X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক অঞ্চল: উন্নয়ন প্রচেষ্টায় মানবিক ভাবনা বিবেচ্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০২ মার্চ ২০১৬, ১১:৫২আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৬, ১১:৫৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাবাংলাদেশে বিনিয়োগের যে কয়টি সমস্যা বেশি আলোচিত, তার একটি জমির স্বল্পতা। আর আছে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতা। ঠিক এই যখন বাস্তবতা, তখন ঘোষণা এলো দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। উপযুক্ত স্থান কতটা নির্বাচিত করা গেল বা যাবে, জানি না,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০টি অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।
আমাদের মনে আছে কত আয়োজন করে, কত ঘটা করে এদেশে একসময় বিসিক শিল্প-নগরী করা হয়েছিল। সেগুলো যতটা না এখন শিল্পাঞ্চল, তার চেয়ে বেশি গোচারণ ভূমি। তাই এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কি তা এখনই বলা যাচ্ছে না, যেমনি বলা যাচ্ছে না এগুলোর কয়টা কিভাবে আসবে। বলা হচ্ছে এমন অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে ৫০টি। প্রধানমন্ত্রী ১০টির ঘোষণা দিলেন, কিন্তু এখনও অনেকগুলোয় প্রাথমিক কাজও শুরু হয়নি বলে জানা গেল।
অর্থনৈতিক অঞ্চল বিশ্বের বহু দেশেই অগ্রাধিকার পায় না এখন আর।  কোন জমি, কার জন্য, কিভাবে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে এবং উঠছেও। যে কারণে বিসিক শিল্প-নগরী সফল হয়নি, সে কারণগুলো কি বিশ্লেষণ করা হয়েছে? নতুন করে জমি অধিগ্রহণ কেন করা হচ্ছে, কেন সেই রুগ্ন শিল্প-নগরীগুলোকেই অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হলো না সে কথাওতো বলা যায়।
এরইমধ্যে হবিগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনে বিরুদ্ধে চা-বাগানের শ্রমিকরা অবস্থান নিয়েছে। তারা আন্দোলনে নেমেছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা-বাগানের পতিত ভূমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় চান্দপুর চা-বাগানের অধীনে থাকা ৫১১ একর ভূমির ইজারা বাতিল করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরে তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসন। চান্দপুর চা-বাগানের শ্রমিকেরা ওই এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তাদের দাবি, ওই পতিত জায়গায় তারা চাষাবাদ করে আসছেন। এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হবে।

সরকার বলছে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে শ্রমিকদের ভাগ্য বদলে যাবে। কারণ বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এমন একটি ধারণা আমরা সবসময়ই পাই যে জমি অধিগ্রহণের ফলে যে অঞ্চলের কৃষক উচ্ছেদ হয় তারা পরবর্তীতে ওই শিল্প অঞ্চলে গড়ে ওঠা কারখানাতেই চাকরি পায়। এটি আসলে কতটা সত্য? কৃষক এবং শ্রমিকের দক্ষতা এক হতে পারে না। বাস্তবতা হলো যিনি বিনিয়োগ করেছেন এখানে তার চাওয়াটাই আসল। কৃষককে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার জমি নিয়ে নেওয়ার পর দেখা যায় চাকরি হচ্ছে অন্য এলাকা থেকে আগত মানুষের। কারণ বিনিয়োগকারী চান দক্ষ শ্রমিক।

বলা হচ্ছে বর্তমান বাজারদরে জমির দাম দেওয়া হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলা হয় বরাদ্দকৃত এলাকার কৃষক বা আদিবাসীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা কখনওই বিবেচনা করেন না যে, কৃষকের কাছে এক খণ্ড জমি তার এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের উপার্জনের একমাত্র সম্বল। ফলে বর্তমান বাজার দরের ওপর ভিত্তি করে কৃষি জমির এককালীন ক্ষতিপূরণ দিলে কি তার ন্যায্য আচরণ করা হয়? কৃষি জমির ক্ষতিপূরণ নগদ অর্থে দেওয়ার পরও কথা থাকে যে সব কৃষক বংশ পরম্পরার জীবিকা ছেড়ে শিল্প কারখানার শ্রমিক হতে আগ্রহী হবে কিনা।

আমরা অনেকদিন থেকেই শিল্পখাতের প্রসারের কথা বলছি। কিন্তু আমাদের সাফল্য বেশি কৃষিতে। মানুষ বাড়ছে, জমি কমছে। তবুও কৃষি তার প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়ে না ওঠায় কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পায় না। তবুও কখনও সে উৎপাদন থেকে সরে আসেনি। প্রবৃদ্ধিতে শিল্প খাতের অবদান সংখ্যাগতভাবে কৃষি থেকে বেশি। কিন্তু খাদ্য এবং খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানুষের জল, জমি, জীবিকা, নদী, এবং সর্বোপরি সমাজ, সংস্কৃতি ও স্থানীও অর্থনীতির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক যা প্রবৃদ্ধির অঙ্কে বিচার করা সম্ভব নয়।

সাফল্য প্রশ্নাতীত, সরকারও সেই সাফল্যের কথা বলে। কিন্তু কৃষি বরাবরই একটি অরক্ষিত খাত। এবং কৃষক বরাবরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অনিশ্চিত বাজার অর্থনীতির চরিত্র নিয়েই কাজ করে যায় কৃষকরা। বছরের পর বছর উৎপাদিত শস্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকের পক্ষে দারিদ্রের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কৃষি খাতটিকে ঘিরে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা কখনওই দেখা গেল না।

আমরা যাই বলিনা কেন অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বছরের জুনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে এ থেকে বছরে চার হাজার কোটি ডলার আয় এবং এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন।

বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যক্তিখাতের সাফল্য আছে, তাদের প্রয়োজনও মেটাতে হবে। কিন্তু  ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রভাবের কথাও আমরা জানি।

শিল্পায়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, কিন্তু তা অর্থনৈতিক অঞ্চল কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আর জনগণকে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের ভূমি কেড়ে নিয়ে করা হলে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানবিকতার অভাব থেকে যায়। মানবিক না হলে, তা মানুষের কাজে লাগে?

অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জায়গা বাছাই এবং অধিগ্রহণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজমি, জনগণের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও প্রতিবেশসহ অনেক কিছুই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়। জমি অধিগ্রহণ  স্পর্শকাতর বিষয়, তা বিবেচনায় নিতে হবে। মংলায় নদী ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। মৌলভীবাজারে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের খবরে এলাকাবাসী, যারা ন্যায্য দাম পাননি বলে সংক্ষুব্ধ, তারা প্রতিবাদী হতে চেয়েছেন। সুতরাং প্রকল্প শেষ অব্দি কতটা বাস্তবায়ন হয় তা যেমন দেখার বিষয়, বেশি ভাবনার বিষয় মানুষের প্রেক্ষাপট মাথায় নেওয়া।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ