলেও গা শিউরে ওঠে।

অথচ এর উল্টো দিকটা ভাবুন। '৭১-এর কালো রাত্রিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে প্রথম যাঁদের অস্ত্র গর্জে উঠেছিল তাঁরা কিন্তু পুলিশ। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তাঁরা কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়েছেন, দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন অকাতরে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর সোচ্চার হওয়ার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবির যে বিক্ষোভের নামে ধংসযজ্ঞে নামে, তা রুখতে গিয়েও প্রাণ গিয়েছে পুলিশের। সেবায়-সাহসে-সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠায় কিছু কিছু পুলিশ এখনও সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। তাহলে আজ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এমন অবক্ষয়ের শিকার কেন হলো? কেন তাদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না?

এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে চূড়ান্ত পরিণামে সর্বনাশ হবে সমগ্র দেশের। প্রায় দেড় লাখ সদস্য সম্বলিত একটি বাহিনী, যাদের হাতে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, তারা যদি সরকারের প্রশ্রয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরে আনা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তখন নিজেদের রক্ষা করাও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তাই পুলিশের ব্যাপারে যত শিগগির সম্ভব ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে শৃঙ্খলা। পুলিশের হাত ধরে দেশকে রসাতলে নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পুলিশ বাহিনীর স্পর্ধা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। এটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। যখন টাকা না দেওয়ার কারণে একজন চা বিক্রেতাকে আগুনে পুড়ে যেতে হয়, তখন এ রকম পুলিশ সদস্য আমাদের দরকার নেই।

পুলিশ নই, রাজনীতিবিদ নই তবুও ক্ষমা চাইছি ওই চা-বিক্রেতা পরিবারের কাছে। কেননা এই পুলিশ বাহিনী আমাদের টাকাতেই পরিচালিত। এই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এবং সরকার আমাদের ভোটেই নির্বাচিত। তাই এই দায় আমাদেরও, আমারও।

আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, দয়া করে পুলিশকে সামলান। পুলিশকে তাদের কর্তব্যে ফিরিয়ে আনুন।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ