X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংসার চিতা

তসলিমা নাসরিন
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৫১আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০৪

তসলিমা নাসরিন রামমোহন রায় সম্ভবত জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে। তখন ভারতবর্ষে ছিল ‘সহমরণ’ নামক একপ্রকার প্রথা। এই প্রথাটির অর্থ পতি নামক পুরুষের মৃত্যু হলে স্ত্রী নামক বস্তুটিকে পতি-পোড়ার আগুনে পুড়তে হবে। ভারতবর্ষে তখন সেই আগুনই দাউ দাউ জ্বলছিল। ‘রাজা রামমোহন রায়’ নামটির সঙ্গে সহমরণের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। ১৮১৮-১৯ সালে রামমোহন রায় লিখেছিলেন, ‘স্বামী মরিলে পর যে স্ত্রী ওই পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতি যে বশিষ্ঠের পত্নী তাঁহার সমান হইয়া স্বর্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভর্ত্তার সহিত পরলোক গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বর্গে বাস করে।… যে স্ত্রী ভর্ত্তার সহিত পরলোক গমন করে সে মাতৃকুল, পিতৃকুল এবং স্বামীকুল এই তিন কুলকে পবিত্র করে।’ – এ অবশ্য রামমোহন রায়ের কথা নয়। এ হচ্ছে ‘সহমরণ’ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ রচনাটির প্রবর্ত্তকের ভাষ্য। নিবর্ত্তকের ভাষায় রামমোহন বলেছেন, ‘তোমরা অগ্রে ওই বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ় বন্ধন কর, পরে তাহার ওপর এত কাষ্ঠ দেহ যাহাতে ওই বিধবা উঠিতে না পারে, তাহার পর অগ্নি দেওনকালে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়া ছুপিয়া রাখ। এ সকল বন্ধনাদি কর্ম কোন হারীতাদির বচনে আছে যে তদনুসারে করিয়া থাকো অতএব এ কেবল জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী হত্যা হয়।’
আমাদের পূর্বপুরুষেরা জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী হত্যা করেছেন। তাঁরা বলতেন, ‘এরূপ সহমরণে ও অনুসরণে পাপই হউক কিম্বা যাহা হউক আমরা এ ব্যবহারকে নিবর্ত্ত করিতে দিব না। ইহার নিবৃত্তে হইলে হঠাৎ লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সহমরণ করিলে আশঙ্কা থাকে না, জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও জীবৎকালে জানিতে পারে তবে তাহারও মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনও চিন্তা হয় না ইতি।’
জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী হত্যার এই তো উৎকৃষ্ট নমুনা। বিধবা অবস্থায় ব্যভিচার করার সম্ভাবনা অথবা আশঙ্কা আছে বলে স্ত্রীকে হত্যা করাই সঙ্গত বলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মনে করতেন। তাই তাঁরা নিঃশঙ্ক হতে চাইতেন স্ত্রীকে স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে, স্বামীও নিঃশঙ্ক হতেন—স্ত্রী পুড়ছেন, স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের বোঝা আর তাঁকে বইতে হবে না বলে।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পার্বতী, চন্দ্রমুখি, রাজলক্ষ্মী, হরিলক্ষ্মী, ভবানী, সবিতা, সারদাদের নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, তাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, স্বামীর ঘরে পাঠিয়েছেন, বিধবা বানিয়েছেন, প্রেমে পড়িয়েছেন। তিনিও জানতেন নারীত্বের মূল্য কি। তিনি লিখেছেন, ‘নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ কি পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীল, সতী এবং দুঃখ- কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ তাহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন। দাম কষিবার এছাড়া আর কোন পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিয়া দিতে পারি।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরও বলেছেন, ‘যাঁহারা ইতিহাস পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন বিধবা বিবাহ জগতের কোনও দেশে কোনওদিন সমাদর পায় নাই। কম-বেশি ইহাকে সকলেই অশ্রদ্ধার চোখে দেখিয়া আসিয়াছে। এ অবস্থায় যে দেশে এ প্রথা একেবারেই নিষিদ্ধ সে দেশে পুড়াইয়া মারা যে বিশেষ হিতকর অনুষ্ঠান বলিয়াই বিবেচিত হইবে, তাহা আশ্চর্য নয়। পুরুষ বুঝাইয়াছে, সহমৃতা হওয়া সতীর পরম ধর্ম। মনুও বলিয়াছেন, এক পতি সেবা ব্যতীত স্ত্রীলোকের আর কোন কাজ নাই। সে ইহকালে পুরুষের সেবা করিয়াছেন, পরকালে গিয়াও করিবে।’
তিনি সহমরণ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘স্বামীর মৃত্যুর পরই তাহার বিধবাকে একবাটি সিদ্ধি ও ধুতুরা পান করাইয়া মাতাল করিয়া দেওয়া হইত। শ্মশানের পথে কখনো-বা সে হাসিত, কখনো কাঁদিত, কখনো-বা পথের মধ্যে ঢুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে চাহিত। এই তার হাসি, এই তার সহমৃতা হইতে যাওয়া। তারপর চিতায় বসাইয়া কাঁচা বাঁশের মাচা বুনিয়া চাপিয়া ধরা হইত, পাছে সতী দাহ-যন্ত্রণা আর সহ্য করিতে না পারে। এত ধূনা ও ঘি ছড়াইয়া অন্ধকার ধুঁয়া করা হইত যে, কেহ তাহার  যন্ত্রণা দেখিয়া যেন ভয় না পায়; এবং এত রাজ্যের ঢাক ঢোল, বাঁশি ও শাঁখ সজোরে বাজানো হইত যে, কেহ যেন তাহার চিৎকার, কান্না বা অনুনয়-বিনয় না শোনে! এই তো সহমরণ!’
আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে এখনও বিধবার শাড়ি, চুল, হাত বা ঠ্যাং ধরে টেনেহিঁচড়ে চিতায় তুলবার দাগ, আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে বাঁশ দিয়ে বিধবা মেয়েকে চেপে ধরবার দাগ, এখনও পূর্বপুরুষের হাতে আমি আগুনের, ভস্মের গন্ধ পাই। এখনও পূর্বপুরুষের রক্ত থেকে নারীকে অপদস্থ করবার, আগুনে পোড়াবার প্রবণতা দূর হয়নি। এখনও ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় সহমরণ প্রথা চলছে সমাজে। হয়ত স্বামী মরলে স্ত্রীকে ধরে বেঁধে এখন আর চিতার আগুনে পোড়ানো হয় না, তবে পোড়ানো হয় কিন্তু অন্য আগুনে।
শুধু সহমরণই বা বলি কেন? এখন হচ্ছে একক মরণের কাল। আর এই মরণটি একা নারীর মরণ। নারীকে জন্মের পরই মরতে হয়, হয় তাঁকে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলে, আর যদি বা বেঁচেই থাকে, মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে করতে বাঁচতে হয়। বিবাহ হচ্ছে নারীর জীবনে সবচেয়ে যন্ত্রণাময় মৃত্যু। বিবাহিত জীবন এবং নরক জীবন অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রে প্রায় একই। নরকে সাপ-বিচ্ছু নাকি নিরন্তর কামড়ায়, সংসারে স্বামী এবং স্বামীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা নারীকে সাপ-বিচ্ছুর চেয়ে কিছু কম কামড়ায় না। সাপ-বিচ্ছুর কামড় তবু দাঁতে দাঁত চেপে সওয়া যায়, কিন্তু মানুষের কামড় সওয়া যায় না, আর তারা তো শুধু দাঁতে কামড়ায় না, তাদের আছে বিচিত্র রকম নখর। তারা কিছু ‘নিয়মনীতি’ তৈরি করেছে মেয়েদের কামড় দেবার জন্য সেই নিয়মনীতির কামড়ে মেয়েরা বিবাহপূর্ব, বিবাহিত এবং বিবাহোত্তর সব জীবনেই আক্রান্ত হয়।
রামমোহন রায় চিতার আগুনে বিধবা পোড়ানো বন্ধ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ ঘটিয়ে আরও এক পুণ্যের কাজ করেছিলেন বটে। ব্যভিচার আর ভ্রূণহত্যার ভয় দেখিয়ে তিনি বিধবাদের ‘গতি’ করেছিলেন। আপাতত চিতার আগুনে এবং বৈধব্যের নির্যাতন থেকে নারী বাঁচলো বটে –কিন্তু সত্যিকার বাঁচলো কি? সংসার সমাজে নারীকে পোড়াবার আগুন কিছু কি কম লেলিহান?
এই আগুন কি নারীকে চিতার আগুনের চেয়ে কিছু কম দগ্ধ করছে? হয়ত শরীরের মৃত্যু ঘটছে না, কিন্তু মৃত্যু ঘটছে মানবতার, স্বাধীনতার। মৃত্যু ঘটছে মানুষ হয়ে  বেঁচে থাকবার ন্যূনতম অধিকারের।
লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ