X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের সৌন্দর্যবোধ ও সংবেদনশীলতার অ্যান্টেনা

প্রসূন রহমান
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২২:২২আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৪:২৭

প্রসূন রহমান মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সৌন্দর্যপ্রিয়। আমরা সুন্দর মানুষ দেখতে পছন্দ করি। সুন্দর পোশাক পছন্দ করি। সুন্দর করে ঘর-দোর অফিস সাজাই। সুন্দর রাস্তাঘাট দেখতে চাই, শহরটাকে সুন্দর দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের পছন্দ ও চাওয়ার সঙ্গে অভ্যাস, আচরণ ও বাস্তবতার পার্থক্য এত বেশি যে, একসময় নিজেরাই সৌন্দর্যবোধের চেতনা হারিয়ে ফেলি। সব ক্ষেত্রে সুন্দর দেখা দূরে থাক, আমাদের সৌন্দর্যবোধের আকাঙ্ক্ষাগুলোও ভোঁতা হয়ে আসে। ফলে অভ্যস্ত চোখ, মন ও শরীর, অবচেতনে মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার দুটো কাজই করে ফেলে এবং অসুন্দরের সঙ্গেও এক ধরনের বোঝাপড়া করে নেয়। যা একসময় নিতান্তই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
রাজধানীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা ‘লাভ অ্যান্ড হেইট রিলেশনশিপ’-এর মতো। এ শহরে আমরা সবাই বাস করি, নিজেদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ব্যবহার করি, কিন্তু এ শহরকে আমরা খুব একটা ভালোবাসি না। বুকের কোণে যেটুকু ভালোবাসা থাকে, তারও কোনও প্রকাশ বা বিনিময় হয় না। সবসময় সমালোচনাটাই প্রকাশ পায়। প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্বেরও যে একটা ব্যাপার থাকে, এ বিষয়টা আমরা বেশির ভাগ সময় ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। তবে, প্রসঙ্গ যদি পরিচ্ছন্নতা এবং শৃঙ্খলা বাস্তবায়নের ব্যাপার হয়, তাহলে মূল দায়িত্ব অবশ্যই প্রশাসনের। নাগরিকের মনে শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিচ্ছন্নতার বোধ তৈরি করাও নগর প্রশাসনের দায়িত্ব।
প্রতিটি শহরের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন থাকে, তেমনি কিছু নিয়ম-নীতিও থাকে। নিউইয়র্ক অথবা লন্ডন, সিঙ্গাপুর অথবা মক্কা—প্রতিটি শহরেরই  বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা, কিছু নিয়মও আলাদা। বসবাসের নিয়ম মুখস্ত করে কেউ এ শহরে বাস করতে বা কাজ করতে আসে না। এসেই শেখে। এ শহরের সিংহভাগ মানুষ গ্রাম থেকে আসা ও গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। গ্রামীণ জীবনের অভ্যাস ও আচরণের প্রভাবমুক্ত সুনাগরিক হয়ে ওঠা একটি সময়সাপেক্ষ ও চর্চার বিষয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা নানা শ্রেণি-পেশার মানুষগুলো তার নিজ এলাকায় যিনি যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে অভ্যস্ত ছিলেন, তিনি রাজধানীতে এসেও যদি একই অবস্থা দেখেন, তাহলে সে একই জীবন-যাপনে অভ্যস্ত থাকবে। গণশৌচাগার কিংবা গণপরিবহনের বিষয়ে না হয় নাই গেলাম। শুধু পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আমরা যদি ‘যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলবেন না’ বলেই দায়িত্ব শেষ করে ফেলি, তাহলে সে উদ্যোগটি কখনওই সফল হওয়ার নয়। সিদ্ধান্তের অনুকূলে প্রতি ১০০ মিটারে না হোক অন্তত ২০০ মিটারে একটি ‘আমাকে ব্যবহার করুন’ জাতীয় ডাস্টবিন থাকা উচিত।
ধারণক্ষমতার চেয়ে ১০গুণ বেশি মানুষের এ শহরে নাগরিকরা না হয় শহর অপরিচ্ছন্ন করে চলছেন, কিন্তু নগর প্রশাসনের নিজস্ব উদ্যোগে যেটুকু পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার, রাখা দরকার তার কাজটিও হচ্ছে না। নগরীর সড়কগুলোর ডিভাইডারের ওপরে লাগানো নিরীহ গাছপালার ওপরেও কখনও এক ফোটা পানি পড়তে দেখি না। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর একটি সংসদ ভবন, তার সামনে শুধু পূর্বপাশে ফুটে আছে সবচে অযত্নে বাঁচতে পারা কিছু গাঁদা ফুল। আর কোনওদিকে কোনও ফুলের আবাদ চোখে পড়ে না।
সৌন্দর্য বর্ধনের কথাও না হয় বাদ দেওয়া গেল। নগর সংশ্লিষ্ট অন্য অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ও আমাদের সংবেদনশীলতার অ্যান্টেনায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা পড়ছে না। যেমন, ২৮ জানুয়ারির একটি দৈনিকের রাজধানী পাতায় ছাপা হওয়া খবরটা। (পরিসংখ্যান দেখলেও অবশ্য আজকাল সন্দেহ জাগে। বিশ্বাস করে আতঙ্কিত হব, নাকি অবিশ্বাস করে মুখ ঘুরিয়ে থাকব—বুঝে উঠতে পারি না।)
ভাবছিলাম, গাণিতিক হিসাবটা। সংবাদে আছে গত বছর এ শহরে মোট ৬৬ হাজার মানুষকে কুকুরে কামড়েছে। সারা দেশে সাড়ে ৩ লাখ। ধরে নিলাম ঢাকা শহরে ১ বছরে যে ৬৬ হাজার মানুষকে কুকুরে কামড়েছে, তাদের কামড়ানোর জন্যে হয়তো কুকুরের সংখ্যা ৬৬ হাজার ছিল না। কিছু কুকুর নিশ্চয় একাধিক মানুষকে কামড়েছে। ২ কোটি মানুষের শহরে যদি ৬৬ হাজার মানুষ কুকুরের কামড় খেয়ে থাকে তাহলে গড়ে কত শতাংশ মানুষ কুকুরের কামড় খেয়েছেন? আর শহরের সব কুকুরও নিশ্চই দুষ্টু কুকুর নয়, তাদের সবার সঙ্গেও নিশ্চয় মানুষ নামের প্রাণীরা দুষ্টুমি করেনি। সে অনুযায়ী ৬০ হাজার কুকুর যদি কামড়ে থাকে, তাহলে কামড়ায়নি এমন কুকুরসহ শহরে মোট কুকুরের সংখ্যা কত?

২০১১ সাল পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের কুকুর নিধন প্রকল্প ছিল। ২০১২ সালে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে কুকুর নিধন বন্ধ করা হযেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরামর্শে কুকুর বন্ধ্যাকরণের একটি প্রকল্প চালু থাকবার কথা ছিল। সে প্রকল্পটি নিষ্ক্রিয় অথবা অকার্যকর থাকবার কারণে আমাদের সহ-নাগরিক হিসেবে কুকুরের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। আর বাড়ছে কুকুরের কামড় খাওয়া মানুষের সংখ্যা। 

টিনটেড গ্লাসের ভেতরে বসে শহর দেখলে অবশ্য কুকুর খুব একটা চোখেও পড়ে না আর ডাবল লেয়ার জানালার ভেতরে থেকে হয়তো মাঝরাতে কুকুর সমাজের যূথবদ্ধ চিৎকারও খুব একটা শোনা যায় না। তবে জানালা খোলা রাখলে পাওয়া যায়। আর যাদের জানালা ভাঙা তারা হয়তো একটু বেশিই পায়।

একজন ভিনদেশি দূত এসে হয়তো আমাদের বলবেন,  আপনার শহর পরিচ্ছন্ন রাখুন, আমরা পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করব। তারপর একজন দেবদূতের অপেক্ষা করব, যিনি সিদ্ধান্তের অনুকূলে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন। কেউ কেউ হয়তো সৌন্দর্য চর্চার অংশ হিসেবে আইটেম গানের সঙ্গে নৃত্য প্রর্দশনের উদ্যোগ নেবেন, আমরা বরং কুকুর সামলাই। 

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ