X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশকদের দাবি কি আত্মঘাতী?

মোস্তফা হোসেইন
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৪:০০আপডেট : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৪:০৭

মোস্তফা হোসেইন একুশের গ্রন্থমেলা আয়োজন করতে চায় প্রকাশকরা। আর সেটা আগামী বছর থেকেই। সাংবাদিক সম্মেলন করে তারা দাবি জানিয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রশ্ন আসতে পারে, একুশের গ্রন্থমেলাটি নিয়ে তাদের এই দড়ি টানাটানি কেন?
বই মেলা মূলত বইয়ের বিপণনকে বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই অর্থে এটা প্রকাশকদেরই কাজ। অন্যদিকে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত এই মেলার জন্মও হয়েছিল প্রকাশকদের মাধ্যমে। কিন্তু একুশের গ্রন্থমেলাটা যেভাবেই শুরু হোক না কেন এই মেলাটি আমাদের প্রাণের মেলা হয়ে উঠেছে মূলত ভাষার মাস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে। সেই সুযোগটিই তৈরি করেছিলেন মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা। যার যাত্রা হয়েছিল বাংলা একাডেমি চত্বরে চট বিছিয়ে বই সাজিয়ে বসার মাধ্যমে। যা পরবর্তীকালে ৭ প্রকাশকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিস্তৃত হতে থাকে। সাধারণ মানুষও তাকে গ্রহণ করেছে আন্তরিকভাবে। বাংলা একাডেমিও আমাদের জাতীয় চেতনা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অনুসারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে স্বাভাবিক কারণে। আজকে ৭০০ স্টলের বিশাল আয়োজন করতে সেই প্রেরণাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। সত্তরের দশকে যে মেলা মাত্র একটি প্রকাশনা সংস্থায় সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে এত বিশাল আয়োজনে পরিণত হওয়ার পেছনে তাই শুধুই ব্যবসায়ীক বিষয় জড়িত নেই। মানুষের আবেগ দেশাত্ববোধ এখানে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
এই বিশাল আয়োজনের পেছনে বাংলা একাডেমির ৪৭৫জন কর্মী সার্বক্ষণিক কাজ করে অন্তত তিন মাস। প্রতিবছর জুন মাস থেকে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। তখনও অন্তত ২০/২৫ জন যুক্ত হয়ে যায় মেলা অনুষ্ঠানের আয়োজনের সঙ্গে। বিশাল ও দীর্ঘসময়ের এই কর্মযজ্ঞে বাংলা একাডেমি কর্মরত কর্মীদের অতিরিক্ত কোনও কর্মীকে নিয়োগ করে না। বাংলা একাডেমির কাজেরও বড় কোনও ক্ষতি হয় না। শুধু মেলা চলাকালে তাদের ছুটি/অবকাশ বন্ধ থাকে। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ করে পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, ডিবি, এসবি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর সবাই  যেমন এখানে যুক্ত হয় তেমনি এর সঙ্গে সরকারের সেবাদানকারী প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই যুক্ত হয়। যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগের মতো প্রায় সব প্রতিষ্ঠান।
বাংলা একাডেমি একটি সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। জনবল কাঠামো একটা নীতি নিয়মের আওতায় চলে। যাদের সরকারের কাছেও দায়বদ্ধতা থাকে। এই মেলা আয়োজনের জন্য সরকারি তহবিল থেকেও অর্থ ব্যয় হয়। বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়ন নিমন্ত্রণসহ ব্যবস্থাপনাগুলোও তাদেরই করতে হয়। সেটিও হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে।
এখন প্রশ্ন করা যায়, প্রকাশকরা এই আয়োজনের জন্য উৎসাহী কেন। তাদের অবশ্যই যুক্তি আছে। যুক্তি ও বাস্তবতার বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের এই প্রকাশকদের সাংগঠনিক কাঠামো তাদের ঐক্য ও বিভেদ, আধুনিক মনস্কতা, এ ধরনের আয়োজনে দক্ষতার মতো বিষয়গুলো অবশ্যই দেখার বিষয়। প্রথমই আসা যাক তাদের সাংগঠনিক বিষয়।

প্রকাশকদের সাংগঠনিক কাঠামোতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নাম করতে হয়। বিক্রেতা যুক্ত হওয়ার কারণে একসময় এর সদস্য ছিল প্রায় ১১ হাজার। দেশব্যাপি বিস্তৃত ছিল এটি। পরবর্তীকালে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। বর্তমান বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত মেলায় ৭০০ স্টলে ৪০২টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্ব করছে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। যাদের সাধারণ সদস্য সংখ্যা ১৫৫। তার মধ্যে কার্যনির্বাহী সদস্য সংখ্যা ১৮। অর্থাৎ ওই হিসেবে বর্তমান সংগঠনটি প্রকাশকদের অর্ধেকেরও কম প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

প্রকাশকরা একসময় মেলা ব্যবস্থাপনায় প্রত্যক্ষ অংশ নিত। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির প্রধান ওসমান গণির বক্তব্য অনুযায়ী সম্প্রতি বাংলা একাডেমি তাদের প্রায় বাদ দিয়েছে। দুয়েকটি সভায় ডাক দেওয়া ছাড়া প্রকাশকরা সেখানে কোনও ভূমিকা রাখতে পারে না। তার বক্তব্য অনুযায়ী বই প্রকাশকদের এই মেলায় মূলত বাংলা একাডেমিই একক কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। এতে করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশকরা কিছুটা সমস্যায় পড়ছেন। যতটা ফল প্রত্যাশা থাকে সেটা অর্জন সম্ভব হয় না। আর প্রকাশকদের বিষয়টি প্রকাশকদের হাতে আসাই যথোচিত বলে তিনি মনে করেন।

প্রকাশকদের সাংগঠনিক কাঠামো বিবেচনায় যদি মনে করা হয় যে মেলার মতো বিশাল কাজে হাত দিলে এটা তেমন বিষয় হবে না। সেক্ষেত্রে তারা বাইরে থেকে দক্ষ লোক নিয়োগ করে মেলা পরিচালনা করতে পারবেন। যেভাবে কলকাতা বইমেলা আয়োজন হয় সেভাবেই হতে পারে। তারপরও প্রশ্ন আসে প্রকাশকদের সেই ক্ষমতা কতটা আছে। বাংলা বাজারেরই একজন প্রকাশক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তাদেরই বিরুদ্ধে। বললেন, এখন বাংলা একাডেমির যেহেতু বিক্রয়লব্ধ অর্থের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তাদের স্টল বিতরণ কর্মকাণ্ডে কিছু ত্রুটি থাকলেও অন্তত তুলনামূলক স্বচ্ছতা রাখতে তারা সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশকদের হাতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শতভাগ চলে গেলে সেটা হবে কুরুক্ষেত্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রকাশক স্পষ্টতই বললেন, প্রকাশক সমিতি যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সেটা হবে আত্মঘাতী একটি প্রক্রিয়া। নিজেদের মধ্যে মতভেদ একসময় মামলা মোকাদ্দমা থেকে শুরু করে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

এদিকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক স্পষ্ট করেই বলেছেন প্রকাশকরা এই দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে গেলে বাংলা একাডেমির কোনও আপত্তি নেই। বাংলা একাডেমির এমন বক্তব্যকে ওসমান গণি বাংলা একাডেমির ব্যর্থতা স্বীকার বলে মনে করেন। এ কারণেই মেলাটির ব্যবস্থাপনায় প্রকাশকদের হাতে চলে যেতে পারে বলেও তিনি মনে করছেন।

অথচ প্রকাশকরা যদি এমন ভাবতেন, বাংলা একাডেমির মেলা বাংলা একাডেমিতেই থাকুক। এর ফলতো পাচ্ছে প্রকাশকরাই। যেহেতু তারা মনে করছে এমন মেলার ব্যবস্থাপনার পূর্ণ ক্ষমতা ও দক্ষতা তাদের আছে। তাই তারাতো ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলাটির আয়োজক হতে পারে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিক্রি বাড়বে প্রকাশনা বাড়বে, পাঠকও বাড়বে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলা এখন চোখে পড়ে না। এই মেলাটি জানুয়ারির প্রথমদিন থেকে হয় বলে হয়তো এর আকর্ষণ কম থাকে। তাই বাঙালির চেতনা সম্পৃক্ত বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা আন্তর্জাতিক মেলা হলেতো তাদেরই লাভ হওয়ার কথা। এটা হয়তো পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে হলে আরও সুবিধা। একুশে ফেব্রুয়ারি পালনকালে যেমন হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয় বৈশাখী উৎসবেওতো লাখো মানুষের জমায়েত হয়। তারা ইচ্ছা করলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেই মেলার স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারেন। তারা ইচ্ছা করলে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন। যেহেতু বাংলা একাডেমি বই মেলায় দেশি বই ছাড়া বিক্রি করা যায় না, তাই ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলাকে দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। বইয়ের বিপণন সুবিধার্থে তারা নববর্ষে বই উপহার কর্মসূচি হাতে নিয়ে নতুন একটা বিপ্লবও ঘটাতে পারে।

আজকের প্রজন্ম  যেভাবে দিবসকেন্দ্রিক মানসিকতা পোষণ করে প্রকাশক সমিতিগুলো যদি নতুন প্রজন্মের সেই চেতনাকে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করতে পারে তাহলে জাতীয় দায়িত্ব পালনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে।

ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে তারা বই ফেরি কার্যক্রমও হাতে নিতে পারে। এতে করে বর্তমান বাংলা একাডেমি একুশে গ্রন্থমেলা অক্ষুন্ন রেখে তাদের ব্যবসায়ীক সাফল্য যেমন আসতে পারে তেমনি বাঙালি চেতনাকে সঙ্গে নিয়েই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব।

পরিসংহারে প্রকাশকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলায় আপনাদের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ বাড়িয়ে এটাকে বাংলা একাডেমির হাতেই রেখে দিন। আর বই পাঠ ও প্রকাশনার সুবিধার্থে ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলাটিকে পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক আয়োজন করুন। একই সঙ্গে নববর্ষে বই উপহার দেওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলতে পারেন। সবক্ষেত্রেই আর্থিক ফলটা যাবে আপনাদেরই ঘরে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ