X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডেড সিটি’তে পরিণত হচ্ছে জেলা শহর‍

শুভ কিবরিয়া
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৮:০৯আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৮:১৫

শুভ কিবরিয়া আজকাল ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে যেতে হয়। প্রায় জেলা শহরে ঢুকতেই একই রকম উন্নয়নের চেহারা দেখি। আজ থেকে পাঁচ বা দশ বছর আগের দেখা জেলা শহরগুলোর অবয়বেও এসেছে নতুন চেহারা। কিন্তু সব জেলা শহরের জৌলুস বা উন্নয়ন ঢঙ প্রায় একই রকম। চারপাশে একটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের আওয়াজ দেখি। কিন্তু সেই উন্নয়ন বিবেচনায় ন্যায্যতা নেই। সমতা নেই। নেই সুপরিসর পরিকল্পনাও। যে যার মতো করে নিজের জন্য উন্নয়ন করে চলেছে।
প্রায় জেলা শহরেই বিশাল জায়গাজুড়ে বড় বাসা নিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা জজ আর এখন থাকেন বড় ক্যাম্পাসে র‌্যাবের অধিনায়ক। এর মধ্যে প্রথম তিনজনের সুপরিসর বাসভবন আগেও ছিল। চতুর্থজনের আবির্ভাব গত ঘটেছে একদশকে। এখন তিনটির মধ্যে পাল্লা চলে। হালে শুরু হয়েছে গেট নির্মাণের প্রতিযোগিতা। আজ ডিসির বাসভবনে প্রাসাদসম গেট নির্মাণ চলছে তো কাল সেটার দেখা মিলবে পুলিশ সুপারের বাসায়। পরশু হয়তো জেলা জজও সেরকম তোরণ তৈরি করছেন তার বাসভবনে। শুধু বাসা নয়, জেলা প্রশাসকের অফিস, পুলিশ সুপারের অফিস, কিংবা জেলা শহরের অন্যান্য সরকারি বিভাগের বড় কর্তাদের অফিস ঘিরেও তৈরি হচ্ছে নতুন তোরণ বা গেট।
এই তোরণ নির্মাণ সংস্কৃতির বাইরে প্রায় জেলা শহরে ঢুকলেই এখন কতগুলো ঘটনা অবশ্যম্ভাবীভাবে দেখা যাবে।
এক. প্রত্যেকটি জেলা শহরের অভ্যন্তরীণ মূল সড়কটিতে যানজট। এটা প্রায় বড়-ছোট সব জেলা শহরের চেহারা। বিদ্যুৎচালিত অটো, মোটরচালিত রিকশা, মানুষ, সাইকেল, ভ্যান আর গাড়ির যানজট এখন জেলা শহরগুলোর মূল সড়কের নৈমিত্তিক চিত্র। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক হারে বিদ্যুৎচালিত অটো, রিকশা, ভ্যানের আধিক্য পুরো শহরজুড়ে সারাক্ষণই যানজট লাগিয়ে রাখছে। এই যানজট নিরসনে জেলার কর্তাব্যক্তিদের কোনও কার্যকর উদ্যোগ কাজে লেগেছে, এরকম ঘটনার দেখা পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়।
দুই. প্রত্যেকটি জেলা শহরে মূল সড়ক, পার্শ্ব সড়ক, পাড়া-মহল্লায় এখন দেখা মিলবে অধিকসংখ্যায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার অথবা ছোট-বড় হাসপাতাল অথবা ডাক্তারের চেম্বার। গত দুই দশকে প্রত্যেকটি জেলা শহরে স্বাস্থ্য ব্যবসার বিকাশ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
তিন. প্রত্যেকটি জেলা শহরে সংখ্যাধিক্যে বহুতল আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে প্রচুরতর বাণিজ্যিক ভবন। এই ভবনগুলোতে পার্কিং সুবিধা নেই। ভবনগুলোর নির্মাণে কোনও সুপরিকল্পনাও চোখে পড়বে না।

জেলা শহরগুলোতে অবশ্যম্ভাবীভাবে চোখে পড়বে ছোট-বড়-মধ্যম নানান আকারের, বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিং সেন্টার। দেখা মিলবে হরেক রকম প্রাইভেট বিদ্যায়তন। কিন্তু জৌলুসহীন, রুগ্ন মনে হবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা।

চার. প্রায় প্রতিটি জেলা শহরের ভেতর দিয়ে বা পার্শ্ব দিয়ে প্রবাহিত হওয়া নদী বা খালটি হয় দখল হয়ে গেছে কিংবা দূষণে তা প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চারপাশে উঁচু উঁচু দালান উঠছে বটে, তবে দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে নদী-খাল-জলাশয়। এ চিত্র এখন যে কোনও জেলা শহরে গেলেই চোখে পড়বে।

পাঁচ. জেলা শহরগুলোতে আদালত পাড়ায় উপচে-পড়া ভিড় খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। আইনজীবী, বিচারক, পেশকার, মুহুরি যেমন চোখ জুড়াবে ঠিক তেমনি দেখা মিলবে বিচারপ্রার্থী অসংখ্য মানুষের দীর্ঘকালীন ছোটাছুটি। গরিব, অসহায় বিচারপ্রার্থী মানুষের লম্বা লাইন মিলবে সর্বত্রই। আর মিলবে চিকিৎসাপ্রার্থী জনগণের ভিড়। তৃণমূলে রোগী এবং বিচারপ্রার্থী দু’দল মানুষের সংখ্যাই বাড়ছে বিপুল হারে।

ছয়. জেলা শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ফুটপাত প্রায় নেই। থাকলেও সেগুলো হকারদের দখলে। পথচারী মানুষকে ঢাকা শহরে যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, সেই চিত্রের দেখা মিলবে জেলাশহরে।

সাত. জেলা শহরগুলোর বাজার দু’ক্ষেত্রে সরগরম। মাছ-মাংস বা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজারে ভিড় চোখে পড়বে। বিপুল পরিমাণে মাছ উৎপন্ন হয় প্রায় জেলা শহরেই। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ভালো থাকলে জেলায় উৎপন্ন সেই মাছ চলে আসে রাজধানীতে। স্থানীয় বাসিন্দারা সেই মাছের যোগান খুব একটা পান না। ব্যতিক্রম ভেদে যে কোনও জেলা শহরে মাছের দাম প্রায় ঢাকা শহরের কাছাকাছি অথবা তার চাইতে চড়া।

মাছ-মাংস বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে সবচাইতে চালু হচ্ছে ওষুধের দোকান। মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয় এখন ওষুধ। যে কোনও প্রেসক্রিপশন হাতে নিলেই চোখে পড়বে ওষুধের আধিক্য। আগে ভালো চিকিৎসক বলা হতো তাকেই যিনি কম ওষুধ লিখতেন। কিন্তু দ্রুত রোগী ভালো হয়। এখন আর সেই চল নেই। এখন ছোট-বড়-মাঝারি সব ডাক্তারই প্রচুর ওষুধ লেখেন। ওষুধ কোম্পানি, ল্যাব মালিক, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের চাপে ডাক্তাররা আর প্রেসক্রিপশনে কম পরিমাণে ওষুধ লেখেন না। ফলে, ওষুধের দোকানে ভিড় চোখে পড়বেই। যেমন চোখে পড়বে যে কোনও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা টেস্টের আধিক্য। যে কোনও জেলা শহরে গেলেই একই চিত্র দেখা যাবে।

আট. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বা শাখা আছে, এরকম জেলা শহরের সংখ্যাও এখন কম নয়। এখন যুক্ত হয়েছে, বেসরকারি নানারকম মেডিক্যাল কলেজ, প্যারামেডিক্যাল কলেজ, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আধিক্য। অনেক টাকা ব্যয় করে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা বিক্রি হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে দেদারসে। গ্রাম থেকে শহরে এসে প্রচুর আর্থিক খরচে লেখাপড়া করছেন সেখানে ছেলেমেয়েরা। কিন্তু সে শিক্ষার মান দেখার কেউ আছে কিনা, সে প্রশ্ন তুললে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

নয়. যে কোনও জেলা শহরের বড় সমস্যা এখন বিনোদনের অভাব। খেলার মাঠ নেই, পার্ক নেই, মেলামেশার স্বাস্থ্যসম্মত জায়গা নেই। খেলার মাঠ-পার্কগুলো ক্রমাগত দখল হয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে নানারকম মার্কেট বা বিপণি বিতান। সুস্থ বিনোদন নেই বলে যে কোনও জেলা শহরের যুবসমাজ ঝুঁকছে মাদকের দিকে।

দশ. নতুন আরেকটি বাজার তৈরি হয়েছে জেলা শহরে। সেটা হলো মোবাইল ফোনের বাজার। যে কোনও জেলা শহরে যে কোনও নামি ব্র্যান্ডের যে কোনও দামের মোবাইল কিনতে চাইলে আপনাকে খালি হাতে ফিরতে হবে না। যুবসমাজ এই মোবাইল ফোনের বড় ক্রেতা। মোবাইল ফোন বিক্রি, মোবাইল ফোন মেরামত, গান ডাউনলোড, পর্নো ডাউনলোড- এসব নিয়ে সরগরম এই মোবাইল ফোন মার্কেট।

জেলা শহরগুলোর এই উন্নয়ন চেহারা তার নিজস্ব নয়। এই উন্নয়ন ভাবনা তার ধার করা। রাজধানী ঢাকা যেভাবে দখল-দূষণ-যানজট আর রোগ-ব্যাধি বিস্তারকারী উন্নয়ন নিয়েই দিনকে দিন ক্ষমতাবান হচ্ছে, জেলা শহরগুলোও সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। আজকে ঢাকা শহরে যানজট যে বিপুলতর এবং সমাধানহীন সংকটে পরিণত হয়েছে, জেলা শহরগুলোর পরিণতিও সেদিকেই যাচ্ছে। উন্নয়ন ভাবনায় বড় ধরনের পরিবর্তন না আনলে, উন্নয়ন চিন্তায় কার্যকর সমন্বয় এবং নতুন ধারার পরিকল্পনা প্রণয়ন না করলে জেলা শহরগুলো ক্রমাগত ‘মৃতশহরের’ অবয়ব নেবে।

জেলা শহরে এখন অনেক ধরনের প্রশাসনিক ইউনিট কাজ করে। জেলা প্রশাসন কাজ করছে, থাকছে পৌরসভা, জেলা পরিষদ নতুন করে উজ্জ্বীবিত হচ্ছে। এর বাইরে থাকছেন সংসদ সদস্য তার ক্ষমতা ও কর্মপরিসর নিয়ে। এই বহুধা সংগঠন ও তার কর্তাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমলাতন্ত্র ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এই বহুপ্রকরণ এক ধারায় না মেলায় উন্নয়ন হচ্ছে, টাকার খরচ হচ্ছে, কিন্তু একটি উন্নয়ন অন্য উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্কট রোগের মতো সার্বিক উন্নয়নকে লাভের চেয়ে বোঝায় পরিণত করছে।  এভাবে চললে সত্যিকার সেবা জুটবে না জেলা শহরের জনগণের ভাগ্যে। যদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুনত্ব না আসে, যদি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তার শাসকদের চিন্তার মধ্যে সমন্বয় না ঘটে তবে জেলা শহরগুলো ভবিষ্যতে ঢাকার মতোই সমস্যার নগরে পরিণত হবে। অনেকটা ডেডসিটি হিসাবে আবির্ভূত হবে জেলাশহরগুলো।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ